রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এবারও শুরু হল না

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সব প্রস্তুতি নেওয়ার পরও রোহিঙ্গারা ফিরতে আগ্রহী না হওয়ায় প্রত্যাবাসন শুরুর দ্বিতীয় চেষ্টাও ঝুলে থাকল অনিশ্চয়তায়।

মাসুম বিল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 August 2019, 08:48 AM
Updated : 22 August 2019, 05:49 PM

রাখাইনের গ্রামে গ্রামে হত্যা-ধর্ষণ আর ব্যাপক জ্বালাও পোড়াওয়ের মধ্যে প্রাণ হাতে করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা এই রোহিঙ্গারা ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে অন্তত চারটি শর্তের কথা বলছেন।

তাদের দাবি, প্রত্যাবাসনের জন্য আগে তাদের নাগরিকত্ব দিতে হবে। জমি-জমা ও ভিটেমাটির দখল ফেরত দিতে হবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। রাখাইনে তাদের সঙ্গে যা হয়েছে, সেজন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে মোমেন রোহিঙ্গাদের এই অনাগ্রহকে ‘দুঃখজনক’ বলেছেন। আর জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর বলেছে, রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছ্বায় ফেরা নিশ্চিত করতে হলে তাদের মধ্যে আস্থা তৈরির বিকল্প নেই।

রাখাইনের অধিবাসী হিসাবে ১০৩৭টি রোহিঙ্গা পরিবারের যে তালিকা মিয়ানমার পাঠিয়েছিল, সেটি ধরে প্রত্যাবাসনের জন্য গত কয়েকদিন ধরে তাদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন ইউএনএইচসিআর ও বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরা। ওই রোহিঙ্গাদের মধ্যে স্বেচ্ছায় যেতে আগ্রহীদের প্রথম দলকে বৃহস্পতিবার মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কথা ছিল।

তালিকার ওই ১০৩৭টি পরিবারের ৩৫৪০ জন শরণার্থী থাকেন টেকনাফের ২৪, ২৬ ও ২৭ নম্বর ক্যাম্পে। সেখান থেকে তাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য শালবাগান এলাকার ক্যাম্পে রাখা ছিল তিনটি বাস, চারটি মাইক্রোবাস ও দুটি ট্রাক।

ফিরে যেতে আগ্রহী পরিবারগুলোকে প্রথমে নেওয়ার কথা ছিল ঘুমধুম কিংবা টেকনাফের ট্রানজিট ক্যাম্পে। সেখানে প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা সেরে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করার কথা ছিল তাদের। সার্বিক নিরপত্তার জন্য পুলিশ, র‌্যাবসহ আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের রাখা হয়েছিল সতর্ক অবস্থায়।

কিন্তু বিকাল ৪টায় দিনের সাক্ষাৎকার শেষ হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের কেউ মিয়ানমারে ফেরার জন্য গাড়িতে ওঠেননি। এমনকি জোর করে পাঠিয়ে দেওয়ার শঙ্কায় তাদের কেউ কেউ ক্যাম্পের ঘরে তালা দিয়ে দূরে সরে ছিলেন সারাদিন।

এই পরিস্থিতির মধ্যে দুপুরে টেকনাফের শালবাগান এলাকার ২৬ নম্বর ক্যাম্পে আসেন শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মধ্যস্থতায় থাকা চীন দূতাবাসের দুজন এবং মিয়ানমারের একজন প্রতিনিধি এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন।

রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে প্রত্যাবাসন কমিশনার কালাম বলেন, “বাংলাদেশের পক্ষে সব ধরনের প্রস্তুত সম্পন্ন হওয়ার পরও রোহিঙ্গাদের অনাগ্রহের কারণে তাদের মিয়ানমারে পাঠানো শুরু হয়নি। সাক্ষাৎকারে রোহিঙ্গারা বলেছে- তারা দেশে ফিরে যাবেন না।।”

প্রত্যাবাসনের জন্য তালিকায় থাকা ১০৩৭টি পরিবারের মধ্যে ৩৩৯টির একজন করে প্রতিনিধির সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টা পর্যন্ত। তাদের সবাই বলেছেন, শর্ত পূরণ না হলে তারা মিয়ানমারে ফিরতে চান না।

এর আগে গতবছর ১৫ নভেম্বর একইভাবে প্রত্যাবাসন শুরুর সব প্রস্তুতি নিয়ে দিনভর অপেক্ষা করার পরও মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে রোহিঙ্গাদের মনে আস্থা তৈরি না হওয়ায় সেই চেষ্টা ভেস্তে যায়।

এবার চীন ও মিয়ানমারের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে তাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা হলেও দুই বছর ধরে চলা এ সঙ্কট সমাধানের দ্বিতীয় দফা চেষ্টাও দৃশত ব্যর্থ হল।

তবে প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম এখনই একে ‘ব্যর্থ’ বলতে চান না। তিনি বলছেন, তাদের চেষ্টা চলবে।

“সব পরিবারের সাক্ষাৎকার চলবে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। আমাদের বাস-ট্রাকও রেডি থাকবে। কেউ যেতে চাইলে পাঠানো হবে। যতদিন পর্যন্ত সবার সাক্ষাৎকার নেওয়া শেষ হবে না, ততদিন পর্যন্ত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ব্যর্থ কিংবা অনিশ্চিত বলা যাবে না।”

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে মোমেনও হাল ছাড়তে রাজি নন। দুপুরে ঢাকায় নিজের কার্যালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা আশায় বুক বেঁধে আছি। সমস্যা মিয়ানমারের, সমাধানও তাদেরই করতে হবে। আমরা জোর করে কিছু করব না।”

নিজেদের দেশে ফিরে যেতে রোহিঙ্গাদের অনাগ্রহের বিষয়টিকে দুঃখজনক হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, “আমরা চেয়েছি আজ থেকে প্রক্রিয়াটা শুরু হোক। এরপরও আমরা প্রক্রিয়াটা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করব।”

‘ন যাইয়ুম’

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট রাখাইন ছেড়ে বাংলাদেশে আসতে থাকে রোহিঙ্গারা; এই সংখ্যা কিছু দিনের মধ্যে সাত লাখ ছাড়ায়। আগে থেকে বাংলাদেশে অবস্থান করছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা।

তাদের কক্সবাজারের কয়েকটি কেন্দ্রে আশ্রয় দিয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তায় জরুরি মানবিক সহায়তা দিয়ে আসছে বাংলাদেশ সরকার।

আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও নানা কারণে প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত গতবছর ১৫ নভেম্বর প্রত্যাবাসন শুরুর তারিখ ঠিক হলেও নতুন করে নিপীড়নের মধ্যে পড়ার আশঙ্কা থেকে রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানায়।

এরপর দুই সরকারের উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের পাঠানো তালিকা থেকে ৩ হাজার ৪৫০ জনকে রাখাইনের অধিবাসী হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের ফেরত নিতে রাজি হওয়ার কথা জানায় মিয়ানমার।

প্রত্যাবাসনের তারিখ ঠিক হওয়ার পর প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শেষ করে শালবাগান এলাকার ২৬ নম্বর ক্যাম্পে শুরু হয় সাক্ষাৎকার। ইউএনএইচসিআর ও বাংলাদেশ যৌথভাবে এই রোহিঙ্গাদের কাছে জানতে চায়, তারা ফিরতে ইচ্ছুক কি না?

পুরো বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেন মিয়ানমারের দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা ও চীনা দূতাবাসের দুইজন কর্মকর্তা, বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তা এবং জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধিরা।

কিন্তু বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত কেউ স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে রাজি না হওয়ায় সব চেষ্টাই বৃথা যায়।

রাখাইনের মংডু থেকে এসে কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়ে থাকা মোহাম্মদ ইসলাম তার সাক্ষাৎকারের অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, “আমার কাছে জানতে চাইছে, ‘যাবা, না যাবা না বলো’; আমি বলেছি নাগরিকত্ব দেওয়ার আগে কোনোভাবে যাব না। আমাদের ভিটেমাটির অধিকার দিতে হবে, যে ক্ষতি করছে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, নিরাপত্তা দিতে হবে।”

চার শর্ত

প্রত্যাবাসন কমিশনার ও বিদেশি কূটনীতিকরা শালবাগান থেকে চলে যাওয়ার পর টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংবাদ সম্মেলন করেন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতিনিধিরা।

আরকানা রোহিঙ্গা সোসাইটি নামে একটি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ উল্লাহ বলেন, “নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নাগরিকত্ব দেওয়া, জমিজমা ও ভিটেমাটির দখল এবং সেদেশের ক্যাম্পে থাকা লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে তাদের বাসস্থানে ফিরিয়ে দিতে হবে।”

এই চার শর্ত মানলে রোহিঙ্গারা ’আজই’ মিয়ানমারে ফেরত যাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

রোহিঙ্গাদের এসব শর্ত নিয়ে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালামের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন সাংবাদিকরা।

জবাবে তিনি বলেন, “এগুলো মিয়ানমার আর রোহিঙ্গাদের ব্যাপার। আমরা শুধু সীমান্ত পার করে দেব।”

আরেক প্রশ্নের উত্তর তিনি বলেন, “পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়া বা ফিরতে আগ্রহী না হওয়া সাময়িক। আমরা মনে করি আস্তে আস্তে রোহিঙ্গাদের মনোভাব বদল হবে।”

এ সময় চীনের প্রতিনিধি ঝেং তিয়ানঝু বলেন, ”প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনায় মধ্যস্থতার দায়িত্ব নিয়েছে চীন। আর এই প্রক্রিয়া আমরা দেখভাল করছি।”

তবে রোহিঙ্গারা কেন নিজ দেশে ফিরতে চাইছে না কিংবা মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ফেরার পরিবেশ তৈরি হয়েছে কি না- এসব বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি এই চীনা কূটনীতিক।

ঢাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে মোমেনকেও রোহিঙ্গাদের দাবির বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলেন সাংবাদিকরা্। জবাবে তিনি বলেন, “আমরা তাদের দাবির কাছে জিম্মি হতে পারি না।

‘ফেরাতে হবে আস্থা’

রোহিঙ্গারা যাতে স্বেচ্ছায়, মর্যাদার সঙ্গে রাখাইনে তাদের ভিটেমাটিতে ফিরতে পারে, সেখানে যাতে তাদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়- সেজন্য মিয়ানমার সরকারকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা দিচ্ছে জাতিসংঘের দুই সংস্থা ইউএনডিপি ও ইউএনএইচসিআর। 

প্রত্যাবাসন শুরুর দ্বিতীয় চেষ্টাও ঝুলে যাওয়ার পর এক বিবৃতিতে ইউএনএইচসিআর বলেছে, রাখাইনের যেসব জায়গা থেকে রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে এবং ফিরে যাওয়ার পর যেখানে তাদের রাখা হবে- প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে সেসব জায়গায় জাতিসংঘের এই দুই সংস্থার প্রতিনিধিদের যাতায়াতের সুযোগ দেওয়াটা জরুরি।  

২০১৭ সালে রাখাইনে দমন-পীড়ন শুরুর পর থেকেই ওই এলাকায় আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছিল মিয়ানমার। আন্তর্জাতিক চাপে গতবছর তা কিছুটা শিথিল করা হলেও এখনও সেখানে যাওয়া আসার সুযোগ উন্মুক্ত করা হয়নি।

ইউএনএইচসিআর বলছে, রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে হলে তাদের মধ্যে সবার আগে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। আর সেটা সম্ভব একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, এককালীন কোনো বিষয় এটা নয়।

বিবৃতিতে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের মধ্যে কারা ফিরে যেতে আগ্রহী তাদের খুঁজে বের করতে ইউএনএইচসিআর বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতা দিচ্ছে। আর ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা যেন পুরোপুরি স্বেচ্ছামূলক হয়, তা নিশ্চিত করতে ইউএনএইচসিআর কাজ করছে।

“এখন পর্যন্ত যাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে কেউ এই মুহূর্তে ফিরে যাওয়ার আগ্রহ দেখাননি। যাদের নাম তালিকায় আছে, তাদের সবার সাক্ষাৎকার যাতে নেওয়া হয়, সেজন্য ইউএনএইচসিআর বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতা করে যাবে।”

তবে রোহিঙ্গাদের দাবির বিষয়গুলো ইউএনএইচসিআরের বিবৃতিতেও এসেছে।

“রোহিঙ্গাদের অনেকেই বলেছে, যখনই পরিবেশ তৈরি হবে, তখনই তারা মিয়ানমারে তাদের ভিটামাটিতে ফিরে যেতে চায়। সেজন্য তারা নাগরিকত্ব, চলাফেরার স্বাধীনতা আর নিরাপত্তা চায়।”