কেবল এনজিওর সাইনবোর্ড নয়, রোহিঙ্গাদের বাঁশ-প্লাস্টিকের তৈরি অস্থায়ী ঘরেও সজোরে তাদের লাঠির বাড়ি পড়ছিল।
শুক্রবার দুপুরে কক্সবাজারের টেকনাফের জাদিমুরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দেখা যায় এমন চিত্র। যুবলীগ নেতা ওমর ফারুক হত্যাকাণ্ডের পর রাস্তায় নেমে আসা মানুষদের সঙ্গে ছিল এই শিশু-কিশোরেরা।
মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত এই শরণার্থীদের সাদরে গ্রহণ করে, খাবার আর আশ্রয় দিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছিল কক্সবাজারের মানুষ। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর দ্বিতীয় চেষ্টাও ব্যর্থ হওয়ায় শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সব বয়সী মানুষের মধ্যেই উদ্বেগ আর রোহিঙ্গাবিরোধী মনোভাব বাড়ছে।
২০১৭ সালের ২৫ অগাস্টের পর থেকে সোয়া সাত লাখ রোহিঙ্গার আগমনে হঠাৎ করেই এ এলাকার জনসংখ্যা বেড়ে গেছে অনেক। উখিয়া ও টেকনাফে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর তুলনায় রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এখন দ্বিগুণ।
খুব অল্প সময়ের মধ্যে স্রোতের মতো আসা রোহিঙ্গাদের চাপে স্থানীয়দের কাজের ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হয়েছে।
কৃষিকাজ ও মাছ ধরা একপ্রকার বন্ধ। রোহিঙ্গাদের অনেকের অপরাধ প্রবণতা এবং নিরাপত্তার যাতাকলে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে এলাকার মানুষ।
চলতি বছর ইউএনডিপির এক গবেষণায় দেখা যায়, কক্সবাজারের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ বলেছে, তারা রোহিঙ্গাদের কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। জরিপে অংশ নেওয়া টেকনাফের শতভাগ এবং উখিয়ার ৮০ শতাংশ মানুষ বলেছেন, তারা রোহিঙ্গাদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত।
চার একর জমিতে কৃষিকাজ করে সংসার চালাতেন কুতুপালংয়ের বাসিন্দা ফখরুদ্দিন। রোহিঙ্গারা আসার পর সেই জমি তাদের দখলে চলে গেছে।
জমি হারিয়ে এখন ফ্রেন্ডশিপ নামের একটি এনজিওর অস্থায়ী স্কুলে নৈশপ্রহরীর চাকরি পেয়েছেন তিনি। তাতে সংসার চলছে কোনোরকমে।
কুতুপালং বাজারে কথা হয় পঞ্চাশোর্ধ্ব এই ব্যক্তির সঙ্গে। শরণার্থীদের চাপের কারণে নিজেদের ভোগান্তির কথা জানালেন ফখরুদ্দিন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের সবই ঠিক ছিল। এখন আর নেই। আমি হয়ত ছোট একটা চাকরি পেয়েছি, কিন্তু অন্যদেরতো তাও নেই।”
এখন কোনোমতে টেনেটুনে সংসার চালালেও ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কার কথা জানালেন ফখরুদ্দিন।
রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী বসবাসকে কেন্দ্র করে দেশি-বিদেশি উন্নয়ন সংস্থার সুবিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে কক্সবাজারে। ক্যাম্পের মধ্যে জরুরি ত্রাণ সহায়তায় চলছে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার জীবন।
মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে কক্সবাজারে আসার পর রোহিঙ্গাদের প্রতি বেশ সহানুভূতি দেখিয়েছিল স্থানীয় মানুষ। কিন্তু ক্রমান্বয়ে তাদের প্রতি মানুষের মনোভাব বদলে যাওয়ার বিষয়টি উঠে আসছে বিভিন্ন গবেষণায়।
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ব্র্যাকের এক গবেষণায় স্থানীয় পাঁচ শতাংশ মানুষ বলেছিলেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া ঠিক হয়নি। কিন্তু চলতি বছরের এপ্রিলের জরিপে তা বেড়ে ৮০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন গবেষণার সমন্বয়ক চিররঞ্জন সরকার।
স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করলেও বেশিরভাগের কথায় রোহিঙ্গাবিরোধী মনোভাবের আঁচ পাওয়া যায়। তারা মনে করেন, এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার অবস্থানের কারণে কিছু লোক ছাড়া বেশিরভাগ স্থানীয় বাসিন্দা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
রোহিঙ্গা ঢল শুরু হওয়ার আগে টেকনাফের ৮০ শতাংশ মানুষ কৃষিকাজ কিংবা মাছ ধরার কাজে জড়িত ছিলেন। কিন্তু এখন সেসব কাজ নেই বললেই চলে।
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নিয়মতি যাতায়াত রয়েছে স্থানীয় সাংবাদিক আব্দুর রহমানের। কাজের সূত্রে স্থানীয়দের সঙ্গে বেশ যোগাযোগ হয় তার।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আগে মানুষ যে মানবিক দিক দেখাত, সে দিকটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। রোহিঙ্গাদের কালচার, চলাফেরা- এসব নিয়ে অনেকে আপত্তি করছে। স্থানীয় মানুষের অর্থ উপার্জন কমে গেছে।”
রোহিঙ্গাদের কারণে চলাফেরাও যে কঠিন হয়েছে- সেটাও মাথায় রাখার কথা বলেন সাংবাদিক আব্দুর রহমান।
“টেকনাফ-কক্সবাজার সড়ক ভাঙাচোরা হওয়ায় যাতায়াতের কষ্টে ভুগছে মানুষ। এই সড়কের বিভিন্ন বাজারে যানজট নিত্যদিনের। যে রাস্তায় আগে ১০০ গাড়ি চলত এখন সেখানে কমপক্ষে এক হাজার গাড়ি চলায় রাস্তার অবস্থা শোচনীয়।”
“তারা মনে করছে, রোহিঙ্গারা তাদের চেয়ে সুখে আছে। এই আরাম আয়েশ ছেড়ে তারা আবার মিয়ানমারে নির্যাতনের মুখে যেতে চাইবে না।”
টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের জসিম উদ্দিনেরও পাঁচ একর জমি দখল হয়েছে রোহিঙ্গা ঢলের পর। শরণার্থীদের চাপে মধ্যে জমি ধরে রাখার সুযোগ তার ছিল না।
চাষের জমি হারিয়ে এখন একটি এনজিওর সঙ্গে দৈনিক বেতনে কাজ করেন তিনি, তবে সেটা পাঁচ জনের সংসার চালানোর জন্য যথেষ্ট নয়।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জসিম বলেন, “আমাদের সাজানো-গোছানো সময়ে রোহিঙ্গারা এসেছে। কিন্তু তাদের জায়গা দেওয়া ছাড়া আমাদের কোনো উপায় ছিল না। তারা কবে মিয়ানমারে ফিরবে তা জানা নাই। তবে যত তাড়াতাড়ি তারা ফিরবে, তত মঙ্গল।”