আইনজীবী পলাশ নিজের গায়ে নিজেই আগুন দেন: বিচারিক প্রতিবেদন

পঞ্চগড়ে কারা হেফাজতে থাকা অবস্থায় আইনজীবী পলাশ কুমার রায়ের অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনায় হত্যাকাণ্ডের কোনো আলামত পায়নি বিচার বিভাগীয় তদন্ত দল।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 August 2019, 03:30 PM
Updated : 21 August 2019, 04:00 PM

তাদের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পলাশ রায় নিজেই গায়ে আগুন দিয়েছিলেন বলে তথ্য প্রমাণ মিলেছে।

পঞ্চগড়ে কারা হেফাজতে থাকা অবস্থায় আইনজীবী পলাশ রায়ের অগ্নিদগ্ধ হওয়া এবং পরে হাসপাতালে তার মৃত্যুর ঘটনায় একটি রিট আবেদনে গত ৮ মে বিচারিক অনুসন্ধানের নির্দেশ দিয়েছিল হাই কোর্ট।

পঞ্চগড়ের মুখ্য বিচারিক হাকিম জেলার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম কামরুল হাসানকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেন।

কামরুল হাসানের সে অনুসন্ধান প্রতিবেদনটিই বুধবার বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. বদরুজ্জামানের হাই কোর্ট বেঞ্চে উপস্থাপন এবং তার উপর শুনানি হয়।

আদালতে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার প্রতিবেদনটি দাখিল করেন। আর রিট আবেদনকারী আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন প্রতিবেদনের কিছু অংশ পড়ে শোনান। 

শুনানি শেষে আদালত এই অনুসন্ধান প্রতিবেদনের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র সচিব ও কারা মহাপরিদর্শকের লিখিত ব্যাখ্যা চেয়ে আগামী ১৫ অক্টোবর পরবর্তী শুনানির তারিখ রেখেছে।

এই অনুসন্ধান প্রতিবেদনের অনুলিপি স্বরাষ্ট্র সচিব ও কারা মহাপরিদর্শকের কাছে পাঠানোর নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।

পলাশ রায়ের ঘটনাটি আত্মহত্যা উল্লেখ করলেও পঞ্চগড় জেলা কারাগারে বন্দিদের নিরাপত্তা ও বন্দিদের ব্যবস্থাপনার কিছু ত্রুটি উঠে এসেছে বিচার বিভাগীয় তদন্তে।

পলাশ রায় ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য হিসেবে ঢাকা জজ কোর্টে প্র্যাকটিস করা অবস্থায় ২০১৩ সালে কোহিনুর কেমিকেলসে আইন কর্মকর্তা হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালে তিনি সেই কোম্পানির সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়লে তার বিরুদ্ধে একটি অর্থ আত্মসাতের মামলা হয়। এ মামলা থেকে বাঁচতে তিনি গত ২৫ মার্চ পঞ্চগড় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে তার অনুসারীদের নিয়ে একটি মানববন্ধন করেন এবং জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেন।

এরপর ওইদিন বেলা আড়াইটার দিকে পলাশ তার সঙ্গীদের নিয়ে পঞ্চগড় চৌরঙ্গী মোড়ে সমাবেশ করেন। সেখানে তিনি কোহিনুর কেমিকেলের করা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানানোর পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে অপমানজনক কথাবার্তা এবং জেলা প্রশাসকের বাসভবনের সামনে পরিবার নিয়ে আত্মহত্যার হুমকি দিয়েছিলেন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

এই ঘটনায় মো. রাজিব রানা নামের একজন পঞ্চগড় সদর থানায় মামলা করলে গত ২৬ মার্চ এ মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে পঞ্চগড় কারাগারে যেতে হয় পলাশকে।

কারাগারে যাওয়ার পর পলাশ গত ৩ এপ্রিল কারা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত সেখানে ছিলেন। এরপর তাকে কারা ওয়ার্ডে ফেরত পাঠানো হলেও শারীরিক সমস্যার কারণে ১৫ এপ্রিল আবার তাকে হাসপাতালে আনা হয়। অগ্নিকাণ্ডের দিন অর্থাৎ ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন।

২৬ এপ্রিল কারা হাসপাতালে অগ্নিদগ্ধ হওয়ার পর পলাশকে নেওয়া হয় পঞ্চগড় সদর হাসপাতালে, সেখান থেকে রংপুর হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনার পর ৩০ এপ্রিল তার মৃত্যু ঘটে।

নিজের গায়েই আগুন

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘটনার দিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে পলাশকে ওয়ার্ড থেকে বের হয়ে বাথরুমে যেতে দেখেন কারারক্ষী ইকবাল হোসেন। ৩/৪ মিনিট পর পলাশকে ‘আগুন-আগুন’ বলে বেরিয়ে আসতে দেখেন তিনি।

ইকবালের বর্ণনায় পলাশ তখন দুই হাত দিয়ে দুই পা থাপড়াচ্ছিলেন এবং ইকবালের সামনে দিয়ে দৌড়ে ভবনের বাইরে গিয়ে লাফাতে থাকেন। এসময় তার ট্রাউজারে আগুন জ্বলছিল।

ইকবাল পলাশের গায়ের কাপড় ছেঁড়ার চেষ্টা করলেও আগুন বেড়ে যায়। এর মধ্যে অন্য কারারক্ষীরা এসে আগুন নেভান। পরে কারাগারের গাড়িতে করে পলাশকে পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

কারা হাসপাতালের সেই বাথরুমে একটি গ্যাস লাইট আর এক জোড়া স্যান্ডেল পাওয়া যায় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এতে বলা হয়, কারারক্ষী ইকবালের বক্তব্যের সঙ্গে অন্য কারারক্ষী ও কারা কর্মকর্তাদের বক্তব্যের মিল রয়েছে।

কারাগারের ক্যান্টিনে পলাশ রায়ের নামে পি সি বইয়ে (কারাবন্দিদের জমানো অর্থ থেকে খরচের হিসাব লেখার বই) গত ২৬ এপ্রিল ১৫ টাকা মূল্যের গ্যাসলাইট কেনার প্রমাণ পেয়েছে তদন্তকারীরা; ক্যান্টিন পরিচালক মো. মুন্না আসামি পলাশের কাছে তা বিক্রি করেছিলেন।

সাক্ষীদের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, হাসপাতালের জরুরি বিভাগে থাকা অবস্থায়ও পলাশের জ্ঞান ছিল। তখন তিনি তার উপর আক্রমণ হয়েছে বা কেউ তার গায়ে আগুন দিয়েছে, সে কথা তিনি কাউকে বলেননি।

পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালের চিকিৎসক মো. আকরামুল হকের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পলাশের শরীরের প্রায় ৪০ শাতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। বেশি পুড়েছিল কোমর থেকে নিচের অংশ। তবে তা কোনো রাসায়নিকের কারণে হয়নি।

পলাশের স্ত্রীর বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পারিবারিক কারণে পলাশের মানসিক বিষাদগ্রস্ততা, কোহিনুর কেমিকেল কোম্পানির ৩১ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলায় হয়রানির শিকার হওয়া এবং সর্বশেষ মামলায় জড়িয়ে পরার কারণে পলাশ মানসিকভাবে অস্বাভাবিক ছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়।

কারাগারে পলাশের সহবন্দি ইদ্রিস অনুসন্ধানকারী হাকিমকে বলেছেন, “আমি যা শুনেছি ও দেখেছি, তাতে পলাশ ভাই নিজেই নিজের গায়ে আগুন দেয়। তাকে পুলিশ স্কটে পায়ে বেড়ি দিয়ে নিয়ে যাবে- এজন্য সম্ভবত নিজেই ছোটোখাটো অ্যাক্সিডেন্ট দেখাতে চেয়েছিল। পরে মনে হয় কন্ট্রোল করতে পারেনি।”

সাক্ষীদের জবানবন্দি ও প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “বন্দি পলাশের অগ্নিদগ্ধ হওয়ার ঘটনাটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে বিশ্বাস করার কোনো কারণ পরিলক্ষিত না।

“তাছাড়া পরিবারের পক্ষ থেকে পত্র-পত্রিকা বা বিভিন্ন মিডিয়াতে হত্যাকাণ্ডের মৌখিক দাবি করলেও হত্যার অভিযোগ এনে এখন পর্যন্ত কোনো মামলা দায়ের করা হয়নি। মামলা দায়ের না করার কারণ যাই হোক না কেন, পলাশ রায়ের অগ্নিদগ্ধ হওয়ার ঘটনটি কোনো পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড নয় বলে বিশ্বাস করা যুক্তিযুক্ত।”

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কারাগারে কোনো বন্দি অসুস্থ হলে কিংবা আহত হলে তাকে দ্রুততম সময়ে উপযুক্ত চিকিৎসা দেওয়ার সম্পূর্ণ দায়িত্ব কারা কর্তৃপক্ষের। এক্ষেত্রে এক কারাগার থেকে অন্য কারাগারে বন্দি প্রেরণের আনুষ্ঠানিকতার চেয়ে চিকিৎসার বিষয়টি সবার আগে বিবেচনা করা দরকার।

পঞ্চগড় থেকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠালেও সেখানে তার চিকিৎসায় বিলম্বের বিষয়টি তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, রংপুরে নিয়ে পলাশকে প্রথমে ফেলে রাখা হয়। জেলারকে বলার পর হাসপাতালে নেওয়া হয়।

পলাশের অগ্নিদগ্ধের খবর পরিবারকে না জানানোর বিষয়টি নিয়ে তদন্তকারী বিচারক বলেন, কারা হেফাজতে কোনো বন্দি গুরুতর অসুস্থ হলে বা মৃত্যু হলে বা অন্য কারাগারে স্থানান্তর করা হলে অবশ্যই বন্দির পরিারকে দ্রুত জানাতে হবে।

ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি

প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ’ এই বার্তাকে মূলমন্ত্র হিসেবে ধারণ করে বাংলাদেশ কারা অধিদপ্তর এগিয়ে চলেছে। তবুও কারা ব্যবস্থাপনায় বেশ কিছু ত্রুটি এবং অপর্যাপ্ততা চোখে পড়ার মতো।

>> কারা অভ্যন্তরে ধূমপানের সরঞ্জাম এবং অগ্নি প্রজ্জ্বলন নিষিদ্ধ হলেও পঞ্চগড় কারা অভ্যন্তরে বন্দি ও ক্যান্টিনে অবাধে সেসবের বিক্রি চলত। এটি বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি।

>> পঞ্চগড় জেলা কারাগারে অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা না থাকায় বন্দিরা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

>> কারা বন্দিদের খাদ্য ও অন্যান্য দ্রব্য সামগ্রী কারাগারের ভেতরে ঢোকানোর ক্ষেত্রে তল্লাশি পর্যাপ্ত নয়।

>> ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ব্যবহার বর্তমানে একটি স্বাভাবিক এবং অপরিহার্য বিষয় হলেও পঞ্চগড় কারাগারের ভেতরে কোথাও কোনো সিসি ক্যামেরা নাই।

>> পঞ্চগড় কারাগারে নিয়মিত কোনো জেল সুপার ও জেলার নাই। জেলকোড অনুযায়ী এই দুটি পদে নিয়মিত কর্মকর্তা থাকা অপরিহার্য।

>> বিপজ্জনক, বিরক্তিকর, নোংরা, পাগল বন্দিদের পৃথক সেলে রাখার বিধান থাকলেও সেগুলো খালি ছিল এবং মানসিক ভারসাম্যহীন এক বন্দিকে দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালের নিচতলায় একটি ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে।

>> পঞ্চগড় জেলা কারাগারে নিয়মিত কোনো মেডিকেল অফিসার নাই এবং সে কারণে পলাশ কুমার রায়ের মতো অন্য কোনো বন্দির মানসিক সুস্থতা পর্যবেক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নাই।

>> পঞ্চগড় জেলা কারা হাসপাতালের জন্য একজন ডিপ্লোমা নার্স ছাড়া আর কোনো জনবল নাই।

>>পঞ্চগড় জেলা কারাগার থেকে ডাক্তারি পরীক্ষা ছাড়াই প্রতিনিয়ত বন্দি স্থানান্তর করা হয়ে আসছে। অথচ স্থানান্তরের সময় স্বাস্থ্য পরীকক্ষার কথা জেলকোডের ২৬ ধারায় বলা আছে।

>> জেলকোডের ৫৪৯ ও ৫৫০ বিধি অনুযায়ী প্রত্যেক কারাবন্দির (হিস্টি) বৃত্তান্ত থাকা বাধ্যতামূলক হলেও পলাশ কুমার রায়ের হিস্ট্রি টিকিট কারা কর্তৃপক্ষ খুঁজে পায়নি।