রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে মৃত্যু হয় একুশে পদকপ্রাপ্ত এই লেখিকার। তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।
রিজিয়া রহমানের একমাত্র ছেলে আবদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, নানা ধরনের স্বাস্থ্য জটিলতায় ভুগছিলেন তার মা। রক্তের সংক্রমণের কারণে ঈদের পরদিন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
এই কথা সাহিত্যিকের মৃত্যুর খবরে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী বাংলা সাহিত্যে রিজিয়া রহমানের অবদানের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।
সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, “তার মৃত্যু এদেশের সাহিত্য অঙ্গণের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য খ্যাতনামা এ ঔপন্যাসিককে এদেশের মানুষ দীর্ঘকাল স্মরণ রাখবে।”
১৯৩৯ সালে কলকাতার ভবানীপুরে রিজিয়া রহমানের জন্ম। দেশভাগের পর পরিবারের সঙ্গে তিনি এপার বাংলায় চলে আসেন।
ষাটের দশক থেকে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্যসহ সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার মূল পরিচিতি ঔপন্যাসিক হিসেবে।
চিকিৎসক বাবা আবুল খায়ের মোহম্মদ সিদ্দিকের বদলির চাকরির সুবাদে রিজিয়ার শৈশব কেটেছে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে। পরিবারে ছিল একটি সাংস্কৃতিক আবহ। আবুল খায়ের এস্রাজ আর বাঁশি বাজাতেন। মা মরিয়াম বেগমও গান ভালোবাসতেন। বাড়িতে ছিল ঘরভর্তি বই।
বাবার মৃত্যুর পর নানার বাড়িতে রিজিয়ার লেখাপড়া নিয়ে তৈরি হয় জটিলতা। মাধ্যমিকের পরপরই বিয়ে হয়ে যায়, ভূতত্ত্ববিদ স্বামী মো. মীজানুর রহমানের সঙ্গে চলে যান পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে।
পরে দেশে ফিরে ইডেন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক আর ডিগ্রি পাস করেন রিজিয়া রহমান। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে করেন মাস্টার্স।
শৈশব থেকে জীবনের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা আর নানা জায়গায় দেখা নিম্নবর্গের মানুষের জীবনের গল্প উঠে এসেছে রিজিয়া রহমানের লেখায়।
বস্তিবাসীর ক্লেদাক্ত জীবন আর যৌনপল্লীর যন্ত্রণাকাতর প্রাত্যহিকতা যেমন তার উপন্যাসে এসেছে, তেমনি চট্টগ্রামে পর্তুগিজ জলদস্যুদের উৎপাত আর প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের বীরত্বও তার লেখায় প্রেরণা যুগিয়েছে।
‘বং থেকে বাংলা' উপন্যাসে রিজিয়া লিখেছেন বাঙালির জাতিগঠন ও ভাষার বিবর্তনের গল্প। তার ‘শিলায় শিলায় আগুন’ বলেছে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের নিপীড়িত মানুষের স্বাধীনতার চেতনার কথা। আর ‘একাল চিরকাল'ধারণ করেছে সাঁওতাল জীবনের আনন্দ, বেদনা, শোষণ, বঞ্চনার কথামালা।
সহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান রিজিয়া রহমান। আর সরকার চলতি বছর তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে।
অগ্নিস্বাক্ষরা, ঘর ভাঙা ঘর, উত্তর পুরুষ, রক্তের অক্ষর, বং থেকে বাংলা, অরণ্যের কাছে, শিলায় শিলায় আগুন, অলিখিত উপাখ্যান, ধবল জোৎস্না, সূর্য সবুজ রক্ত, একাল চিরকাল, হে মানব মানবী, হারুন ফেরেনি, উৎসে ফেরা তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
রিজিয়া রহমান বেশ কিছুদিন একটি কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। বাংলা একাডেমীর কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য, জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের কার্য পরিচালক এবং জাতীয় জাদুঘরের পরিচালনা বোর্ডের ট্রাস্টি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সব কিছুর পর লেখালেখিই ছিল তার মূল কাজ।
একমাত্র ছেলে আবদুর রহমান জানান, উত্তরা ৫ নম্বর সেক্টরে বাসার কাছের মসজিদে শুক্রবার আসরের পর রিজিয়া রহমানের জানাজা হবে। পরে মিরপুর কবরস্থানে ভাইয়ের কবরের পাশে তাকে দাফন করা হবে।