ডেঙ্গু মোকাবেলায় নানা বিষয়ে মতভেদ দুই মেয়রের

ডেঙ্গু মোকাবেলায় বিশেষজ্ঞরা যখন সমন্বিতভাবে কার্যক্রম চালানোর পরামর্শ দিচ্ছেন তখন মশা নিধন কীভাবে হবে, সে বিষয়ে এখনও একমত হতে পারেননি ঢাকার দুই মেয়র।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 August 2019, 06:36 PM
Updated : 4 August 2019, 02:56 AM

ঢাকায় মশা নিধনে ব্যবহৃত ওষুধ কার্যকর না কি অকার্যকর, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে তাদের। এছাড়া বাড়ি বাড়ি মশার লার্ভা ধ্বংস, পশ্চিমবঙ্গের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া, কত দিনে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসবে তার ঘোষণা, মশা নিধনে বিশেষ সেল গঠনসহ বিভিন্ন বিষয়ে ভিন্নমত জানিয়েছেন সাঈদ খোকন ও আতিকুল ইসলাম।

এইডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর প্রকোপের মধ্যে শনিবার রাতে তৌফিক ইমরোজ খালিদী লাইভে দুই মেয়রের আলোচনায় ভিন্নমত প্রকাশ পায়।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদকের এই অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন দুই মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন ও মো. আতিকুল ইসলাম। অনুষ্ঠানটি ফেইসবুকের পাশাপাশি ইউটিউব ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ওয়েবসাইটে সরাসরি দেখানো হয়। 

আইসিডিডিআর,বি’র গবেষণায় মশা নিধনে ‘ওষুধ কাজ না করার’ বিষয়টি সামনে আসার পর এ নিয়ে আলোচনার মধ্যে নতুন কার্যকর ওষুধ আনতে তাগাদা দেয় উচ্চ আদালত। নতুন ওষুধ আনার দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে সিটি করপোরেশনকে।

এইডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় দুই মেয়রকে

ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তারের পেছনে গলদ খুঁজে বের করার এই আলোচনার প্রথমেই মশা নিধনের ওষুধের কার্যকারিতার প্রসঙ্গ আসে।

ওষুধ অকার্যকর মানতে নারাজ ঢাকা দক্ষিণের মেয়র বলেন, দুপুরেও তিনি পরীক্ষায় ওষুধের কার্যকারিতার ‘প্রমাণ পেয়েছেন’।

“অকার্যকর ওষুধ নিয়ে আইসিডিডিআর,বির সঙ্গে আমার দ্বিমত ছিল। যে ওষুধ এখন আমরা ব্যবহার করি সেটা ৯৯ দশমিক ৪০ শতাংশ কেরোসিনের সঙ্গে শুন্য দশমিক ২ শতাংশ পারমেথ্রিন, শুন্য দশমিক ২ শতাংশ টেট্রামেথ্রিন এবং শুন্য দশমিক ২ শতাংশ অ্যালেথ্রিন। আইসিডিডিআর,বি পারমেথ্রিনকে অকার্যকর বলেছে। এটা হচ্ছে কিলিং এজেন্ট। আমি বলেছি, এই ওষুধের একটা অংশ অকার্যকর। পুরোপুরি অকার্যকর নয়।”

সাঈদ খোকন বলেন, গবেষকরা গবেষণাগারে পরীক্ষা করেছেন, তিনি করেছেন মাঠ পর্যায়ে।

“আমি গবেষক নই। আমি রাজনীতিবিদ, আমি মশা ধরেছি, খাঁচার ভেতর ভরে ওষুধ স্প্রে করেছি। ফিল্ড টেস্টে দেখেছি ৮৫ শতাংশ মশা মরে। এ কারণে আমরা নতুন ওষুধ আনার আগ পর্যন্ত এটাই ব্যবহার করছি।”

অন্যদিকে উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, পূর্ণ বয়স্ক এইডিস মশার ওপর ওষুধের পরীক্ষায় ভালো ফল পাননি তিনি।

“আমরা আমদানিকারকের কাছ থেকে ওষুধটা নিয়ে এসেছিলাম। মশারির ভেতর মশা রেখে ওষুধটা প্রয়োগ করেছি। দেখেছি মশা ‘নক ডাউন’ করে নাই। এটা ছয় মাস আগের কথা। আমরা ওই কোম্পানির কাছ থেকে ওষুধ নেওয়া বাদ দিয়েছি। পরে অন্য একটা কোম্পানি থেকে ওষুধ নিয়ে দেখেছি, সেটা এখন কার্যকর আছে।”

বাড়ি বাড়ি গিয়ে লার্ভা ধ্বংসের মাধ্যমে এইডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে বলে মনে করছেন দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন। তিনি বলেন, তারা অভিযান শুরু করার পর ইতোমধ্যেই এর ফল পাওয়া শুরু করেছে লোকজন।

অন্যদিকে উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলামের কাছে সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে ডেঙ্গুমুক্ত করা ‘কঠিন কাজ’।

এইডিস মশা নিধনে নিজেদের নানা কার্যক্রমের বিবরণ দেন ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন

রাজধানীতে কবে নাগাদ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসবে, তার ঘোষণা দেওয়া নিয়েও মতভেদ রয়েছে দুই মেয়রের।

সাঈদ খোকন বলেছেন, আগামী সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসবে।

“আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মশার লার্ভা ধ্বংস করে দিয়ে আসছি। এছাড়া নানা সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাচ্ছি। এসবের ফল আমরা ইতোমধ্যে পেতে শুরু করেছি। ঢাকায় এখন ডেঙ্গু আক্রান্তের গ্রাফ নিম্নমুখী। আমি শতভাগ আশাবাদী, সেপ্টেম্বরের মধ্যে সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসবে।”

তবে কবে নাগাদ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে সে বিষয়ে কোনো নির্ধারিত সময় বেঁধে দিতে চান না উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “যেহেতু একটা হাইলি টেকনিক্যাল ব্যাপার, আমি কীটতত্ত্ববিদদের সঙ্গে কথা বলেছি তারা বলেছেন, যদি বর্ষা থাকে এটা কন্টিনিউ করবে। বর্ষার সঙ্গে এটা খুব বেশি জড়িত। এ কারণে কোনো ডেট আমি দিতে চাই না বা কোনো বার আমি দিতে চাই না।”

পাঁচ মাস আগে মেয়রের দায়িত্ব নেওয়া আতিকুল ইসলাম বলেছেন, এইডিস মশা নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে মাত্রই বুঝতে পারছেন তিনি।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে পশ্চিমবঙ্গের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়ার পক্ষে আতিকুল ইসলাম। অন্যদিকে সাঈদ খোকনের মতে, তারা নিজেরাই সমস্যার মধ্যে আছে।

“আমি তো একেবারেই এটার পক্ষে না। ওরা তো নিজেরটা সামাল দিক আগে, আমারটা কী সামাল দেবে?”

কলকাতার জ্ঞান কাজে লাগাতে চাওয়া আতিকুল ইসলাম বলেন, “বিশ্বের অনেক জায়গায় ভালো ভালো কাজ হচ্ছে। বেস্ট প্র্যাকটিস যদি কিছু থাকে, আমরা সেটা আহরণ করতেই পারি। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে আমরা তথ্য নিয়ে সেগুলো কাজে লাগাতে পারি।”

এইডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু বাংলাদেশে প্রথম দেখা দেয় ২০০০ সালে, সে সময় এই রোগে মারা যান ৯৩ জন। তিন বছর পর থেকে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার কমতে থাকে এবং কয়েক বছর এতে মৃত্যু শূন্যের কোটায় নেমে আসে।

তবে গত বছর আবার ব্যাপকভাবে দেখা দেয় ডেঙ্গু, ১০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি ২৬ জনের মৃত্যু হয় সরকারি হিসাবে। আর শনিবার সকাল পর্যন্ত চলতি বছর দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে ২২ হাজার ৯১৯ জন হয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য।

এ বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ১৮ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে মৃতের সংখ্যা অর্ধশত ছাড়িয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে।

দুই মেয়রই বললেন, মশা নিধনে নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছেন তারা।

জুনের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। এরপর প্রতিদিনই বাড়তে থাকে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় মশা নিধনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে সমন্বিতভাবে ‘ক্র্যাশ’ প্রোগ্রাম চালানোর পরামর্শ দেন অধ্যাপক এবিএম আব্দুল্লাহ।

এক সেমিনারে তিনি বলেছিলেন, “ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির অর্থ নতুন করে এডিস মশার বংশ বিস্তার হচ্ছে। এই পরিস্থিতি উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের যৌথভাবে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম দাবি করে।

“আপনারা যদি এক দিকে কর্মসূচি নেন তাহলে মশা অন্য দিকে উড়ে যেতে পারে। তাই আপনাদের সমন্বিতভাবে কর্মসূচি নিতে হবে।”

লন্ডন সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ডেঙ্গু মোকাবেলায় জনগণকে সম্পৃক্ত করে সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন।