২১ অগাস্ট মামলা: পেপারবুকে আটকে আপিলের শুনানি

একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের জন্য পেপারবুক তৈরি হলে ‘দ্রুত’ শুনানির জন্য আবেদন করবে রাষ্ট্রপক্ষ।

নিজস্ব প্রতিবেদকমেহেদী হাসান পিয়াসবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 August 2019, 05:27 PM
Updated : 21 August 2019, 07:20 AM

এ হামলার ১৫ বছর পূর্তির আগের দিন মঙ্গলবার নিজ দপ্তরে সংবাদ সম্মেলন করে একথা বলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

তিনি বলেন, “পেপারবুক তৈরি হওয়ার পরেই আমরা তাড়াতাড়ি শুনানির জন্য একটা পদক্ষেপ নেব।”

সেক্ষেত্রে কবে নাগাদ আপিলের শুনানি শুরু হতে পারে- এই প্রশ্নে মাহবুবে আলম বলেন, “এই মুহূর্তে নির্দিষ্ট করে সময় বলে দেওয়া সম্ভব না কবে শুনানি হবে। পেপারবুক তৈরি হয়ে গেলে আমি পদক্ষেপ নেব।”

বহুল আলোচিত এই মামলায় গত বছরের ১০ অক্টোবর দেওয়া রায়ে ৪৯ আসামির মধ্যে ১৯ জনের ফাঁসি, ১৯ জনের যাবজ্জীবন, ১১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়। আসামিদের মধ্যে ১৬ জন রয়েছেন পলাতক।

১০ মাস গড়াতে চললেও পেপারবুক তৈরি না হওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “পেপারবুক তৈরির কোনো নিয়ম নাই যে, আমরা তাগাদা দিতে পারি। পেপারবুক তৈরি হলেই কেবল আমরা শুনানির জন্য আদালতের কাছে প্রার্থনা করতে পারি।”

ফৌজদারি মামলায় বিচারিক আদালত যখন আসামিদের মৃত্যুদণ্ড দেয় তখন ওই দণ্ড কার্যকরের জন্য হাই কোর্টের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। এজন্য সংশ্লিষ্ট বিচারিক আদালত ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৪ ধারা অনুযায়ী মামলার সকল নথি হাই কোর্টে পাঠিয়ে দেয়, যা ‘ডেথ রেফারেন্স’ নামে পরিচিত।

ওই নথি আসার পর হাই কোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সংশ্লিষ্ট মামলার পেপারবুক প্রস্তুত করে। পেপারবুক প্রস্তুত হলে মামলাটি শুনানির জন্য প্রস্তুত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য আবেদন) অনুমোদনের জন্য গত বছরের ২৭ নভেম্বর এ নথি হাই কোর্টে পাঠানো হয়।

পেপারবুক তৈরির বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগের বিশেষ কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একজন ডেপুটি রেজিস্ট্রারের তত্ত্বাবধানে দুইজন মুদ্রাক্ষরিক পেপারবুক তৈরির কাজ করছেন।”

পেপারবুক তৈরি হতে কত সময় লাগতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এটা বলা যাচ্ছে না।”

বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কারাবন্দি দণ্ডপ্রাপ্তরা জেল আপিলও করেছেন।

তবে কারও সাজা বাড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আপিল হয়নি বলে জানান অ্যাটর্নি জেনারেল।

তিনি বলেন, “যাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে, ষড়যন্ত্রের সাথে যারা জড়িত, তাদের ব্যাপারে কোনোরূপ আপিল আমরা করিনি। এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনাও আসেনি, আমাদের অফিস (অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়) কোনো আপিল করেনি।”

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাজা বাড়ানোর দাবি রয়েছে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম (ফাইল ছবি)

এ বিষয়ে মাহবুবে আলম বলেন, “একটা হত্যাকাণ্ডের মামলায় সব আসামির একই রকম সাজা নাও হতে পারে। কাজেই আদালত কোন যুক্তিতে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়নি, সেটা না দেখে বলা সম্ভব না।”

২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে দলটিকে ‘নেতৃত্বশূন্য’ করার চেষ্টার ঘটনায় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, তৎকালীন উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয় বিচারিক আদালত।

রায়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

এছাড়া এ মামলার আসামি ১১ পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- লুৎফুজ্জামান বাবর, আব্দুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, হুজির সাবেক আমির ও ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টির আহ্বায়ক মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, কাশ্মীরি জঙ্গি আব্দুল মাজেদ ভাট, আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোস্তফা, মাওলানা শওকত ওসমান, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডা. জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, হোসাইন আহম্মেদ তামিম, মঈন উদ্দিন শেখ ওরফে মুফতি মঈন, মো. রফিকুল ইসলাম, মো. উজ্জল, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম, হানিফ পরিবহনের মালিক বিএনপি নেতা মোহাম্মদ হানিফ।

তারেক রহমান

যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, বিএনপি নেতা কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, হুজি সদস্য হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, শাহাদাৎ উল্লাহ ওরফে জুয়েল, মাওলানা আবদুর রউফ, মাওলানা সাব্বির আহমেদ, আরিফ হাসান ওরফে সুমন, আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম মাওলাদার, মো. আরিফুল ইসলাম, মহিবুল মুত্তাকিন ওরফে মুত্তাকিন, আনিসুল মুরছালিন ওরফে মুরছালিন, মো. খলিল ওরফে খলিলুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম বদর, মো. ইকবাল ওরফে ইকবাল হোসেন, লিটন ওরফে মাওলানা লিটন, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আব্দুল হাই, রাতুল আহমেদ ওরফে রাতুল বাবু।

এছাড়া পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) মো. আশরাফুল হুদা ও শহিদুল হক, বিএনপি চেয়ারপারসন ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার, ডিজিএফআইয়ের মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আমিন, ডিএমপির সাবেক উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) খান সাঈদ হাসান, আরেক সাবেক উপ-কমিশনার (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান খান, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক খোদা বক্স চৌধুরী, সিআইডির সাবেক বিশেষ সুপার মো. রুহুল আমিন, সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ, সাবেক এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমানকে দুই বছর করে কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

আরেকটি ধারায় খোদা বক্স চৌধুরী, রুহুল আমিন, আবদুর রশিদ ও মুন্সি আতিকুর রহমানকে তিন বছর করে কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে কারাদণ্ড দেয় আদালত।

চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি এ মামলায় দুই বছরের সাজাপ্রাপ্ত সাবেক দুই পুলিশ প্রধানের জামিন হয় হাই কোর্টে।

সেদিন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আলী জিন্নাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “সাবেক দুই আইজিপি শহুদুল হক ও আশরাফুল হুদার ২ বছরের সাজার মধ্যে ১৪ মাস সাজা খেটে ফেলেছেন। এই যুক্তিতে তাদের ছয় মাসের জামিন দিয়েছেন আদালত।”

মামলা বৃত্তান্ত

হামলার পরদিন মতিঝিল থানার তৎকালীন এসআই শরীফ ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। থানা পুলিশ, ডিবির হাত ঘুরে সিআইডি এই মামলার তদন্তভার পায়।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিতের চেষ্টার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে জঙ্গিনেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করে মামলার অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি।

২০০৮ সালের ১১ জুন হত্যার অভিযোগ এবং বিস্ফোরক আইনে আলাদা দুটি অভিযোগপত্র দেন সিআইডির জ্যেষ্ঠ এএসপি ফজলুল কবির।

জঙ্গি দল হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ ২২ জনকে সেখানে আসামি করা হয়। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ২০০৮ সালের ২৯ অক্টোবর অভিযোগ গঠন করে তাদের বিচারও শুরু হয়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপক্ষ মামলাটির অধিকতর তদন্তের আবেদন করলে ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করে।

সিআইডির বিশেষ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ অধিকতর তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ৩ জুলাই আসামির তালিকায় আরও ৩০ জনকে যোগ করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন।

গ্রেনেড হামলায় রক্তাক্ত নেতা-কর্মীরা; এদের অনেকের জীবনে ফেরা হয়নি

সেখানে খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানসহ চার দলীয় জোট সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ও বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের নাম আসে।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে এ মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল বলে অধিকতর তদন্তে উঠে আসে। জানা যায়, হামলার বিষয়ে নোয়াখালীর জজ মিয়ার ‘স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি’ দেওয়ার বিষয়টি ছিল নাটক।

সম্পূরক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএনপি-জামায়াত জোট হামলার পর থেকেই তদন্ত বাধাগ্রস্ত করতে কাজ শুরু করে। হামলার অনেক আলামত সে সময় নষ্ট করে ফেলা হয়।

২০১২ সালের ১৮ মার্চ সম্পূরক অভিযোগপত্রের আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আদালত। নতুন করে শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ। রাষ্ট্রপক্ষের ৫১১ সাক্ষীর মধ্যে মোট ২২৫ জন এ মামলায় আদালতে সাক্ষ্য দেন।

রাজধানীর নাজিমউদ্দিন রোডে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে স্থাপিত ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিশেষ এজলাসে ১২০ কার্যদিবস যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে মামলা দুটি রায়ের পর্যায়ে আসে।

এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আবদুল্লাহ আবু জানান, দণ্ডবিধি ও বিস্ফোরক আইনের দুই মামলার বিচার কাজ একই সঙ্গে চলে। সব মিলিয়ে মোট ১ হাজার ৪৫৪ কার্যদিবস আদালত বসেছে এ মামলা শোনার জন্য।