ঘরে বাইরে এনআইডি ‘জালিয়াত চক্রের’ খোঁজে ইসি

জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভাণ্ডারের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় জালিয়াতির কয়েকটি ঘটনা গোচরে আসার পর নড়েচড়ে বসেছে নির্বাচন কমিশন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 August 2019, 10:40 AM
Updated : 21 August 2019, 12:24 PM

সর্বশেষ চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে এক রোহিঙ্গা নারীর জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি এবং তার তথ্য নির্বাচন কমিশনের তথ্যভাণ্ডারে সংরক্ষিত থাকার বিষয়টি প্রকাশ পায়। 

এর আগে বরিশাল অঞ্চলের এক ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের আবেদন নির্বাচন কমিশন বাতিল করে দেওয়ার পরও আবেদনটি কে বা কারা সংশোধন করে দেয়। এছাড়া নোয়াখালী এলাকার একজন ভোটারের নিবন্ধন ফরমে ঠিকানা, বাবা-মায়ের এনআইডি নম্বর, ভোটার শনাক্তকারী ও সুপারভাইজারের স্বাক্ষর না থাকার পরও তিনি ভোটার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন।

জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের পরিচালক (অপারেশন্স) ইসির যুগ্মসচিব আব্দুল বাতেন কমিশনের কঠোর নির্দেশনা থাকার পরও এনআইডি জালিয়াতির ঘটনার বিষয়টি স্বীকার করেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “কোথাও কোথাও প্রয়োজনীয় দলিলাদি নিয়ে রোহিঙ্গাদের স্থানীয় লোকজন বা কারও সহায়তায় ভোটার হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। এছাড়া তথ্য সংশোধন ও নানা ধরনের জালিয়াতির তথ্য মিলছে।”

এসব জালিয়াতি রোধে কমিশনের পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “অসাধু চক্রের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের অবস্থান কঠোর। তাদের কারা সহায়তা করছে তা খুঁজে বের করা হবে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের হাটহাজারির ঘটনা তদন্তের জন্য বলা হয়েছে। ঘরে-বাইরে কারা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত তা দেখব আমরা; দায়ীদের কোনো ছাড় নয়।”

হাটহাজারির ঘটনায় রোহিঙ্গা নারীর নিবন্ধন ফরম থেকে তথ্যভাণ্ডারে তার নাম অন্তর্ভুক্ত পর্যন্ত কাজ কিভাবে হয়েছে তা খতিয় দেখা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের তথ্যভাণ্ডারে ১০ কোটি ৪২ লাখের বেশি ভোটারের তথ্য রয়েছে। আর ১১ লাখের মতো রোহিঙ্গার আলাদা তথ্যভাণ্ডার রয়েছে।

আব্দুল বাতেন বলেন, “নির্ধারিত কতগুলো ধাপ পার হওয়ার পর নতুন নিবন্ধিত ভোটারের তথ্য, আঙ্গুলের ছাপ ও চোখের আইরিশ দেওয়ার পর তা ইসির তথ্যভাণ্ডারে চেক করা হয়; রোহিঙ্গা কীনা তাও যাচাই করা হয় কারিগরি প্রযুক্তির সহায়তায়। এরপর রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকার ভোটার হলে তাকে আরও বেশি কিছু দলিল ও যাচাই বাছাইয়ের মধ্যে যেতে হয়।

“এতকিছুর পরও কোনো রোহিঙ্গা ভোটার হতে পারার কথা নয়। সেক্ষেত্রে অসাধু স্থানীয় লোকজন ও নিবন্ধনে যুক্ত কেউ সহায়তা করতে পারে। আমরা তাদেরকে খুঁজে বের করব এবার। পুরো কারিগরি বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে একটি দক্ষ দলও কাজ করবে। কে, কখন, কোন কম্পিউটারে কাজ করেছে তাও জানা যাবে।”

বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারের তথ্য সংগ্রহ করা অথবা উপজেলা নির্বাচন অফিসে ভোটার তথ্য ফরম পূরণ নিবন্ধনের প্রাথমিক কাজ। এ পর্যায়ে নির্ধারিত ফরমে প্রায় ৪৪টি তথ্য দিতে হয়। এর মধ্যে বাবা-মায়ের তথ্যের পাশাপাশি অন্তত ২০টি তথ্য আবশ্যিক।

নিবন্ধন ফরমটিতে তথ্য সংগ্রহকারী, ভোটার শনাক্তকারী ও সুপারভাইজারের স্বাক্ষর থাকতে হয়। ফরমটি তথ্য সংগ্রহকারী, সুপারভাইজার, ডাটাএন্ট্রি অপারেটর, প্রুফরিডার, টিকনিক্যাল এক্সপার্ট দেখার পর রেজিস্ট্রেশন অফিসার দেখেন।

নিবন্ধনের এ কাজের জন্য এ ছয়জন নির্ধারিত  ভাতাও পেয়ে থাকেন।

এরপর প্রয়োজনীয় তথ্য ডেটাবেইজে এএফআইএস ম্যাচিং করা হয় এবং ডেটা আপলোড করা হয়।

ইসির পরিচালক আব্দুল বাতেন বলেন, “ওটিপির (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) মাধ্যমে ভোটারের তথ্য নিয়ে ডেটাবেইজে কাজ করতে এবং এনআইডি প্রিন্ট করতে পারেন ইসির নির্ধারিত কর্মকর্তা ও কারিগরি সহায়তা দেওয়া এডমিনরা ।

“কোথায়, কে, কী কাজ করেছে তা নির্ধারিত সফটওয়্যারে সংরক্ষিত থাকে। কোনোভাবে অননুমোদিত কারও ডেটাবেইজের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কাজ করার সুযোগ নেই।”

তিনি বলেন, “ইসির তথ্যভাণ্ডার নির্ভুল ও বিশ্বমানের। এ ডেটাবেইজে ঢুকে অননুমোদিত কেউ তথ্য-উপাত্ত সংশোধন, সংযোজন করছে- এমন কথা সঠিক নয়। শুধুমাত্র এডমিনরাই তা পারবে। সুনির্দিষ্ট করে না বললে আমরা কাউকে দায়ী করতে পারবে না। দেশের এ সম্পদের ভাবমূর্তি যেন ক্ষুন্ন না হয় সে দিকেও নজর রাখতে হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্বাচন কমিশনের এনআইডি উইংয়ে একজন কর্মকর্তার নাম ব্যবহার করে ওটিপি দিয়ে অর্ধশতাধিক পরিচয়পত্র সংশোধনের অভিযোগের তদন্ত চলছে।

জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব পর্যায়ের ওই কর্মকর্তা, নাকি অন্য কেউ এ কাজ করেছে, তা বের করতে ছয় মাসের বেশি সময় ধরে তদন্ত চললেও কোনো প্রতিবেদন এখনও চূড়ান্ত হয়নি।

হাটহাজারির জালিয়াতির বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের জ্যেষ্ঠ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মুনির হোসাইন খান।

“আমরা এখন খুবই তৎপর অসাধু চক্রকে ধরতে। হাটহাজারিতে ওই নারীর মতো আরও কারা ভোটার রয়েছে; এ ধরনের জালিয়াতিতে কারা সম্পৃক্ত হতে পারে, তা শনাক্তে কী ধরনের কারিগরি বিষয় রয়েছে- তা নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন নির্বাচন কমিশনে পাঠাব । পুরো বিষয়টি বেশ টেকনিক্যাল; এ জন্যে আগাম কিছু বলতে চাই না।”

তিনি জানান, পুলিশের পাশাপাশি উপজেলা পর্যায়ে ইসির নিজস্ব একটি তদন্ত কমিটি কাজ করবে। দুই-একদিনের মধ্যে তারা কাজ শুরু করবে।

কমিশনকে উপেক্ষা করে এনআইডি সংশোধন

এদিকে নির্বাচন কমিশন বাতিল করার পর বরিশালের একজন ভোটারের আবেদন সংশোধন করার ঘটনায় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার শাহাদাত হোসেন চৌধুরী।

সেই সঙ্গে এনআইডি সেবা দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মাঠ কর্মকর্তাদেরও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।