ডেঙ্গুর মশা নিধনে ‘ফগিং’ কেবলই ভ্রান্তি: ডব্লিউএইচও বিশেষজ্ঞ

ডেঙ্গুর ভয়ঙ্কর রূপ পাওয়ার কারণ খুঁজতে যখন নানা তর্কবিতর্ক চলছে, আদালতের আদেশে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন যখন বিদেশ থেকে কার্যকর ওষুধ আনার তোড়জোড় করছে, তখনই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একজন বিশেষজ্ঞ জানালেন- বাংলাদেশ হাঁটছে ‘ভুল পথে’।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 August 2019, 03:27 PM
Updated : 6 August 2019, 09:48 AM

ডব্লিউএইচওর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ কীটতত্ত্ববিদ বি এন নাগপাল সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় বলেন, ফগার মেশিনে রাস্তা বা উন্মুক্ত জায়গায় কীটনাশক ছিটিয়ে ডেঙ্গু রোগের বাহক এইডিস মশা মারার আশা কেবলই ‘মিথ’।

“তার বদলে নিজের ঘরবাড়ি পরিচ্ছন্ন রাখুন এবং সকাল-সন্ধ্যা অ্যারোসল স্প্রে করুন, কারণ এইডিস মশা ওখানেই থাকে।”

চলতি বছরের শুরুতে আইসিডিডিআর,বির এক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকা সিটি করপোরেশনে মশা মারতে যে ওষুধ ব্যবহার করা হয় তা আর ‘কার্যকর নয়’।

এরপর জুনের শুরুতে ঢাকায় ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বাড়তে শুরু করে এবং জুলাইয়ের শেষে তা ছড়িয়ে পড়ে দেশের সব জেলায়। ফলে এই সিটি করপোরেশনের মশা নিধন কার্যক্রমে শিথিলতার অভিযোগ ওঠে; মশা মারার কার্যকর ওষুধ কেন কেনা হল না- সেই প্রশ্ন জোরালো হয়ে ওঠে।

এই পরিস্থিতিতে হাতে থাকা ওষুধের ডোজ আর ফগার মেশিন বাড়িয়ে রাস্তা ঘাটে ছিটিয়ে মানুষের আতঙ্ক কমানোর চেষ্টা করতে দেখা যায় দুই সিটি করপোরেশনকে। দুই মেয়রের পাশাপাশি সরকারের মন্ত্রীদেরও ফগার মেশিন হাতে রাস্তায় নামতে দেখা যায় বিভিন্ন কর্মসূচিতে।

দুদিন আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদকের সঞ্চালনায় এক লাইভ আলোচনায় এসে মশার ওষুধের কার্যকরিতা নিয়ে দুই রকম মত প্রকাশ করে ঢাকার দুই মেয়র সাঈদ খোকন ও আতিকুল ইসলাম।

দক্ষিণের মেয়র খোকন দাবি করেন, ‘ফিল্ড টেস্টে’ তিনি দেখেছেন, তাদের ব্যবহৃত ওষুধে ৮৫ শতাংশ মশা মরে। অন্যদিকে উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, পূর্ণ বয়স্ক এইডিস মশার ওপর ওষুধের পরীক্ষায় ভালো ফল পাননি তিনি।

কিন্তু মশা নিয়ে ৪০ বছর ধরে গবেষণা করা বি এন নাগপাল এইডিস মশা মারতে ফগিং মেশিনের প্রয়োগ পদ্ধতি নাচক করে দিয়ে বলেন, সবার আগে এ মশার প্রজননস্থল শনাক্ত ও ধ্বংস করার দিকে নজর দিতে হবে।

একটি পানির বোতলের ঢাকনা দেখিয়ে তিনি বলেন, মাত্র দুই মিলিলিটার পানি পেলেও এইডিস মশা সেখানে বংশ বিস্তার করতে পারে। 

“এইডিস মশা পানির উপরিতলে এমনভাবে ডিম ছাড়ে, যাতে সেগুলো বছরজুড়ে টিকে থাকতে পারে। যখন পাত্র ভরে পানি উপচে পড়ে, তখন সেই ডিম থেকে লার্ভা জন্ম নেয়।”

ড. নাগপাল এইডিসকে বর্ণনা করেন একটি ‘স্মার্ট মশা’ হিসেবে। তিনি বলেন, এ মশা দেয়ালে না বসে টেবিল, বিছানা, সোফা, পর্দা ও ঝুলন্ত কাপড়ের নিচে অন্ধকারে লুকিয়ে থাকে। তাই এসব জায়গায় অ্যারোসল স্প্রে করতে হবে।

“কিন্তু এ মশার প্রজননস্থল চিহ্নিত করাটাই আসল। সাধারণ মানুষের কাছে একটা সহজ বার্তা আমাদের পৌঁছে দিতে হবে। তা হল- আপনার আপনার বাড়ি সপ্তাহে অন্তত এক ঘণ্টা পরিষ্কার করুন।… মানুষের কাছে সঠিক বার্তাটি আমাদের পৌঁছে দিতে হবে কেননা তাদের সক্রিয় না করে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।”   

সবাই যদি ঠিকঠাক নির্দেশনাগুলো অনুসরণ করে তাহলে দশ দিনের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা সম্ভব বলে মত দেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই বিশেষজ্ঞ।

তিনি বলেন, একেক ধরনের মশার বংশবৃদ্ধি আর টিকে থাকার পদ্ধতি একেক রকম। সুতরাং নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও ভিন্নভাবে ভাবতে হবে।

>> ডেঙ্গুর বাহক এইডিস মশা ঘরে থাকে। মাত্র দুই মিলিমিটার পানি পেলেই এ মশা বংশ বিস্তার করতে পারে

>> এইডিস মশা নালা, পুকুর, খাল, নদী বা আবর্জনার স্তূপে বংশবিস্তার করে না

>> পুরুষ মশা রক্ত খায় না, বাঁচে ৭ থেকে ১০ দিন। মেয়ে মশা মানুষের রক্ত খায়, টিকতে পারে চার থেকে ছয় সপ্তাহ।

>> এক দিন পরপর এদের রক্তের প্রয়োজন হয়, আর একবার রক্ত খাওয়ার পর এরা ডিম পাড়ে

>> একবার ডিম পাড়ার জন্য প্রয়োজনীয় রক্ত সংগ্রহ করতে একটি এইডিস মশা ৫ থেকে ১৭ জনের শরীরে হুল ফোটায়

>> দেয়ালে নয়, বিছানা, সোফা, পর্দা ও ঝুলন্ত কাপড়ের নিচে লুকিয়ে থাকে এইডিস মশা

>> এ মশা বেশি সক্রিয় হয় সূর্যাস্তের পর এবং সূর্যোদয়ের আগে; এসব জায়গায় অ্যারোসল স্প্রে করলে সবচেয়ে ভালো ফল মিলতে পারে

>> সেই সঙ্গে সপ্তাহে অন্তত একদিন এক ঘণ্টা ব্যয় করতে হবে ঘর পরিষ্কারে

>> এইডিস মশার লার্ভা নষ্ট করতে ১০ লিটার পানিতে ১ গ্রাম টেমেফস মিশিয়ে ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছে ডব্লিউএইচও

ড. নাগপাল ঢাকায় এসে যে পরামর্শ দিলেন, তাতে মশা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চলমান বিতর্কের একটি সমাধানের পথ মিললো। সেই সঙ্গে এইডিস মশা নিয়ন্ত্রণে নীতি নির্ধারকদের যে অভিজ্ঞতার ঘাটতি, সেটাও আরও স্পষ্ট হল।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর এ পর্যন্ত মোট ২৭ হাজার ৪৩৭ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। কেবল শনিবারই হাসপাতালে গেছেন ২০৬৫ জন ডেঙ্গু রোগী।

একজন সাংবাদিক ড. নাগপালের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, সরকার ছয় মাস আগে সঠিক তথ্য পেলে ডেঙ্গুর ভয়াবহ হয়ে ওঠা ঠেকানো যেত কি না।

উত্তরে তিনি বলেন, “কাজ শুরুর জন্য এ সময়টাও সঠিক। ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা অন্য অনেক দেশের মত এক লাখ, দুই লাখ বা তিন লাখে পৌঁছানোর আগেই সরকার উদ্যোগী হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। 

“আমরা সুযোগ হারিয়ে ফেলেছি এমন নয়। ডেঙ্গুর প্রকোপ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত থাকবে। সুতরাং ডেঙ্গুর সব প্রজননস্থল আমাদের ধ্বংস করতে হবে।”

বাংলাদেশে যখন কয়েক মাস আগে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে শুরু করে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তখন কেন পরামর্শ নিয়ে এগিয়ে এল না- সেই প্রশ্ন ড. নাগপালকে করেছিলেন একজন সাংবাদিক। তবে তিনি এর কোনো উত্তর দেননি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহা পরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ এ সময় বলেন, এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক্ষ, ড. নাগপাল নন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই বিশেষজ্ঞ বলেন, তারা কেবল কারিগরি সহায়তা দিতে পারেন, কিন্তু মানুষের কাছে সঠিক বার্তা পৌঁছে দেওয়ার কাজটি সাংবাদিকরা করতে পারেন।

মশা মারার ওষুধ প্রয়োগ সঠিকভাবে হচ্ছে কি না- সে বিষয়েও নজর দেওয়ার তাগিদ দেন এই কীটতত্ত্ববিদ।

তিনি বলেন, সঠিক ওষুধ সঠিক মাত্রায় এবং সঠিকভাবে দেওয়া না হলে মশার লার্ভা নষ্ট করতে খুব বেশি সাফল্য পাওয়া যাবে না, বরং তাতে পরিবেশ দূষণ হবে।

“ফগারের মাধ্যমে যে ওষুধ ছিটানো হয়, তাতে ৯৫ শতাংশ ডিজেল বা কেরোসিন থাকে। শ্বাসের সঙ্গে তা আমরা টেনে নিচ্ছি, তাতে শ্বাসতন্ত্র আর হৃদযন্ত্রের জটিলতা তৈরি হচ্ছে। এ কারণে ডব্লিউএইচও ফগিংয়ের পরামর্শ আর দেয় না।”

এইডিস মশা উড়ে তিন থেকে চারশ মিটারের বেশি যেতে পারে না; তবে এর লার্ভা পৌঁছে যেতে পারে বহুদূর। আসন্ন ঈদের মৌসুমে যেহে বহু মানুষ ঢাকা ছেড়ে গ্রামে যাবেন, সেহেতু এইডিস মশার অ্যালবোপিকটাস প্রজাতির মাধ্যমে ডেঙ্গুজ্বর আরও বেশি ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।

তবে এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে নাগপাল বলেন, এইডিস ইজিপ্টাই হচ্ছে ডেঙ্গুজ্বরের মূল বাহক। গ্রামে অ্যালবোপিকটাস থাকলেও তা ডেঙ্গুজ্বরের বিস্তারের জন্য তুলনামূলকভাবে কম দায়ী।

“এটা তেমন শক্তিশালী বাহক নয়; বড়জোর শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ থেকে এক শতাংশ বিস্তার ঘটাতে পারে এই প্রজাতি।”