ঈদের দিন সোমবার সকাল ১০টার দিকে মহাখালী বাস টার্মিনালের পাশে ওই জবাইখানায় গিয়ে দেখা মিললো শুধু একজনের।
বনানীর ২৭ নম্বর সড়কের বাসিন্দা শাহজালাল ফিরোজ সেখানে এসেছিলেন ছাগল কোরবানি দিতে। সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত কসাই ও কর্মীরা তার ছাগল জবাই করে মাংস তৈরি করে দিয়েছেন। সেই মাংস নিয়ে তিনি বাড়ি ফেরা পর্যন্ত সেখানে আর কাউকে কোরবানির পশু নিয়ে আসতে দেখা গেল না।
অথচ ঈদের নামাজের পর সকাল সাড়ে ৭টা থেকেই রাজধানীর প্রায় প্রতিটি অলিতে গলিতে, এমনকি প্রধান সড়কের ওপরও পশু কোরবানি দিতে এবং মাংস কাটতে দেখা গেছে বরাবরের মতই। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় বেড়েছে রক্তমেশা পানি আর বর্জ্যের স্তূপ।
মানুষ কেন কোরবানি দিতে নির্দিষ্ট স্থানে যেতে চায় না? অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা ফিরোজও কিছুটা বিস্মিত।
“এত চমৎকার পরিবেশে সিটি করপোরেশন পশু কোরবানির ব্যবস্থা রেখেছে। আমি একটা খাসি নিয়ে আসলাম, এখানে সব ধরনের ব্যবস্থা আছে। গাড়িতে করে বাসায় পৌঁছে দেওয়ারর ব্যবস্থা আছে। মানুষ কেন সচেতন হয় না!”
শাহজালাল ফিরোজ প্রশ্ন তোলেন- সিটি করপোরেশনের কমিশনাররা কোথায়? তারা কি এবার কোরবানি দেননি? মেয়ররা কি কোরবানি দেননি? তাহলে কেন জবাইখানা ফাঁকা পড়ে আছে?
ফিরোজের প্রশ্নের উত্তর জানতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. সাঈদ খোকন এবং উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামকে ফোন করেছিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। কিন্তু তারা ধরেননি।
তবে জনসংযোগ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দুই মেয়রও পশু কোরবানির জন্য সিটি করপোরেশনের নির্ধারণ করে দেওয়া জায়গায় যাননি। আরও অনেকের মত নিজেদের বাড়িতেই তারা কাজটি সেরেছেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মেয়র সাহেব বনানীতে তার পৈত্রিক বাড়িতে, যেখানে তিনি থাকেন, সেখানেই কোরবানি দিয়েছেন।”
আর উত্তর সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা এ এস এম মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মেয়র আতিকুল ইসলাম তার উত্তরার বাসাতেই কোরবানি দিয়েছেন।
বাংলাদেশে সারা বছর যে সংখ্যক পশু জবাই হয়, তার অর্ধেক হয় এই কোরবানির মওসুমে। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে এ বছর সারাদেশে সোয়া এক কোটি মত পশু কোরবানি হয়েছে, যার একটি বড় অংশ হয়েছে ঢাকায়।
কোরবানির সময় রাজধানীর অলিতে গলিতে যত্রতত্র পশু জবাই করায় রক্ত ও পশুবর্জ্য ছড়িয়ে থাকে শহরময়। হাজার হাজার টন বর্জ্য পরিষ্কার করাও সিটি করপোরেশনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
এ কারণে পরিবেশ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে সরকার বেশ কয়েক বছর ধরেই রাজধানীতে পশু জবাই ও মাংস প্রক্রিয়া করার জন্য স্থান নির্ধারণ করে দিয়ে আসছে। কিন্তু প্রতিবারই ফলাফল হতাশাজনক।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এ বছর মহাখালী পশু জবাইখানাসহ ২৭৩টি স্থানে পশু কোরবানির ব্যবস্থা করে। এছাড়া কোরবানি করা যাবে এ রকম ৪০০টি স্থান চিহ্নিত করে দেয়।
আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবার ৬০২টি স্থান পশু কোরবানির জন্য নির্ধারণ করে দেয়।রাস্তার ওপর কিংবা ড্রেনের পাশে পশু জবাই না করার জন্য বিশেষ সচেতনতামূলক ব্যবস্থা নেয় দুই সিটিই।
কিন্তু এবারও পরিস্থিতি বদলায়নি। ঝামেলার কথা ভেবে মানুষ কোরবানির পশু নিয়ে বাড়ি থেকে দূরে ‘নির্ধারিত স্থানে’ যেতে চায়নি।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ফকিরাপুল পানির ট্যাংকের বিপরীতে পশু কোরবানির স্থান ঠিক করে দিয়েছিল। সকাল ৯টা পর্যন্ত একজনও সেখানে যাননি। কিন্তু আশেপাশে গলির মধ্যে তখনও পশু জবাই চলছিল।
বিজয়নগরে পশু জবাইয়ের নির্ধারিত জায়গা ফাঁকা দেখা গেলেও আশপাশের অলিগলি ও বিভিন্ন ভবনের নিচে দেখা যায় মাংস বানানোর ব্যস্ততা।
পলাশী সরকারি কলোনিতে গিয়ে নির্ধারিত স্থানে বেশ কিছু পশু কোরবানি হতে দেখা গেছে। সেখানে অন্তত ৫০টি পশু কোরবানি হয়েছে বলে কর্মীরা জানিয়েছেন। তবে সেখানেও নির্দিষ্ট স্থানের বাইরে পশু কোরবানি চলেছে একইসঙ্গে।
নির্ধারিত স্থানে না গিয়ে রাস্তায় পশু জবাইয়ের কারণ জানতে চাইলে সেগুনবাগিচার বাসিন্দা সোলায়মান আলম বলেন, “আমাদের আগ্রহ নাই। নির্ধারিত স্থানে ভিড়ভাট্টা, ঝামেলা লেগেই থাকে। তার চেয়ে নিজ দায়িত্বে কোরবানি দিয়ে পরিষ্কার করে ফেলব।”
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এবার পশু কোরবানির জন্য ১০০ জন ইমাম এবং ২০০ জন মাংস প্রস্তুতকারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বাড়িতে মাংস পৌঁছে দেওয়ার জন্য যানবাহনের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল।
তারপরও এ সিটিতে নির্ধারিত স্থানে পশু কোরবানির হার ২০ শতাংশও হবে না বলে প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মঞ্জুর হোসেনের ধারণা।
আর উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম দুপুরে উত্তরায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেন, “ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৭৩টি স্থানে সবাই যদি কোরবানি দিতেন, তাহলে আমাদের পক্ষে বর্জ্য সংরক্ষণ করা সহজ হত। যারা ঘরবাড়িতে কোরবানি দিয়েছেন, তাদের অনুরোধ করব, নিজ দায়িত্বে ঘরবাড়ি পরিষ্কার রাখবেন।”
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মুখপাত্র উত্তম কুমার রায় বলেন, “আমরা আশানুরূ সাড়া পাইনি। পুরান ঢাকাতে যারা কোরবানি করেন, তাদের অনেকেই একাধিক পশু কোরবানি দেন এবং নিজের বাড়িতেই সেটা করেন।”
তবে বর্জ্য ফেলার ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে সচেতনতা কিছুটা বেড়েছে বলেই মনে হয়েছে উত্তমের।
“সিটি করপোরেশন যে ব্যাগ দিয়েছে, সেই ব্যাগে বর্জ্য ভরে তারা ডাস্টবিনে নিয়ে ফেলছে। এতে আমাদের কিছুটা সুবিধা হয়েছে।”
সমাধান কোথায়?
নির্ধারিত জায়গায় না যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে যে উত্তরগুলো নাগরিকরা দিয়েছেন, সেগুলো এরকম-
>> যে জায়গায় সিটি করপোরেশন ব্যবস্থা করেছে, সেটা যথেষ্ট প্রশস্ত না
>> অনেক মানুষ একসঙ্গে সেখানে গেলে ভিড়ভাট্টায় ঝামেলা হবে
>> নির্ধারিত জায়গায় পানিসহ সব ব্যবস্থা ঠিকঠাক নেই
>> বাড়ি থেকে দূরে, গরু নিয়ে যাওয়া আবার মাংস নিয়ে ফেরা ঝামেলা
>> আমরা তো সব সময়ই এখানে দিই, কোনো সমস্যা তো হয় না
>> পশু কোরবানি নির্ধারিত জায়গায় দেওয়াটা তো বাধ্যতামূলক না, মানুষ তো নিজের সুবিধা অনুযায়ী দেবে
>> নির্ধারিত জায়গাটা আবার কোথায়? আমাদের তো কেউ কিছু বলেনি!
ঢাকা উত্তর সিটির করপোরেশনের দুই নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সাজ্জাদ হোসেন জানান, তার এলাকার আটটি নির্ধারিত জায়গায় মধ্যে তিনটি বা চারটিতে মোটামুটি সাড়া মিলেছে। বাকি জায়গাগুলো একরকম খালিই ছিল।
সিটি করপোরেশন থেকে আটটি পিকআপ দেওয়া হয়েছিল মাংস পৌঁছে দেওয়ার জন্য। এর মধ্যে মাত্র তিনটি ব্যবহার করতে হয়েছে।
তার মতে, নাগরিকদের নির্ধারিত জায়গায় নিতে প্রয়োজনীয় সবকিছু করতে পারেনি সিটি করপোরেশন। সে কারণে নাগরিকদের আস্থা তৈরি হয়নি, সাড়াও মেলেনি।
“আমার ওয়ার্ডে অন্তত পাঁচ হাজার গরু কোরবানি হয়। সেজন্য যা করার দরকার এবার আমরা করতে পারিনি।”
নাগরিকদের উৎসাহী করতে আর কি কি করতে পারে সিটি করপোরেশন?
সাজ্জাদ হোসেন বলেন, “ভবিষ্যতে খোলা মাঠে কোরবানির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সেখানে পানির লাইন রাখতে হবে। ত্রিপল দিয়ে শেড করতে হবে। আর ভ্রাম্যমাণ আদালত থাকলে ভাল হয়।
“এবার এগুলো সীমিত পরিসরে হলেও ভবিষ্যতে এটা যদি পরিকল্পনার মধ্যে করা যায়, তাহলে জনগণ নির্ধারিত স্থানে পশু কোরবানি করতে উৎসাহী হবে।”
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৫ ও অঞ্চল-১০ এর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মফিজুর রহমান ভুঁইয়া বলেন, “সত্যিকার অর্থে ঢাকা সিটি করপোরেশনগুলোর নির্ধারিত স্থানে যতজন হুজুর ও কসাই রাখা দরকার ছিল, আমরা তা রাখতে পারিনি। ওখানে গেলে একজনের গরু আবার অন্যের গরুর সঙ্গে বদলাবদলি হয়ে যায় কি না- সেই ভয়ও মানুষ পায়।”