ওই ঘটনা সেনাবাহিনীর ‘কোনো আক্রমণ নয়’ মন্তব্য করে তিনি বলেছেন, নির্যাতিত শিক্ষার্থীদের ন্যায়সঙ্গত দাবিগুলো পূরণের ব্যবস্থা করা হলে ‘পরবর্তী ঘটনাগুলো ঘটত না’।
রাজনৈতিক উত্তাপের মধ্যে ২০০৭ সালের শুরুতে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশে জরুরি অবস্থা জারির কয়েক মাস পর ওই বছর ২০ অগাস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেশিয়ামে কয়েক সেনা সদস্যের সঙ্গে ছাত্রদের সংঘর্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে আন্দোলনে নেমেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা।
বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশ চড়াও হলে রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
টানা তিনদিন আন্দোলনের পর ২৩ অগাস্ট ছাত্রদের হলত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষক এবং আটজন ছাত্রকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি সারা দেশের শিক্ষার্থীদের উপর নির্যাতন চালানো হয়। পরে ছাত্র-শিক্ষকদের ধারাবাহিক আন্দোলনের মুখে মুক্তি পান কারাবন্দি ছাত্র-শিক্ষকরা।
পরের বছর থেকেই ২৩ অগাস্টকে 'কালো দিবস' হিসেবে পালন করে আসছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা।
দিবসটি উপলক্ষে শুক্রবার টিএসসি অডিটোরিয়ামে আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্য দেন উপাচার্য আখতারুজ্জামান।
তিনি বলেন, “কালো দিবস উদযাপনের মূল কারণ হল যে, আমরা এই ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করব।”
“সেনাবাহিনী দেশের গৌরবের একটি অংশ। সেনাবাহিনী আমাদের স্বাধীনতার একটি প্রতীক। ঠিক তেমনিভাবে আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রতীক এবং একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও দেশের জাতীয় প্রতিষ্ঠান। সেই সময়ের এই ঘটনাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সেনাবাহিনীর মধ্যে আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণের কোনো ঘটনা নয়। আমরা এই বিষয়গুলোকে যেন গুলিয়ে না ফেলি।”
বিষয়টিকে ‘ইতিহাসের একটি ঘটনা’ হিসেবে বর্ণনা করে উপাচার্য বলেন, “২০ অগাস্ট থেকে ২৩ অগাস্ট পর্যন্ত-এই সময়ের মধ্যে ঘটনাগুলো ঘটেছিল। এর চূড়ান্ত পরিণতি হল ২৩ অগাস্ট। সেটি হলো এ রকম যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে খেলা চলছিল। সেই খেলাকে কেন্দ্র করে, সেখানে আমাদের সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল, সেই ক্যাম্পের দুই-একজন সদস্যের সাথে আমাদের শিক্ষার্থীদের বাগবিতণ্ডা হয় এবং এক পর্যায়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা সেখানে নির্যাতিত হন। এবং সেই নির্যাতিত শিক্ষার্থীরা তখন প্রতিবাদ করে। এটি হল আমাদের ইতিহাসের একটি শিক্ষা।”
শিক্ষাটি কেমন তা নিয়ে অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, “সেদিন যারা কর্তৃপক্ষের অবস্থানে ছিল, সেদিন যারা ব্যবস্থাপনায় ছিল, সেদিন যারা প্রশাসনে ছিলেন, সেটি হোক সরকারি প্রশাসন কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, সেই প্রশাসনের অনেক শিক্ষা গ্রহণের কথা ছিল সেটি হল এ রকম- নির্যাতিত শিক্ষার্থীরা যখন দাবি তুলল, সেই দাবিগুলো ছিল ন্যায়সঙ্গত। যারা নির্যাতিত হয়, তখন তারা সেই নির্যাতনের প্রতিকার চায়। তখন তারা চেয়েছিল সেটির সুষ্ঠু তদন্ত করে বিচার করা হোক। তারা তখন চেয়েছিল যে, যারা আক্রমণকারী সদস্য তারা যেন ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
“শিক্ষার্থীদের এই ধরনের ন্যায়সঙ্গত বক্তব্য ছিল। আমরা সেদিন যদি যারা যেখানে প্রশাসনে ছিল, যারা যেখানে ব্যবস্থাপনায় ছিল, সেটা যদি ওই দিন সঠিকভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হতাম যে, শিক্ষার্থীদের দাবি কী? সেই দাবিগুলো যদি পূরণ করার ব্যবস্থা করা হত তাহলে পরবর্তী ঘটনাগুলো ঘটত না।”
২০০৯ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ওই ঘটনার তদন্ত করে, যাতে ছাত্র-শিক্ষকদের নির্যাতনের জন্য ডিজিএফআইয়ের তৎকালীন কর্মকর্তাদের দায়ী করা হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই)সহ নিরাপত্তা বাহিনীর অন্যান্য সংস্থা যেমন পুলিশ, র্যাব ইত্যাদি বাহিনীর বাড়াবাড়ি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে নগ্ন হস্তক্ষেপ অনভিপ্রেত ঘটনাবলীর অন্যতম কারণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্ঘটিত ঘটনার জন্য তৎকালীন শিক্ষা উপদেষ্টা আইয়ুব কাদরী ডিজিএফআইকে দায়ী করে সংসদীয় কমিটির কাছে বক্তব্য দেন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
আইয়ুব কাদরী কমিটিকে বলেন, ঘটনার পরপরই উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি সভা হয় এবং তাতে ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার, তদন্ত কমিটি গঠন ও দায়ীদের শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
“কিন্তু আকস্মিকভাবে ওই সভায় ডিজিএফআইয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা উপস্থিত হয়ে সিদ্ধান্তের বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন এবং সভার কার্যপত্রে তা না রাখার চাপ দেন। কেবল তাই নয়, ওই গোয়েন্দা সংস্থার নির্দেশে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের গ্রেপ্তার করা হয়,” কাদরীকে উদ্ধৃত করে বলা হয় প্রতিবেদনে।
সংসদীয় কমিটির অনুসন্ধানে দেখা যায়, শিক্ষক-ছাত্রদের গ্রেপ্তার, নির্যাতন, তাদের সাজা দেওয়া, মুক্তিতে দেরির করার সব বিষয়ে ডিজিএফআইয়ের হস্তক্ষেপ ছিল।
কমিটি বলছে, “ডিজিএফআই ও কতিপয় সেনা সদস্য শিক্ষক ও ছাত্রদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে যে নির্যাতন করেছেন, তা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।”
আলোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, “আমরা যখন ২৩ অগাস্টের কথা নিয়ে আসব একই সাথে তার আগের ঘটনাগুলোকেও নিয়ে আসা দরকার হয়। কারণ এই ঘটনার ক্ষেত্র যারা তৈরি করেছিল তাদেরকেও চিহ্নিত করা দরকার।”
সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম, রেজিস্টার মো. এনামুজ্জামান ও ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নূর।
তিনি বলেন, “পৃথিবীর সমস্ত জায়গায় এটা প্রমাণিত যে, রাজনীতিকে বিশুদ্ধ করতে হলে রাজনীতির দ্বারাই বিশুদ্ধ করতে হয়। সেনাবাহিনীর দ্বারা রাজনীতি কোনো দিন বিশুদ্ধ করা যায় না। এই প্রথম তারা যখন এই কাজটা শুরু করলেন তখন তারা প্রথম বেআইনি কাজ যেটা করলেন, সেটা হল তারা ভয় পেয়েছিলেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের এই মাইনাস টু ফর্মুলা বাতিল করে দেবে। সুতরাং তারা প্রথম যে কাজটি করেছিলেন সেটা হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেশিয়ামে অবৈধভাবে একটি সেনা ক্যাম্প স্থাপন করেছিলেন।
রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে সংসদীয় কমিটির ওই তদন্তের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ এবং তাতে দোষী হিসেবে চিহ্নিত সেনা সদস্যদের শাস্তির দাবি জানান এই অধ্যাপক।
“২৩ অগাস্ট এই ঘটনা গড়াতে গড়াতে একটি অমানবিক নির্যাতন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজের ওপর সংঘটিত হয়,” বলেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও সিন্ডিকেট সদস্য মোহাম্মদ হুমায়ুন কবিরের সঞ্চালনায় সমাবেশে প্রায় ২০ জন শিক্ষক অংশ নেন।