আনন্দের ঈদযাত্রা ‘পরিণত যন্ত্রণায়’

আট ঘণ্টার পথ যেতে লাগছে ২২-২৪ ঘণ্টা, আর ওই বাস ধরতে কাউন্টারে বসে থাকতে হচ্ছে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা-উত্তরবঙ্গের পথে ঈদযাত্রার এই ভোগান্তিতে ক্ষুব্ধ একজন বললেন, আনন্দের ঈদযাত্রা এখন পরিণত হয়েছে যন্ত্রণায়।

নিজস্ব প্রতিবেদকও জেলা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 August 2019, 06:25 PM
Updated : 11 August 2019, 02:49 AM

সড়ক পথে এই ভোগান্তির মতোই অসহনীয় অপেক্ষার সময় কাটাতে হচ্ছে ট্রেনযাত্রীদের। সূচি বিপর্যয়ে উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমের জনপদের যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতে হচ্ছে কমলাপুর স্টেশনেই।

কোনো কোনো ট্রেন ছাড়ছে নির্ধারিত সময়ের দশ থেকে ১২ ঘণ্টা পর। একটি ট্রেন অবশ্য সর্বোচ্চ ১৬ ঘণ্টা পিছিয়েছে, তবে সম্ভাব্য সময় রাত ১টায় সেটি ছেড়ে যাবে কি না তা নিয়েও সন্দিহান যাত্রীরা।

ট্রেনে বিলম্বের এই পুরোটা সময় যাত্রীদের বসে থাকতে হয়েছে প্ল্যাটফর্মে। শনিবার মধ্যরাতে কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, ট্রেনের জন্য অপেক্ষারতদের উপচেপড়া ভিড়। ক্লান্তি আর হতাশা নিয়ে বসে আছেন কেউ, কেউ করছেন ঘোরাঘুরি, আবার গল্প করে সময় কাটাচ্ছেন কেউ কেউ।

ঈদের ছুটি রোববার শুরু হলেও তার আগে শুক্র ও শনিবার দুই ছুটির দিনেই বাড়ির পথ ধরেছেন বেশিরভাগ মানুষ। এর মধ্যে শুক্রবার ঢাকা থেকে খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস টাঙ্গাইলে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব পাশে লাইনচ্যুত হলে ট্রেন বন্ধ থাকে সাড়ে তিন ঘণ্টা।

কমলাপুরে ট্রেনের অপেক্ষা

রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, সুন্দরবনের ওই দুর্ঘটনাই সূচি বিপর্যয় ডেকে এনেছে। বঙ্গবন্ধু সেতু পার হয়ে রংপুর, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে যেসব ট্রেন যায়, তার সবগুলোই কম বেশি বিলম্বিত হচ্ছে।

শুক্রবার ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেনটি বিকাল ৫টার জায়গায় নীলফামারী স্টেশনে পৌঁছায় শনিবার ভোর ৫টায়। ঢাকা-নীলফামারী-চিলাহাটি রেলপথের একমাত্র এই ট্রেন সকাল ৮টায় ছাড়ার কথা থাকলেও সেটি ১২ ঘণ্টা পরে ছাড়ে বলে জানান যাত্রী ঢাকা কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মোজাহিদুল ইসলাম।

রাজশাহীগামী পদ্মা এক্সপ্রেস ঢাকা ছাড়ার কথা ছিল শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টায়। কিন্তু ছেড়েছে শনিবার সকাল ১০টায়।

এই ট্রেনের যাত্রী রাকিবুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সারা রাত স্টেশনে ছিলাম; তারপরও বাড়ি যেতে পারছি এটাই আনন্দ।”

শনিবার পশ্চিমাঞ্চলের সবগুলো ট্রেন ছাড়তেই বিলম্ব হয়েছে বলে জানিয়েছেন কমলাপুরের স্টেশন মাস্টার আমিনুল হক।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গতকাল সুন্দরবন এক্সপ্রেস বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব পাড়ে দুর্ঘটনায় পড়ায় এবং অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে একতা এক্সপ্রেসের স্প্রিং বসে যাওয়ায় ট্রেনের এই সূচি বিপর্যয় হয়েছে।”

শনিবার সবচেয়ে পিছিয়েছে রংপুর এক্সপ্রেস। ট্রেনটি ঢাকা ছাড়ার কথা ছিল সকাল ৯টায়, সূচি পিছিয়ে প্রথমে রাত ৯টায় করা হলেও তা সম্ভব হয়নি। সেটি রাত ১টায় ছাড়তে পারবে বলে রেল কর্তৃপক্ষ আশা করছে।

চিলাহাটীগামী নীলসাগর এক্সপ্রেস সকাল ৮টায় ছাড়ার কথা ছিল, সেটি ছেড়ে যায় রাত ৯টায়।

লালমনি এক্সপ্রেস কমলাপুর ছাড়ার কথা ছিল রাত সোয়া ৯টায়, সেই ট্রেন ছাড়ে রাত ১০টা ৫০ মিনিটে।

রাজশাহীগামী ধূমকেতু এক্সপ্রেস শনিবার সকাল ৬টায় ছাড়ার কথা ছিল, সেটি ছেড়ে যায় বিকাল ৪টায়। এই রুটের আরেক ট্রেন সিল্কসিটি বেলা ২টা ৪০ মিনিটে ছাড়ার কথা থাকলেও পিছিয়ে রাত দেড়টা সম্ভাব্য সময় দেওয়া হয়েছে।

শনিবার ভোর ৪টা ৪০ মিনিট থেকে রাত ১২টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত ঢাকা থেকে ট্রেন ছেড়েছে ৫৬টি

খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস শনিবার সকাল ৬টা ২০ মিনিটে ছাড়ার কথা ছিল, সেটি ছেড়ে গেছে বেলা দেড়টায়। এই রুটের অপর ট্রেন চিত্রা এক্সপ্রেস ছাড়ার কথা সন্ধ্যা ৭টায়, এখন সেটি ভোর সাড়ে ৪টায় ছাড়তে পারে বলে আশা করছে রেল কর্তৃপক্ষ।

পঞ্চগড়ের ট্রেন একতা এক্সপ্রেসের সকাল ১০টার জায়গায় ছেড়ে গেছে বেলা ১২টায়।

বেলা ১২টার দিকে খুলনার যাত্রী মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, “স্ত্রী-ছেলেমেয়ে নিয়ে সকাল ৬টায় স্টেশনে এসেছি। ৬টা ২০ মিনিটে সুন্দরবন ছাড়ার কথা ছিল। এতক্ষণ বসে থেকে বাচ্চারা ক্লান্ত।”

তার দেড় ঘণ্টা পর শুরু হয় তাদের প্রতীক্ষার ট্রেনযাত্রা। 

সড়ক পথে চট্টগ্রাম-সিলেটের যাত্রীরা স্বস্তিতে যেতে পারলেও বড় বেশি ধুঁকতে হচ্ছে উত্তরাঞ্চলের যাত্রীদের।

শুক্রবার সকাল ৭টায় ঢাকার মিরপুর মাজার রোড থেকে নাবিল পরিবহনের বাসে পরিবার নিয়ে নীলফামারির উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী এমদাদুল হক। আট ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে তার লেগেছে ২৪ ঘণ্টা।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পথে গতি নেই। ঢাকা থেকে বের হয়ে টাঙ্গাইলে এসে থেমে যাচ্ছে বাস। আনন্দের এ যাত্রায় পথটি পরিণত হয়েছে যন্ত্রণায়।”

নীলফামারীতে নাবিল পরিবহনের কাউন্টার ব্যবস্থাপক আসলাম রহমান বলেন, ঢাকা-নীলফামারী পথে তাদের সাতটি কোচ চলাচল করছে। প্রতিটি বাস ঢাকা থেকে নীলফামারী পৌঁছাতে ২০ থেকে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগছে।

সমস্যা যেখানে

টাঙ্গাইলে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব পাশের কয়েক কিলোমিটার পার হতে কেটে যাচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, এরপর সেতু পেরিয়ে সিরাজগঞ্জের হাটিকুমড়ুল মোড় পর্যন্ত যেতে হচ্ছে থেমে থেমে। সেতুর এপার-ওপারের প্রায় ৬৩ কিলোমিটারে যানজট থাকছে নিয়মিতই।

এই যানজটের কারণ হিসেবে সড়কে অতিরিক্ত গাড়ির চাপের কথা বলছে পুলিশ। টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সঞ্জিত কুমার রায় বলেন, ঢাকা-গাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকার গাড়ি এলেঙ্গা পর্যন্ত আসছে চার লেইন দিয়ে। কিন্তু এলেঙ্গা থেকে সড়ক হচ্ছে দুই লেইনের।

“চার লেইন দিয়ে আসা গাড়ি দুই লেইনে এসে জট পাকাচ্ছে। এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দুই লেইনের সড়কে এই সমস্যা দেখা দিচ্ছে। অতিরিক্ত গাড়ির চাপে জটে পড়ছে উত্তরবঙ্গের যান।”

শনিবার রাত ১২টায় টাঙ্গাইলের এলেঙ্গায় যানজটের চিত্র

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের টাঙ্গাইল প্রতিনিধি এমএ রাজ্জাক ওই এলাকা ঘুরে জানান, বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে টাঙ্গাইলের পাকুল্লা পর্যন্ত প্রায় ৪০ কিলোমিটারজুড়ে তীব্র যানজটে আটকা পড়ে নাকাল হচ্ছেন যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকরা। এই ৪০ কিলোমিটারে কখনও খুব ধীরগতিতে, কখনও থেমে থেমে চলছে যানবাহন। মাঝেমধ্যেই আটকা পড়ে থাকছে দশ-বিশ মিনিট। পাকুল্লা, করটিয়া বাইপাস, নগরজলফই, রাবনা বাইপাস ও এলেঙ্গায় এই জট কিছুক্ষণ পরপর পাঁচ-ছয় কিলোমিটার পর্যন্ত দীর্ঘ হচ্ছে।

এই যানজটের শুরু শুক্রবার সকালে। আগের রাতে টানা বৃষ্টি আর এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় খানা-খন্দ থাকায় যানবাহনের গতি কমে যায়। যানবাহনের ধীর গতি থেকে সকাল ১০টা থেকেই সেতুর উভয় পাশে সৃষ্টি হয় যানজট। শুক্রবার বিকেলের দিকে এই জট কমতে শুরু করে।সন্ধ্যা রাতে সেতু দিয়ে উত্তরবঙ্গের দিকে গাড়ি টানতে না পারায় আবার জট লাগতে শুরু করে। ফলে শুক্রবার রাতভর সড়কটিতে যান চলে থেমে থেমে।

এদিকে বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পাড়ে সিরাজগঞ্জ অংশে যানবাহনের জটের কারণে মাঝে মাঝে সেতু দিয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, যাতে পূর্ব পাশের জট আরও দীর্ঘ হয়।

বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব এলাকায় দায়িত্বরত জেলা ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক ইফতেখার নাসির রোকন বলেন, শুক্রবার সকাল থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে উত্তরবঙ্গের দিকে সড়কে ধারণ ক্ষমাতার চেয়ে যানবাহনের সংখ্যা বেশি। ফলে যানজটের কারণে গত ২৪ ঘণ্টায় আটবার সেতু দিয়ে যান চলাচল বন্ধ থাকে।

সেতুর ওপারে এই যানজটের কারণ সম্পর্কে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি ইসরাইল হোসেন বাবু বলেন, বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে ২৩ কিলোমিটার দূরে হাটিকুমড়ুল মোড় থেকে রাজশাহী, বগুড়া ও পাবনার দিকে তিনটি মহাসড়ক গেছে। এই মহাসড়কগুলো দিয়ে উত্তরের ২০টির বেশি জেলার যানবাহন চলাচল করে। এ সব গাড়িই চলাচল করছে দুই লেইনের ওই সংযোগ সড়ক দিয়ে।

এই সড়কের যে ১৮ কিলোমিটার বঙ্গবন্ধু সেতু কর্তৃপক্ষের অধীনে, সেখানে সড়ক প্রশ্বস্ত হলেও তারপরে পাঁচ কিলোমিটারে দুটি সরু সেতু রয়েছে। প্রথমে নলকা ব্রিজ এবং তার আড়াই কিলোমিটার দূরের ধুপাকান্দি-এই দুই সেতু দিয়েই মাত্র একটি করে গাড়ি পার হতে পারে।

অতিরিক্ত গাড়ির চাপের মধ্যে ওই দুটো সেতু যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে মনে করেন বাবু।

বঙ্গবন্ধুর সেতুর দুই পাড়ে ৬৩ কিলোমিটারজুড়ে এই যানজট

শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় এ যাবৎকালের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক, ৩৬ হাজার ৩৩৭টি গাড়ি বঙ্গবন্ধু সেতু পার হয়েছে বলে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসানুল কবির জানিয়েছেন।

এদিকে এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় খানা-খন্দ হওয়ায় এই এলাকায় গাড়ির গতি কমে যাচ্ছে বলে সেখানে দায়িত্বরত টাঙ্গাইল জেলা পুলিশের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর সাজেদুল ইসলাম জানান।

শনিবার সন্ধ্যার পর এই এলাকায় যানজট আরও তীব্র হয়।রাত সাড়ে ৮টায় এলেঙ্গায় অবস্থানরত মো. সোহাগ নামে একজন যাত্রী বলেন, “প্রায় আড়াই ঘণ্টা যাবৎ এলেঙ্গাতেই গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, কখন যে এই যানজট ছাড়ে আল্লাহ জানে!”

উত্তরা থেকে বেলা ১২টায় ‘সাফাত আলী’ বাসে নওগাঁর উদ্দেশে রওনা হন মাসুদ। রাত পৌনে ১১টায় তার বাস পৌঁছায় এলেঙ্গা পর্যন্ত।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দীর্ঘ জটে ক্ষুব্ধ যাত্রীরা এক পর্যায়ে রাস্তায় টায়ারে আগুন দিয়ে ওই পাশ থেকে গাড়ি আসা আটকে দেন।”

সড়কে জটের ধাক্কা কাউন্টারে

রাস্তায় কয়েক গুণ বেশি সময় লাগায় উত্তরবঙ্গের বাসের সূচি এলোমেলো হয়ে পড়েছে, তাতেও ভুগতে হচ্ছে ঈদে ঘুরমুখী মানুষকে।

শনিবার ঢাকার প্রধান দুটি টার্মিনাল- মহাখালী ও গাবতলীতে বাসের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে। এই দুই টার্মিনাল থেকে মূলত উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিম জনপদের গাড়িগুলো চলাচল করে।

সকালে মহাখালী টার্মিনালে কথা হয় ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক নেতা মেহেদি মিতার সঙ্গে।

রাত ১২টায় বাস ছাড়ার কথা থাকলেও কাউন্টার থেকে ছেড়ে যায় দুপুর ১২টার পর। সড়কে যানজটের কারণে ঢাকার বাইরে থেকে বাস ফিরতে দেরি হওয়ার কারণেই এই অবস্থা বলে জানায় পরিবহন কর্তৃপক্ষগুলো। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বগুড়া যাচ্ছি, সকাল ৮টায় বাসে ওঠার কথা ছিল। সে হিসাবে সাড়ে সাতটায়ই আমরা টার্মিনালে পৌঁছেছি। এখন বাজে ১২টা, বাস কখন আসবে তাও কাউন্টার থেকে কেউ বলছে না।”

এ বিষয়ে বগুড়াগামী এসআর ট্রাভেলসের কাউন্টার মাস্টারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বাস রাস্তায় আছে, বেশি সময় লাগবে না, কাছাকাছি চলে এসেছে।”

গাবতলী বাস টার্মিনালেও একই চিত্র দেখা যায়।

এখানে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে বাসের অপেক্ষায় ৬ ঘণ্টা পার করেন একটি বিমা কোম্পানির কর্মকর্তা ফারুক আহম্মেদ রাজু।

“সকাল ৮টায় বাস ছাড়ার কথা এখনও বাসের কোনো খবর নেই। একবার বলে মানিকগঞ্জ আসছে, আবার বলে সাভারে আসছে। দেখি কখন আসে।”

এই অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জননী পরিবহনের কাউন্টার মাস্টার বলেন, “বাস আসলে তো দেখতেই পাবেন।”

ঢাকার গাবতলী বাস টার্মিনালে শনিবার বাসের অপেক্ষায় যাত্রীরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

বাস কখন আসবে জানতে চাইলে গাবতলীর সোহাগ পরিবহনের পরিচালক কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

দুপুরে টেকনিক্যাল মোড়ে শাজাহাদপুর ট্রাভেলসের যাত্রী ঢাকার আইইউবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাকিবুল হাসান বলেন, “প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে বাসের অপেক্ষায় আছি। সকাল সাড়ে নয়টায় বাস ছাড়ার কথা।”

টিকেট কালোবাজারি

সকাল ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত মহাখালী বাস টার্মিনালে সিরাজগঞ্জগামী এসআই এন্টারপ্রাইজ, অভি এন্টারপ্রাইজ ও সেবা লাইনের সব কাউন্টার খোলা থাকলেও টিকেট বিক্রির লোক ছিল না। অথচ যাত্রীরা দাঁড়িয়ে ছিলেন লাইনে।

যাত্রীরা অভিযোগ করেন, এই তিন কোম্পানির টিকেট কালোবাজারিতে বিক্রি করার বিষয়টি গণমাধ্যমে আসায় কাউন্টার খোলা রাখলেও কাউন্টার থেকে টিকেট বিক্রি করা হচ্ছিল না।

ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রোগ্রামার আশরাফুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সকাল ১০টায় এসেছি, এখনও কোনো টিকেট পাচ্ছি না। কাউন্টার খোলা দেখছি, কিন্তু টিকেট বিক্রি হচ্ছে না।

“আমি লাইনে দাঁড়ানোর পর ২৫০ টাকার টিকেট ৮০০ টাকায় বিক্রি শুরু করেছিল। মালিক সমিতির লোকজন এসে বাঁধা দিলে তারা আবার বিক্রি বন্ধ করে চলে যায়।”

বাসের টিকেট নিয়ে কারসাজির অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা

একই অভিযোগ করেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা মনোয়ারুল ইসলাম।

“সকাল আটটায় এসেছি, টিকেট পাচ্ছি না। কিছু টিকেট তারা বিক্রি করে, আবার মালিক সমিতির লোক এলে বাস নাই বলে বিক্রি বন্ধ করে দেয়।”

সিরাজগঞ্জের টিকেটের জন্য সকাল ৯টায় তিন সন্তানকে নিয়ে টার্মিনালে এসেছেন আসমা আক্তার। তিনি বলেন, “বাচ্চাদের নিয়ে অনেক কষ্ট হচ্ছে। ১২টা বাজতেছে এখনও টিকেট পাইনি। কীভাবে বাড়ি যাব? ওদের বাবা ছুটি পায়নি। সিরাজগঞ্জের বাসের কাউন্টার খোলা আছে, কিন্তু কোনো লোক দেখছি না।”

ভাড়া বেশি নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব এনায়েত উল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভাড়া বেশি নেওয়ার সুযোগ নেই। আমরা সার্বক্ষণিক তদারকি করছি।”

কাউন্টার খোলা রেখে বাইরে টিকেট বিক্রির বিষয়ে তিনি বলেন, “এটা আমার জানা নেই, আমি খবর নিচ্ছি।”

সদরঘাটে উপচেপড়া ভিড়

শনিবার সকালে কিছুটা ফাঁকা থাকলেও সন্ধ্যায় সদরঘাটে যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড় দেখা যায়। সকাল ও দুপুরে লঞ্চের ছাদে যাত্রী দেখা না গেলেও বিকালে ও সন্ধ্যায় ছাদে যাত্রী নিতে দেখা যায়।

সন্ধ্যায় অধিকাংশ লঞ্চের ছাদ ও লঞ্চের আনাচ কানাচ ছিল যাত্রীতে টইটুম্বুর।

লঞ্চের ছাদে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ঈদের এই সময়ে তা মানছে না যাত্রীরা। শনিবার বিকালে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে সদরঘাট ছাড়তে দেখা যায় লঞ্চগুলোকে। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

ছাদে যাত্রী নেওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিআইডব্লিউটিএ’র যুগ্ম পরিচালক এ কে এম আরিফ উদ্দিন বলেন, “যাত্রীর চাপ অনেক বেশি। অনেকে গরমের কারণে ছাদে ওঠে। তারপরও একটি সহনীয় পর্যায়ে না হলে আমরা যাত্রীদের নিচে নামিয়ে দিচ্ছি।”

এদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় ৯০টি লঞ্চ সদরঘাট থেকে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যায়।

নৌ পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফরিদা পারভীন বলেন, যাত্রীদের পাশে রান্না করার চুলা রাখায় এবং ক্যান্টিনে রান্না করা মাংস ও কাঁচা মাংস একসাথে রাখায় যুবরাজ-৭ লঞ্চের কর্তৃপক্ষকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন কোস্টগার্ডের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।

এছাড়া আরও কয়েকটি লঞ্চ কর্তৃপক্ষকে জরিমানা করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

ঈদের ভিড়ের সুযোগে লঞ্চে ভাড়া বেশি নেওয়ার অভিযোগ করেছেন অনেকে।

ঈদের ছুটিতে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় যেতে শনিবার বিকালে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ছিল মানুষের উপচে পড়া ভিড়। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তাসরিফ লঞ্চের ব্যবস্থাপক মো. ইকবাল হোসেন বলেন, “ঢাকা থেকে বেতুয়ায় সরকারের নির্ধারিত ভাড়া ৩৭৪  টাকা, কিন্তু আমরা সে ভাড়াটাও নিতে পারছি না। আর ডেকের ভাড়ার চারগুণ হচ্ছে কেবিনের ভাড়া, সেটাও নিতে পারছি না “

আগের দিন শুক্রবার সদরঘাট থেকে ১৫০টি লঞ্চ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় বলে জানান বিআইডব্লিউটিএ ’র পরিবহন পরিদর্শক দিনেশ কুমার সাহা।