আগের রাতে লক্ষ্মীপুরের কালীবাড়ি এলাকার আড়াই বছরের সামিয়ার মৃত্যুতে ঢাকা শিশু হাসপাতলে সে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা যেন আরও বড়িয়ে দিয়েছে।
সোমবার ঈদের দিন দুপুরে হাসপাতালটির ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে তারই প্রমাণও পাওয়া গেল। সন্তানের পাশ থেকে কোনো অভিভাবকই এক মুহূর্তের জন্যও নড়তে চাইছেন না। দায়িত্বরত চিকিৎসক ও নার্সরাও রোগীদের পাশাপাশি অভিভাবকদেরও সামলাতে হচ্ছে।
বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা ছাড়া গোটা হাসপাতালেই ঈদের কোনো অমেজ নেই। তার মধ্যে ডেঙ্গু শনাক্ত করতে আসা অভিভাবকদের ভীড় বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকলে দায়িত্বরতদের ব্যস্ততাও বাড়ে।
ডেঙ্গু সেলে দায়িত্বরত স্টাফ নার্স হেলেনা জাহান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিশেষ পরিস্থিতিতে ঈদে বাসা বা বাড়িতে না থেকে হাসপাতালে কাটাতে হচ্ছে।”
তিনি জানান, সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত জ্বরে আক্রান্ত ১২ শিশুকে নিয়ে এসেছেন অভিভাবকরা, যাদের দুজনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে।
হেলেনার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই দেখা গেল দেড় বছরের মেয়ে হুমায়রা বিনতে মাহবিনকে নিয়ে মিরপুর-১ এর আহমেদ নগর থেকে এসেছেন তাদের বাবা-মা।
জানতে চাইলে শিশুটির আল মাহাদী হাসান আসিফ বলেন, “সন্তান অসুস্থ হলে মা-বাবা কি ভাল থাকতে পারে। সারা দেশে ডেঙ্গু আতঙ্ক। মেয়েটার দুইদিন ধরে জ্বর। কিসের ঈদ আর কিসের কী! মেয়েটা সুস্থ থাকলে অনেক ঈদ আসবে জীবনে।”
এমন উৎকণ্ঠা নিয়ে আরও অনেক অভিভাবককেই আসতে দেখা যায়।
তিন বছর দুই মাস বয়সী মেয়ে মনিকা আক্তার মার্জিয়াকে নিয়ে গত বুধবার থেকে ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে আছেন ঝিগাতলা নতুন রাস্তা এলাকার বাসিন্দা নাজমা আক্তার। আরও দুই ছেলেসহ পাঁচ জনের সংসারে একমাত্র উপার্জনকারী স্বামী মনির হোসেন রিকশা চালান।
নাজমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত ছয়দিন ধরে আমি তো মেয়েকে নিয়ে এইখানে (হাসপাতালে)। এই কয়দিন তো হে (তার স্বামী) বাইরেই খায়া নিছে। আইজ কি করছে জানি না।”
বুধবার হাসপাতালে আনার সময় মেয়ের অবস্থা খুব খারাপ থাকলেও কয়েক দিনে উন্নতি হলেও আশঙ্কামুক্ত নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
তিনি বলেন, “গত রাতে একটা মেয়ে মারা গেছে। এরপর কি আর কিছু মনে থাকে। কি যে সময় আইলো মশার কামড়ে মানুষ মইরা যায়। আরও কত ধরনের আজাব যে আল্লায় দিব, কে জানে!”
একমাত্র ছেলে আকাশ হেসেনকে (১০) নিয়ে সোমবার থেকে হাসপাতালে আছেন গাড়িচালক শরিফ আহমেদ। স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতলে ডেঙ্গু আক্রান্ত সন্তানের পাশেই ঈদ কেটেছে শরীফের।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ছেলের জন্য শার্ট কিনে আনছি। আমাদের কিছু দরকার নাই। খাওয়া-পরার চিন্তা করি না, দোয়া করেন পোলাডা যেন ভালমত বাইচা থাকে।”
ছেলের অবস্থা জানতে চাইলে শরীফ বলেন, “আগের চাইতে ভাল। ডাক্তাররা বলছে ডাব, ফলর জুস বেশি কইরা খাওয়াইতো। একটা ডাবের দাম ৯০-১০০টাকা। আর ফলের যে দাম, কেমনে কি করমু ভাইবা পাই না।”
হাসপাতালটির ১০ নম্বর ওয়ার্ডে পাঁচদিন ধরে মেয়ে নূসরাত জহান শ্রেয়সীকে (৭) নিয়ে আছেন মিরপুর-১ এর শাহ আলীবাগের বাসিন্দা মিতু। স্বামী সুমন কুয়েতপ্রবাসী হওয়ায় তাকেই সামলাতে হয় সংসার।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বাসায় শ্বশুর-শ্বাশুরি আছেন। কিন্তু আজ যাওয়ার সুযোগ হয়নি। সুযোগ হয়নি তা না, গত রাতে একটা বাচ্চা মারা গেছে ডেঙ্গুতে। এরপর থেকে আমার ঘুম নাই। কিচ্ছু ভাল্লাগছে না।”
হাসপাতালটিতে ডেঙ্গু আক্রান্তদের দিনরাত যারা সেবা দিচ্ছেন, তারাও যে ডেঙ্গু আতঙ্কে আছেন, নার্সিং সুপারভাজার রিনা বাড়ৈয়ের কথাতেই তা স্পষ্ট।
“১৩৬ নম্বর ডেঙ্গু সেলে ডিউটি করছিল সিনিয়র স্টাফ নার্স আলপনা বাড়ৈ আর আমেনা বেগম। এখন তারাও ডেঙ্গু আক্রান্ত। আমরা ডিউটি করার সময় অ্যারোসল স্প্রে করি বা কয়েল জ্বালাই। এছাড়া আমাদের আর কোনো প্রটেকশন নেই।”
সিনিয়র স্টাফ নার্স ইয়াদা জামানকে দেখিয়ে রিনা বাড়ৈ বলেন, “নন মুসলিম আর মুসলিম বলে কথা নাই, সবারই ঈদ ছুটি বাতিল। জীবন-মরণের বিষয় এই সময়ে এখানেই আমাদের বড় দায়িত্ব।”
ঢাকা শিশু হাসপাতালের পেডিয়ার্ট্রিক এন্ড্রোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রবি বিশ্বাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তাতে আমাদের কারো স্টেশন লিভ করার সুযোগ নাই। ডেঙ্গু সেল গঠন করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে সিনিয়র, জুনিয়র সবাই পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করছে। স্বাভাবিকভাবেই একটু বেশি তৎপর থাকতে হচ্ছে আমাদের সবাইকেই।”
হাসাপাতালটির ১০ ও ১৫ নম্বর ওয়ার্ড ছাড়াও প্রায় সব ওয়ার্ডেই ডেঙ্গ রোগী আছে বলেও জানান এই চিকিৎসক।