আশ্বাসে দুশ্চিন্তা কাটছে না চলন্তিকার ঘর পোড়া মানুষের

রাজধানীর মিরপুরে চলন্তিকা বস্তির ঘরপোড়া বাসিন্দাদের নতুন করে ঘর তুলে দেওয়ার আশ্বাস দিচ্ছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা, তবে ক্ষতিগ্রস্তদের দুশ্চিন্তা তাতে কাটছে না।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 August 2019, 04:57 PM
Updated : 19 August 2019, 04:57 PM

কর্তৃপক্ষের ত্রাণ তৎপরতায় আপাতত তিন বেলা খাবার পেতে সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু সব হারানো মানুষগুলোর রাত কাটছে খোলা আকাশের নিচে, ভ্যানগাড়িতে, স্কুলের মাঠে আর ফুটপাতে।

নেতারা এসে ঘর বানিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে গেলেও কবে নাগাদ সেই কাজ শুরু হবে- সে কথা বলতে পারছেন না কেউ।

গত শুক্রবার রাতে তিন ঘণ্টার আগুনে পুড়ে যায় মিরপুর-৭ নম্বরের চলন্তিকা বস্তির কয়েকশ ঘর, বাস্তুহারা হয় প্রায় ৩০ হাজার মানুষ।

ঈদের ছুটিতে বস্তির অনেকেই ছিলেন দেশের বাড়িতে। ফিরে এসে তারা পোড়া কয়লা ছাড়া কিছু পাননি।

সোমবার দুপুরে দেখা যায়, রাস্তার ধারে খোলা আকাশের নিচে, স্থানীয় বঙ্গবন্ধু বিদ্যা নিকেতন, শহীদ স্মৃতি স্কুল, চলন্তিকা মোড় ও আশপাশের নির্মাণাধীন ভবনগুলোতে অবস্থান নিয়েছে ঘরহারা মানুষেরা।

সিটি করপোরেশন, সরকারের ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াছ উদ্দিন মোল্লার তত্ত্বাবধানে তাদের জন্য তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা হচ্ছে।

দুপুরে বঙ্গবন্ধু বিদ্যা নিকেতনের মাঠে ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসীর মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

এ সময় কয়েক হাজার বস্তিবাসী পুনর্বাসনের দাবি জানাতে রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে যান। ওবায়দুল কাদের চলে যাওয়ার পরও তারা পুনর্বাসনের দাবিতে সড়ক অবরোধের চেষ্টা করেন।

ত্রাণ বিতরণ অনুষ্ঠানে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের আশ্বাস দেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক।

তিনি বলেন, “আমি আপনাদের আশ্বস্ত করছি। আমরা এই ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় যতদিন সাহ্যয্যের দরকার, ত্রাণের দরকার, পুনর্বাসন পর্যন্ত.... শেখ হাসিনা সরকার আপনাদের পাশে আছে।”

মোহাম্মদ সিদ্দিক মিয়া নামে বস্তির এক বাসিন্দা জানান, চলন্তিকা মোড়েই সাতটি ঘর করে থাকতেন তিনি। দুটি ঘরে তার পরিবারের সদস্যরা থাকতেন। বাকি ঘরগুলো তিনি ভাড়া দিয়েছিলেন। আগুনে সবগুলো ঘরই ভষ্মীভূত হয়েছে।

তিনি বলেন, বস্তিতে অনেক ঘরে প্লাস্টিকের পাইপে অবৈধ গ্যাস সংযোগ ছিল। সেই সংযোগের ত্রুটি থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয় বলে তাদের ধারণা।

সিদ্দিক মিয়া জানান, গ্যাসের মত বস্তির অধিকাংশ বিদ্যুৎ সংযোগই ছিল অবৈধ।

তিনি বলেন, “এ কথা অস্বীকার করারা উপায় নেই। আমরা এখানে অবৈধভাবেই ছিলাম। এখানে কিছু মানুষ বিদ্যুতের বৈধ লাইন ব্যবহার করত। আমিসহ অধিকাংশ মানুষ অবৈধ সংযোগের বিদ্যুৎ ব্যবহার করতাম।”

দুপুরে স্থানীয় বস্তিবাসী নারীদের সমবেত করে তাদের সামনে বক্তব্য দেন স্থানীয় ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রজ্জব হোসেন, ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবদুর রউফ নান্নু এবং ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহিরুল ইসলাম মানিক।

তারা সবাই বস্তিবাসীর জন্য পুনরায় ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার আশ্বাস দেন।

রজ্জব হোসেন বলেন, সরকার বস্তিবাসীর জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণ করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। তা বাস্তবায়নের আগ পর্যন্ত চলন্তিকা ঝিল বস্তির বাসিন্দারা এখানেই থাকবেন।

“সেজন্য সরকারি খরচে ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হবে। এসব ঘরে থাকতে কাউকে ভাড়া দিতে হবে না।”

ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কম বেশি আড়াই হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ এসব বস্তিতে থাকত। অনেক ঘরের মালিক বস্তিতেই থাকতেন। অনেকে আবার থাকেন আশপাশের ফ্ল্যাট বাড়িতে।

সোমবার বিকালে বঙ্গবন্ধু স্কুলের আশ্রয় শিবিরে ত্রাণ বিতরণের সমন্বয় করছিলেন পল্লবী থানা যুবলীগের সভাপতি তাইজুল ইসলাম চৌধুরী বাপ্পী।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, আরামবাগে দুটি, চলন্তিকা ও বঙ্গবন্ধু স্কুলের একটি করে আশ্রয় শিবিরে অন্তত ৭ হাজার থেকে ৮ হাজার বস্তিবাসীর স্থান করছে। দলীয় ব্যবস্থাপনায় এবং সরকারি সহায়তায় তাদের তিন বেলার খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

পাশাপাশি সংসদ সদস্য ইলিয়াছ উদ্দিন মোল্লা চারটি গরু দিয়েছেন আশ্রয়হীনদের খাবারের জন্য।

ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা হচ্ছে জানিয়ে ইলিয়াস মোল্লা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনেকে এখনও বাড়ি থেকে ফিরে আসেনি। তারা সবাই এলে নিজেরা ঘুরে দাড়ানো পর্যন্ত ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত থাকবে।”

পুনর্বাসনের বিষয়ে জানতে চাইল তিনি বলেন, এ বিষয়ে অচিরেই সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে তারা আলোচনায় বসবেন। কীভাবে পুনর্বাসন করা যায় সেটা আলোচনা করে ঠিক করা হবে।

কিন্তু তার আগ পর্যন্ত কীভাবে চলবে সে দুশ্চিন্তা কাটছে না অগ্নিকাণ্ডে ঘর হারানো রবিউল ইসলামের।

তিনি বলেন, “খাবারের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে। কিন্তু রাতে ঘুমানোর খুবই সমস্যা।… নেতারা আশ্বাস দিয়েছেন নতুন করে ঘর তুলে দেবেন। কিন্তু তার আগে কীভাবে চলবে সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।”

রবিউল জানান, অনেকে আশপাশে আত্মীয়-স্বজনের বাসায় গিয়ে উঠেছে। যাদের আত্মীয়-স্বজন নেই তারাই এখনও পোড়া ধ্বংসস্তূপের আশপাশে ঘোরাফেরা করছে। 

অগ্নিকাণ্ডে ঘর হারানো রিকশা চালক সাদ্দাম হোসেন বলেন, ১০ মাস আগে ২৫৫০ টাকা ভাড়ায় বস্তির একটি কক্ষে উঠেছিলেন তিনি। ঈদে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে গিয়েছিলেন ময়মনসিংহে গ্রামের বাড়িতে। আগুন লাগার খবর পান দুইদিন পর রোববার। সকালে ছুটে এসে দেখেন তার কিছুই আর নেই।

“এসে শুনলাম ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা হচ্ছে। কিন্তু কোথায় নাম লেখাব, সেটা তো বুঝতে পারছি না।”