ডেঙ্গু: ‘ডেথ রিভিউ’ প্রক্রিয়া বাতিল করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞের

মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে মৃত্যুর তথ্য নিয়ে বিভ্রান্তি থেকে জনমনে আতঙ্ক বাড়ায় সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআরের ‘ডেথ রিভিউ’ প্রক্রিয়া বাতিল করার পরামর্শ দিয়েছেন এ সংস্থারই একজন সাবেক পরিচালক।

নুরুল ইসলাম হাসিববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 August 2019, 03:32 PM
Updated : 8 August 2019, 09:41 AM

অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান বলছেন, ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে কারণ নির্ধারণের জন্য ডেথ রিভিউ’ প্রক্রিয়ার প্রয়োজনই নেই।  

“ক্ষতিপূরণ বা বীমার কোনো বিষয় যদি না থাকে, তাহলে ডেথ রিভিউ কমিটির কোনো দরকারই নেই।”

এ বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নের জবাবে মাহমুদুর রহমান বলেন, “হাসপাতালে পরীক্ষা করে যেখানে ডেঙ্গু শনাক্ত হচ্ছে, চিকিৎসক যেখন বলছেন রোগীর মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে, আপনাকে সেটাই মেনে নিতে হবে। ওই তথ্যটুকুই তো যথেষ্ট।

“কিন্তু আমরা এখন এক ধরনের ধোঁয়াশা সৃষ্টি করছি। আমি যেটা দেখতে পাচ্ছি- ডেঙ্গুতে মানুষ মারা যাচ্ছে আর আপনারা বলছেন এটা ডেঙ্গু নয়। এটা কেবল বিভ্রান্তিই তৈরি করবে।”

আইইডিসিআরের সাবেক এই পরিচালকের মতে, দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ ইতোমধ্যে ‘মহামারির পর্যায়ে’ পৌঁছেছে। তবে একে ‘মহামারি’ ঘোষণা করা হবে কি না, তা সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়। 

অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান হলেন একমাত্র বাংলাদেশি, যিনি বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাবের ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গঠন করা একাধিক বিশেষজ্ঞ কমিটিতে দায়িত্ব পালন করেছেন।

তিনি বলেন, “কোনো দেশ এই রিভিউ করে না। ডেথ রিভিউ কমিটি তখনই দরকার হয় যখন কাউকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রশ্ন আসে।”

চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত রেকর্ড ৩২ হাজার ৩৪০ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য সরকারি খাতায় নথিভুক্ত হয়েছে। এ পর্যন্ত ২৩ জনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

কিন্তু বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্যের বরাতে শতাধিক মানুষের মৃত্যুর খবর এসেছে কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমে। দেশে রাষ্ট্রপরিচালিত সর্ববৃহৎ চিকিৎসাকেন্দ্র ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ডেঙ্গুতে ১৮ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করলেও সেই তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকায় আসেনি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, তাদের হাতে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর যেসব তথ্য প্রতিদিন আসছে, তা পর্যালোচনা করে দেখছে আইইডিসিআরের পরিচালক ডা. মীরজাদী সেবরিনা ফ্লোরার নেতৃত্বাধীন আট সদস্যের ‘ডেথ রিভিউ কমিটি’। তাতে এ পর্যন্ত যাদের ডেঙ্গুতে মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে, কেবল তাদের তথ্যই হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম প্রতিদিন প্রকাশ করছে।

ডা. ফ্লোরা এই প্রক্রিয়ার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এর আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, একটি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার আগে তারা কোনো তথ্য প্রকাশ করতে পারেন না।

“নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমরা তিনভাবে কাজ করি। প্রথমত, সব ক্লিনিক্যাল ডকুমেন্টস, চিকিৎসার তথ্য, হাসপাতালে থাকার সময়কার তথ্য পর্যালোচনা করতে হয়। তারপর আমরা ভার্বাল অটোপসি (মৃত্যুর কারণ বোঝার জন্য উপসর্গ ও শারীরিক অবস্থার তথ্য বিচার) করি, নমুনা সংগ্রহ করি।

“আমরা যখন ল্যাবের পরীক্ষায় পিসিআর (রক্তে ডেঙ্গুর জন্য দায়ী ভাইরাসের জিন অবশেষ) পেয়ে যাই, তখন আমরা সরাসরি বলতে পারি যে ডেঙ্গুতেই তার মৃত্যু হয়েছে। আর বাকি ঘটনাগুলো লিপিবদ্ধ করা হয় ডেঙ্গুর ‘সম্ভাব্য সংক্রমণ’ হিসেবে। মৃতের তালিকায় আমরা সেসব নাম দিই না।”

এটাই যদি আইইডিসিআরের সাধারণ কর্মপদ্ধতি হয়, তাহলে অতীতে মৃতের সংখ্যা নিয়ে এ ধরনের বিভ্রান্তি ঘটেনি কেন?

এই প্রশ্নে মীরজাদী সেবরিনা ফ্লোরার ভাষ্য- “গত বছরও আমরা একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছি। আর গতবারও একই ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি আমাদের হতে হয়েছে। কিন্তু গতবছর ডেঙ্গুর বিস্তৃতি এবারের মত ব্যাপক ছিল না। সে কারণে এত হৈ চৈও হয়নি।”

২০১৭ সালে চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর আইইডিসিআর এই ‘ডেথ রিভিউ’ ব্যবস্থা চালু করে জানিয়ে তিনি বলেন, “কোনো রোগে মৃত্যুর সংখ্যা নিশ্চিত করার জন্য অনেক দেশেই এ ধরনের পদ্ধতি চালু আছে। আমরা সেটাই অনুসরণ করছি।”

কিন্তু অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান বলছেন, হাসপাতাল যদি ডেঙ্গু নিশ্চিত করে, সেরকম ক্ষেত্রে রিভিউয়ের প্রয়োজন নেই। 

“ডেঙ্গুতে আক্রান্ত কেউ যদি স্ট্রোকে মারা যায়, তাহলে আমাদের বলতে হবে ডেঙ্গুতেই তার মৃত্যু হয়েছে। এটাই নিয়ম। হতে পারে তার আরও কিছু সমস্যা ছিল যা মৃত্যুর ক্ষেত্রে প্রভাবক হতে পারে। কিন্তু কেউ কোনো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হলে সেটাই তার মৃত্যুর কারণ বলে ধরতে হয়। 

“আর এটা অস্বীকার করার উপায় নেই বলেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলে থাকে, কারও মধ্যে একাধিক প্রাণঘাতি রোগের লক্ষণ থাকলে তার মৃত্যুর ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় বেশি। অন্তঃসত্ত্বা নারী এবং শিশুদের ক্ষেত্রেও এই ঝুঁকিটা বেশি থাকে।”      

দেশের বর্তমান ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন করলে আইইডিসিআরের সাবেক এই পরিচালক বলেন, সংজ্ঞা ধরে বিবেচনা করলে এ পরিস্থিতিকে মহামারির পর্যায়েই বলতে হয়। 

“তবে এটা নির্ভর করে সরকারের ওপর। এ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি আমাদের ছিল না। ফলে আমরা সহজেই বলতে পারি, এটা মহামারির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।”

অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান বলেন, কোনো রোগকে মহামারি ঘোষণা করা হলে পুরো ব্যবস্থাপনাতেই পরিবর্তন আসবে। সব সংস্থা, সরকারের সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান এ কাজে সম্পৃক্ত হবে। কেনাকাটার ক্ষেত্রে বাড়তি কিছু ক্ষমতা সংস্থাগুলো পাবে, বাড়তি লোকবল নিয়োগ দেওয়া যাবে।

তবে এই পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত না হয়ে জনগণকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন এই বেশেষজ্ঞ। সেই সঙ্গে সরকারকে বলছেন মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছানোর লক্ষ্য নিয়ে পরিকল্পনা সাজাতে। 

ইতোমধ্যে ডেঙ্গু সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে এবং আসন্ন ঈদে লাখ লাখ মানুষ ঢাকা ছেড়ে গ্রামে যাবে বলে ঝুঁকি যে আরও বাড়বে, সে বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়ে  মাহমুদুর রহমান বলেন, “এটা সঙ্কটের সময়। এটা আমাদের বুঝতে হবে।”