শুক্রবার বিকেলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু কন্যার এই মন্তব্য আসে।
জাতির পিতার ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ থেকে উদ্বৃত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “জাতির পিতা বলেছিলেন, প্রয়োজনে বুকের রক্ত দেব। আর সেই রক্তই তিনি দিয়ে গেছেন। আমাদের সেই রক্তঋণ শোধ করতে হবে তার স্বপ্নের ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মাত্র চার বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট তাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক, তৎকালীন শেখ মুজিবের পরিবারের ছয় বছরের শিশু থেকে শুরু করে অন্তঃসত্ত্বা নারীও সেদিন ঘাতকের গুলি থেকে রেহাই পায়নি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ঘটনার প্রথম দিকে ভাবখানা এমন হয়েছিল যে এটা একটা পরিবারের উপর আঘাত। কিন্তু এখানেই বোঝার ভুল ছিল। এটা পরিবারের উপর আঘাত না। যাদের হত্যা করা হয়েছে তারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। কেবল সংগঠিতই করেননি সরাসরি যুদ্ধ করেছেন মাঠে। ধীরে ধীরে এটা স্পষ্ট হয়েছে।
“মুক্তিযুদ্ধে আমরা যে বিজয় অর্জন করেছি, সেই বিজয়ের প্রতিশোধ নেওয়া এবং সেই বিজয়কে ধুলিসাৎ করে দিয়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের আবার ক্ষমতায় পুনর্বাসিত করা, আবার পাকিস্তানি ভাবধারায় নিয়ে আসা… যে কারনে খুনিরা এই হত্যার পর প্রথম ঘোষণা দিয়েছিল- ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ। যেটা পরবর্তীতে তারা আর রাখতে সাহস পায়নি।”
সেই রাতেই নিহত হন বঙ্গবন্ধুর বোনের স্বামী আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ, মেয়ে বেবী ও শিশুপৌত্র সুকান্ত বাবু; বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, নিকট আত্মীয় শহীদ সেরনিয়াবাত ও রিন্টু।
ধানমণ্ডির বাড়িতে পুলিশের বিশেষ শাখার সাব ইন্সপেক্টর সিদ্দিকুর রহমান ও নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিলকেও গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় সে সময় প্রাণে বেঁচে যান।
শোক দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা বেঁচে গিয়েছিলাম। সেই বাঁচাটা বাঁচা না। সেই বাঁচার যন্ত্রণা মৃত্যু থেকেও অনেক বেশি। ছয় বছর পর দেশে আসি। অন্য দেশে রিফিউজি হয়ে আশ্রয় নিয়ে থাকতে হয়েছে। কাজ করেছি। থেমে থাকিনি।”
তিনি বলেন, “আমি শুধু এইটুকুই বলব, আজকের দিনে শোকগাথা বুকে নিয়েও এ দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। শুধু আমার বাবার কথা চিন্তা করেই, তিনি কীভাবে কষ্ট স্বীকার করেছেন, কিভাবে জীবনের সবকিছু বিসর্জন দিয়েছেন এই দেশের জন্য।”
নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন তার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা, হাল ধরেন আওয়ামী লীগের। তার নেতৃত্বেই ১৯৯৬ সালে দীর্ঘদিন পর ক্ষমতায় ফেরে আওয়ামী লীগ।
দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “সব হারিয়ে পেয়েছিলাম লাখো মানুষ। তাদেরকে আপন করে নিয়েছি। আর আওয়ামী লীগের অগণিত নেতা-কর্মী, মুজিব আদর্শের সৈনিক- তারাই আমাকে আপন করে নিয়েছে। সেখানেই পেয়েছি বাবা-মা-ভাইয়ের ভালবাসা। এটাই আমার সব থেকে বড় শক্তি।”
জিয়াউর রহমানের দিকে ইংগিত করে তিনি বলেন, “সামান্য একটা মেজর ছিল। তাকে প্রমোশন দিয়ে দিয়ে মেজর জেনারেল করা হল। কখনো একা আবার কখনো খালেদা জিয়াকে সাথে নিয়ে আমাদের বাসায় আসত। কারণ খালেদা জিয়াকে সাথে আনলে মায়ের সাথে দেখা করা যায়। বাসার উপরে আসতে পারে। ঘন ঘন তার যাতায়াত ছিল। ডালিম, ডালিমের শাশুড়ি, ডালিমের বউ দিন রাত আমাদের বাসায়… এরাই হত্যাকাণ্ডটা চালালো।”
বঙ্গবন্ধুর নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার প্রক্রিয়া জিয়াই শুরু করেছিল বলেও মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
“আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের যারা বিরোধিতা করেছিল, বাংলাদেশ কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াক তারা তা চায়নি। তারা কখনো বাঙালি জাতির অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে চায়নি। যারা বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকারটুকুও কেড়ে নিতে চেয়েছিল, তাদেরই চক্রান্ত ছিল।
“কারণ বাঙালি জাতির বিজয়, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বিজয়, তারা মেনে নিতে পারেনি। বাঙালি হয়েও তারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও পাকিস্তানি শাসকদের পদলেহন করেছে। তারা গণহত্যা চালিয়েছে, অগ্নিসন্ত্রাস চালিয়েছে, বুদ্ধিজীবী হত্যা করেছে। একটা জাতিকে তারা সম্পূর্ণভাবে পঙ্গু করে দিতে চেয়েছিল।”
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু যখন যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গঠনের কঠিন কাজে ছিলেন, তখন ওই গোষ্ঠী ‘চক্রান্ত করেছে’ বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা।
“তখনও আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সাতজন সংসদ সদস্যকে হত্যা করার মত কাজ তারা করেছে। যারা স্বাধীনতাবিরোধী, অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিল। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত হয়ে একটা ধ্বংসযজ্ঞ তারা শুরু করেছিল। তারপরও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ… বুঝতেই পারেনি। স্বাধীনতাবিরোধীরা চক্রান্ত করবে- এই উপলব্ধি তখন অনেক রাজনৈতিক নেতার মধ্যেই আসেনি।
“তাই তারা এটা হবে, ওটা হয়নি, নানাভাবে প্রশ্ন, কথা লেখালেখি- অনেককিছু করেছিল। একটা দেশ যে একদিনে গড়ে ওঠে না, সেই উপলব্ধিটা যদি সবার মধ্যে থাকত, তাহলে আজকে ১৫ অগাস্টের মত আঘাত এদেশের ওপর আসত না।”
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশের উন্নয়নে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথাও এ আলোচনা সভায় তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
অন্যদের মধ্যে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমদ, সভাপতিমণ্ডলির সদস্য মতিয়া চৌধুরী, মো. নাসিম, আব্দুল মতিন খসরু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আফম বাহাউদ্দিন নাসিম অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।