আসামির ‘দোষ স্বীকার’ নিয়ে পুলিশের সংবাদ সম্মেলন, আদালতের উষ্মা

হাকিমের সামনে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার আগেই ‘আসামি দোষ স্বীকার করেছে’ দাবি করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংবাদ সম্মেলন এবং আসামিকে নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংবাদ সম্মেলন নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 August 2019, 04:05 PM
Updated : 20 August 2019, 05:43 PM

হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ বলেছে, এ বিষয়গুলো ভেবে দেখার সময় এসেছে। এজন্য একটি নীতিমালা থাকা দরকার।

মঙ্গলবার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিুজর রহমানের হাই কোর্ট বেঞ্চে বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় তার স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির জামিন শুনানিতে এ প্রসঙ্গ আসে।

বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক এম ইনায়েতুর রহিম বলেন, “শুধু এ মামলা (রিফাত শরিফ হত্যা মামলা) না, আরও অনেক মামলায় দেখেছি, আসামিকে মিডিয়া সেন্টারে নিয়ে প্রেস ব্রিফিং করা হয়। মামলার তদন্ত পর্যায়ে আইন শঙ্খলাবাহিনী সংবাদ সম্মেলন করে বলছে যে আসামি দোষ স্বীকার করেছে। এভাবে কতটুকু বলার সুযোগ আছে? এর কী অর্থ দাঁড়ায়?”

মামলার তদন্ত পর্যায়ে এ ধরনের বক্তব্য দেওয়া যে যুক্তিসংগত নয়- সে বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “এতে জনগণের মধ্যে কী ধারণা সৃষ্টি হয়? একজন পুলিশ কর্মকর্তা যদি বলেন আসামি দোষ স্বীকার করেছে তাহলে কি অধস্তন পুলিশের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় না আসামির সেই জবানবন্দি স্বীকার করানো?”

গত ২৬ জুন রিফাতকে বরগুনার রাস্তায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সে সময় স্বামীকে বাঁচাতে মিন্নির চেষ্টার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশে আলোচনার সৃষ্টি হয়।

পরদিন রিফাত শরীফের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ ১২ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন; তাতে প্রধান সাক্ষী করা হয়েছিল মিন্নিকে।

পরে মিন্নির শ্বশুর তার ছেলেকে হত্যায় পুত্রবধূর জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে সংবাদ সম্মেলন করলে ঘটনা নতুন দিকে মোড় নেয়।

গত ১৬ জুলাই মিন্নিকে বরগুনার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে দিনভর জিজ্ঞাসাবাদের পর এ মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

পরদিন আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তাকে পাঁচদিনের রিমান্ডে পাঠান। রিমান্ডের তৃতীয় দিন শেষে মিন্নিকে আদালতে হাজির করা হলে সেখানে তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন বলে পুলিশ জানায়।

তার আগের দিনই পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, “মিন্নি হত্যাকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা এবং হত্যা পরিকল্পনাকারীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। মিন্নিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই হত্যা পরিকল্পনার সঙ্গে মিন্নির যুক্ত থাকার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ।”

বরগুনা সরকারি কলেজের স্নাতকের এই ছাত্রী পরে জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন করেন জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে।

বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম বলেন, “এ মামলায় (রিফাত শরিফ হত্যা মামলা) এসপি সাহেব সংবাদ সম্মেলন ডেকে কি করে বললেন যে মিন্নি দোষ স্বীকার করেছে? এসপি বলার পর তদন্ত কর্মকর্তার কি দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় না সে দোষ যথাযথভাবে প্রমাণ করার? এরকম হলে মামলার তদন্ত প্রভাবিত হতে পারে। জনগণের মধ্যে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হয়। তাই এগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার সময় এসেছে। এ জন্য একটি নীতিমালা থাকা দরকার।”

এর আগেও হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ মামলার আসামি বা সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তারদের আইনশঙ্খলা বাহিনীর সংবাদ সম্মেলনে হাজির না করার নির্দেশ দিয়েছিল।

সে বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়ে এই বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক বলেন, “এখনও দেখছি, আসামিদের জ্যাকেট পরিয়ে মিডিয়ার সামনে হাজির করা হচ্ছে। এ ধরনের দৃষ্টান্ত দুনিয়ার আর কোথাও আছে কিনা আমার জানা নাই। এর একটা সুরাহা হওয়া দরকার।”

মঙ্গলবার মিন্নির জামিনের পক্ষে শুনানি করেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিনউদ্দিন, জেড আই খান পান্না ও মাক্কিয়া ফাতেমা ইসলাম।

রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারোয়ার হোসেন বাপ্পী ও সহকারি অ্যাটর্নি জেনারেল শাহানা পারভীন।

শুনানিতে আইনজীবী আমিনউদ্দিন বলেন, মিন্নিকে সাক্ষী হিসেবে তার বক্তব্য জানতে পুলিশ গত ১৬ জুলাই সকাল পৌনে ১০টায় পুলিশ লাইনসে ডেকে নেয়। এরপর রাত ১০টার দিকে তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

“১৯ বছরের একটি মেয়েকে পুলিশ লাইনসে নিয়ে আটকে রেখে জিজ্ঞাসাবাদের পরিণতি কী হতে পারে তা সবাই উপলব্ধি করতে পারে। তার ওপর কতটা চাপ ছিল তা বোঝা যায়।”

এ আইনজীবী বলেন, এ মামলার আরেক আসামিকে গত ১ জুলাই গ্রেপ্তারের পর ১৪ জুলাই জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সময়ের একটি বড় ব্যবধান রয়েছে।

“টানা রিমান্ডে থাকার পর কী জবানবন্দি আসতে পারি সে ধারণা আমরা করতে পারি।”

আইনজীবী আমিনউদ্দিন বলেন, মিন্নিসহ ৫ জন এ মামলায় দোষ স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে।

“তাই এ পর্যায়ে মামলার তদন্ত প্রভাবিত বা বাধাগ্রস্ত করার কোনো সুযোগ নেই। মিন্নি ১৯ বছরের একটি মেয়ে। যে কোনো শর্তে জামিন চাচ্ছি। আদালত যে শর্ত দেবে তাই মেনে নেওযা হবে। জামিন দিলে মিন্নি পালাবে না। সে তার পিতার হাওলায় থাকবে।”

বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক এসময় ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারোয়ার হোসেন বাপ্পীকে বলেন, “ডিএজি সাহেব, এমন হলে সুষ্ঠু তদন্ত হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু থাকে? কতটুকু সত্য বেরিয়ে আসার সুযোগ থাকে?”

জবাবে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বাপ্পী বলেন, “মিন্নিকে অনেক পরে (মামলা হওয়ার) ডাকা হয়েছে। এর আগেই কয়েকজন আসামি স্বীকারেক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তাতে মিন্নির সম্পৃক্ততার তথ্য উঠে আসে।”

 এ সময় বিচারক বলেন, “জিজ্ঞাসাবাদেরও তো একাট নিয়ম-নীতি রয়েছে। এখানে অনেকে (আইনজীবী) আছেন যাদের একসময় ক্যান্টনমেন্টে ডেকে নেওয়া হয়েছিল।

“সেখানে একজন লোককে নেওয়া হলে তার মানসিক অবস্থা কী হতে পারে? ধরে নিলাম যে মিন্নির ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দি ঠিক আছে। তারপরও এটা কি যথাযথ প্রক্রিয়া?”

জবাবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, “মিন্নি তার স্বামীকে শিক্ষা দিতে চেয়েছিল। এটা কেমন কথা যে স্বামীকে শিক্ষা দিতে হবে?”

তিনি বলেন, আগামী ২২ অগাস্ট এ মামলায় পুলিশের প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য রয়েছে। সেখানে সব উঠে আসবে।

“তাছাড়া গ্রেপ্তার ১৫ জনের মধ্যে চারজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। চারজনের জবানবন্দিতেই এ হত্যাকাণ্ডে মিন্নির সম্পৃক্ততার বিষয়টি উঠে এসেছে।”

মিন্নিকে এই হত্যাকাণ্ডের ‘মূল নকশাকারী এবং ষড়যন্ত্রকারী’ আখ্যায়িত করে তাকে জামিন না দেওয়ার আর্জি জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী। 

পরে আদালত মিন্নির জামিন প্রশ্নে রুল জারি করে। এ মামলায় তাকে কেন জামিন দেওয়া হবে না- তা সাত দিনের মধ্যে সরকারকে জানাতে বলা হয়।

আগামী ২৮ অগাস্ট এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানির দিনে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বরগুনা সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. হুমায়ুন কবিরকে যাবতীয় নথিপত্রসহ আদালতে হাজির থাকতে নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট।  

এছাড়াও মিন্নি আদালতে জবানবন্দি দেওয়ার আগেই বরগুনার পুলিশ সুপার কেন সংবাদ সম্মেলন করে তার ‘দোষ স্বীকারের’ তথ্য দিয়েছিলেন, সে বিষয়ে ২৮ অগাস্ট তাকে লিখিত ব্যাখ্যা দিতে হয়।