ডেঙ্গু থেকে মুক্তির প্রার্থনা ঈদ জামাতে

মাতৃভূমি বাংলাদেশের শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রত্যাশার পাশাপাশি মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর ‘বালা’ থেকে মুক্তির প্রার্থনা এসেছে দেশের প্রধান ঈদ জামাতে।

জয়ন্ত সাহাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 August 2019, 05:51 AM
Updated : 13 August 2019, 03:13 AM

ত্যাগের আহ্বান নিয়ে সোমবার বাংলাদেশে উদযাপিত হচ্ছে ঈদুল আজহা, মুসলমানদের সবচেয়ে বড় এই ধর্মীয় উৎসব বাংলাদেশে পরিচিত কোরবানির ঈদ নামে। 

বরাবরের মত এবারও ঈদের প্রধান জামাত হয়েছে ঢাকার জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে, যেখানে অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা, বয়সের লাখো মুসলমান।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্য, সরকারি উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছাড়াও রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, পেশাজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষ সকাল ৮টায় জাতীয় ঈদগাহে প্রধান জামাতে অংশ নেন।

ইমামতি করেন বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদের সিনিয়র পেশ ইমাম হাফেজ মুফতি মাওলানা মিজানুর রহমান। নামাজ শেষে বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বের মুসলিম উম্মাহর শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় মোনাজাত করেন তিনি।

দুই হাত তুলে তিনি সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে বলেন, সকলের ভুলগুলো যেন তিনি ক্ষমা করে দেন, মাতৃভূমি বাংলাদেশের উত্তোরত্তর সমৃদ্ধি যেন হয়, সমগ্র মুসলিম উম্মাহর যেন মঙ্গল হয়, পৃথিবীর সকল মজলুম মানুষ যেন শান্তি পায়।

“বিশেষভাবে, গত কিছুদিন যে অবস্থাটা আমরা লক্ষ্য করেছি, বড় ধরনের একটি বালা, একটি ব্যধির সৃষ্টি হয়েছিল, ইতোমধ্যে আস্তে আস্তে একটু কমতেও শুরু করেছে। এক ধরনের রোগ জীবাণু, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় কিছু মানুষ, তারা ইন্তেকাল করেছেন, অনেকেই অসুস্থ হযে পড়েছেন, অনেকে এখনও হসপিটালে আছেন।

“যারা অসুস্থ আছেন… বিশেষভাবে দোয়া… আল্লাহ যেন তাদের নেক হায়াত দান করে দেন। আমাদের প্রতি রহম করেন..।”

এবারের কোরবানির ঈদ এসেছে এমন এক সময়ে, যখন দেশজুড়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু। অন্তত সাড়ে আট হাজার মানুষকে ঈদের দিনও দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। প্রাণঘাতি ডেঙ্গু এবার কেড়ে নিয়েছে শতাধিক পরিবারের ঈদের আনন্দ।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন আগেই জানিয়েছিলেন, জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে এবার ঈদের নামাজের পর ডেঙ্গু রোগীদের জন্য বিশেষ মোনাজাত করা হবে।

কদিন আগেই ডেঙ্গু থেকে সেরে উঠেছেন রাজধানীর শাহজাহানপুরের বাসিন্দা মো. এমদাদুল হক। সাড়ে তিন বছর বয়সী ছেলে নূর মোহাম্মদকে নিয়ে তিনি এসেছিলেন জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে।

এমদাদুল হক বলেন, “ডেঙ্গুর ভয়ে কোথাও যাইনি। চাঁদপুরের বাড়িতে বাবা-মা আছেন, তাদের সঙ্গেও ঈদ করতে পারলাম না এবার। আল্লাহর কাছে দোয়া করেছি,  এই রোগ যেন আর কারও না হয়।”

জাতীয় ঈদগাহে ঈদের জামাত শেষে কথা হয় চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের বাসিন্দা ৮০ বছর বয়সী শহিদুর রহমানের সঙ্গে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল, এখানে জামাত পড়ব। আল্লাহ সে তৌফিক দান করেছেন আমাকে। আমি নিজে ঠিকমত হাঁটতে পারি না। তাই নাতি সাঈদ আমাকে নিয়ে এসেছে এখানে।”

নাজিরাবাজারের অটো পার্টস ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সুমন প্রতি ঈদেই জাতীয় ঈদগাহ নামাজ পড়েন। তবে এবারই প্রথম তার সঙ্গে এসেছিল ছয় বছর বয়সী ছেলে নিশাত।

সুমন বলেন, “ছেলে আগেই বায়না করেছিল, কি করমু, নিয়ে আসলাম তারে। বাপ-বেটা একসাথে ঈদের নামাজ পড়লাম, তাও জাতীয় ঈদগাহে! ব্যাপারটাই তো আলাদা!”

বাবার কথা শেষ হতেই নিশাত বলে, “আব্বারে কইসি, বিকালে আমারে নিয়া ঘুরতে যাইতে। আমি বেড়াইতে ভালোবাসি।”

নবাবপুর রোডের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শাকিল বলেন, “এখানে এসে কত মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে! প্রতি বছরই নতুন বন্ধু হয় আমার। এই তো ঈদের শিক্ষা। ভাতৃত্ববোধের শিক্ষাই তো ঈদ আমাদের দেয়। ঈদ আমাদের দেয় ত্যাগের শিক্ষা। ত্যাগ ও ভাতৃত্ববোধের শিক্ষা যদি আমাদের সবার মধ্যে থাকত, তাহলে দেশটা কতই না সুন্দর হত।”

বেচারাম দেউরি এলাকার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আকবর বলেন, “১৬-১৭ বছর ধরে এখানে ঈদের নামাজ পড়তে আসি।  আগে আসতাম আব্বার সাথে।  এখন আব্বা নাই। আমার ছেলেমেয়েকে নিয়ে আসলাম। আব্বার কথা খুব মনে পড়ে। তার জন্য দোয়া করেছি।”

মিরপুর-৬ নম্বর সেকশনের কাইয়ুম খান এসেছিলেন সপরিবারে। স্ত্রী, সন্তান ছাড়াও সঙ্গে ছিলেন ভাতিজি আর ভাগ্নে।

কাইয়ুম বলেন, “সবাই মিলে একসঙ্গে ঈদের নামাজ পড়তে আসার পরিকল্পনা প্রতি বছরই থাকে। এখন যাব কয়েকজন আত্মীয়র বাসায়। বিকালে কোরবানির মাংস ভাগাভাগি হবে আত্মীয়-স্বজন, এলাকাবাসীর মধ্যে। তার আগে সবাইকে নিয়ে একটু ঘুরে বেড়াব।”

মেয়ে হুমায়রা আর ছেলে সালমানকে নিয়ে লালবাগ থেকে এসেছিলেন আমির হোসেন। তিনি বলেন, “আগে তো এলাকায় এ বাড়ি ও বাড়ি যেতাম। সে দিন এখন নাই। এখন ছেলেমেয়েকে বলছি আমাদের সেসব দিনের কথা। তারা যেন খুব আত্মকেন্দ্রিক না হয়, তাই ওদের নিয়ে ঈদগাহে আসা।”

জাতীয় ঈদগাহে নারীদের জন্যও থাকে বিশেষ বন্দোবস্ত। ছেলের বাসায় বেড়াতে ঢাকায় এসে প্রথমবারের মতো ঈদগাহে নামাজ পড়েছেন মাদারীপুরের ফাতেমা বেগম।

তিনি বলেন, “ছেলে আমাকে নিয়ে এল ঈদগাহে। এত মানুষের সঙ্গে ঈদ জামাত পড়ছি, সত্যি দারুণ লাগছে।”

ঈদের দিন বৃষ্টি হতে পারে বলে আভাস দিয়ে রেখেছিল আবহাওয়া অফিস; তবে রাজধানীতে ঈদের নামাজের সময় বৃষ্টি ভোগান্তির কারণ হয়নি।  

গত কয়েক বছরের মত এবারও ঈদ জামাত ঘিরে ছিল নিরাপত্তার কড়াকড়ি। যারা ঈদ জামাতে অংশ নিতে এসেছেন, তাদের যেতে হয়েছে তল্লাশির মধ্য দিয়ে।

জায়নামাজ আর ছাতা ছাড়া আর কিছু যাতে কেউ সঙ্গে না আনেন, সে বিষয়ে আগেই সবাইকে সতর্ক করেছিল পুলিশ। তবে জাতীয় ঈদগাহের জামাতে এবার লোক হয়েছে তুলনামূলকভাবে কম। ভেতরে অনেকটা অংশ ফাঁকাই দেখা গেছে।

বায়তুল মোকাররমে এবারও সকাল ৭টা থেকে পাঁচটি জামাত হয়েছে। পাড়ায় মহল্লায় মসজিদ আর ঈদগাহগুলোর সীমানা ছাড়িয়ে রাস্তায় ম্যাট ও জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে অংশ নিতে দেখা গেছে বহু মানুষকে।

দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ শেষে প্রতিটি জামাতে দোয়া ও মোনাজাতে অংশ নেন সবাই, যাতে বিশ্ব মুসলিমের ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং মুসলমানদের উন্নতি ও সমৃদ্ধি কামনা করা হয়।

এরপর ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করেন সবাই; বাড়ি ফিরে যোগ দেন পশু কোরবানির আয়োজনে।