বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ উপাচার্য রশীদ-ই-মাহবুব বলছেন, ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা যেমন করতে হবে, সেই সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে মশা।
আর সেজন্য জেলা-উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসকদের ডেঙ্গু নিয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে, পাশাপাশি বাস, ট্রেন, লঞ্চে করে ডেঙ্গুর বাহক এইডিস মশার ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিনই ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
শুক্রবার ঢাকা মহানগরে ভর্তি হওয়া নতুন রোগীর সংখ্যা আগের দিনের চেয়ে সামান্য কমলেও ঢাকার বাইরে বেড়েছে।
গত কয়েক দিন দেখা গেছে, ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হওয়া রোগীদের প্রায় সবাই আক্রান্ত হয়েছেন ঢাকায় অবস্থান করার সময়। কিন্তু এখন স্থানীয়ভাবে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা জেলার হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে। আর এটাই হয়ে উঠছে ভয়ের কারণ।
ভর্তি থাকা মোট ডেঙ্গু রোগী
সময় | সারা দেশ | ঢাকা সিটির বাইরে |
বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা | ৫৮৩৮ | ১৫০৬ |
শুক্রবার সকাল ৮টা | ৬৫৮২ | ১৯৬৯ |
২৪ ঘণ্টায় নতুন ভর্তি রোগী
সময় | সারা দেশ | ঢাকা সিটির বাইরে |
বুধবার সকাল ৮টা-বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা | ১৭১২ | ৫৬২ |
বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা- শুক্রবার সকাল ৮টা | ১৬৮৭ | ৬৯১ |
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলছেন, এডিস মশা গড়ে তিনশ মিটারের বেশি উড়তে পারে না। তবে কোনো মাধ্যম ব্যবহার করে তারা বহুদূরেও পৌঁছে যেতে পারে। তেলাপোকা এভাবেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়েছে।
“বাস ডিপোতে রাখা একটা বাস বা এয়ারপোর্টে রাখা একটা এয়ারক্রাফট বা অন্য যে কোনো বাহনের দরজা খুলল, মশাটা সেখান গিয়ে আশ্রয় নিল। যানবাহনে রাখা একটা বালতিতে মশা ডিম পাড়ল, সেই বালতিটা চলে গেল শহরের বাইরে। সেখানে গিয়ে পানি পেয়ে ডিম ফুটে মশা জন্ম নিল। এটাকে বলা হয় ডিসপারসন অব অ্যানিমেল।”
অধ্যাপক কবিরুল বাশার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পৃথিবীতে অনেক রোগের বিস্তার এভাবে হয়। ফলে রোগী ছাড়াও অন্যান্য মাধ্যমে ডেঙ্গু রোগ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই।”
তাতে ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তি এবং যানবাহনে করে চলে যাওয়া এইডিস মশার কারণে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা দেখছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। কীটতত্ত্ববিদ ও সিভিল সার্জনরা সেজন্য ঢাকা ছাড়ার আগে যানবাহনগুলোকে মশামুক্ত করার ওপর জোর দিচ্ছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, ডেঙ্গু রোগীর মাধ্যমে এ রোগের বিস্তার ঘটা ঠেকাতে সচেতনতা বাড়ানো ছাড়া আর কোনো পথ তিনি দেখছেন না। ডেঙ্গুবাহী এইডিস মশা যেন রাজধানীর বাইরে আরও বেশি না ছড়াতে পারে, সেজন্য তারা পরিবহন সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ দিয়েছেন।
নওগাঁ জেলায় এখন পর্যন্ত ১৪ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হওয়ার কথা জানিয়েছেন সিভিল সার্জন ডা. মো. মুমিনুল হক। এই রোগীদের প্রায় সবাই ঢাকা ফেরত।
তবে ঢাকা ফেরত যানবাহনে করে এইডিস মশাও যে ডেঙ্গুর জীবাণু নিয়ে নওগাঁয় পৌঁছাতে পারে এবং ডিম ছেড়ে সেখানে ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটাতে পারে- সে বিষয়ে তিনি শঙ্কিত।
“ঢাকা থেকে সেসব বাস আসে, বিশেষ করে এসি বাসগুলোতে করে এইডিস মশা চলে আসতে পারে। তখন সামলানো কঠিন হয়ে যাবে।”
রাজধানীর বাইরে জেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে আছেন কিশোরগঞ্জে। এ জেলার সিভিল সার্জন মো. হাবিবুর রহমান জানান, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সেখানে ১৮৩ জন ডেঙ্গু রোগী ছিলেন। শুক্রবার তা বেড়ে ২১১ জন হয়েছে।
“বেশিরভাগই ঢাকা থেকে ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে এসেছে। তবে চারজনকে আমরা পেয়েছি, যারা আক্রান্ত হয়েছেন এখানেই। তার মানে হল কিশোরগঞ্জেও ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা এসে গেছে। ফলে পরিস্থিতির আরও অবনতি এড়াতে ঢাকা থেকে আসা বাস-ট্রেন মশামুক্ত করা জরুরি।”
“এ কারণে আমি শুরু থেকেই বলছিলাম, ঢাকা থেকে আসা যানবাহন, বিশেষ করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস ও কভার্ড ভ্যানগুলো মশামুক্ত করে ছাড়া দরকার। প্রতিদিন অনেক বাস ফেনী আসে। অনেক কভার্ড ভ্যান ফেনীতে যাত্রাবিরতি করে। সেসব বাহনে করে ডেঙ্গুবাহী এইডিস মশাও এসব এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে পারে।”
ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুর বিস্তার নিয়ন্ত্রণে কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, “সবচেয়ে ভালো হয় যাদের ডেঙ্গু হয়েছে তারা যদি বাইরে ট্র্যাভেল না করেন।
“এ বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও একটা পরামর্শ দিয়েছেন। দ্বিতীয় পরামর্শ হল- বাস, ট্রেন, লঞ্চ, প্লেনসহ সব যানবাহন স্প্রে করে মশামুক্ত করে পাঠাতে হবে।”
তবে ডেঙ্গু রোগীদের ঢাকার বাইরে যাওয়া ঠেকানোর উপায় নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যদি এরকম কিছু থাকত, তাহলে তো ডেঙ্গু ঢাকাতেও ছড়াতো না।”
মহাপরিচালক বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্তরা ঢাকার বাইরে গেলে তাদেরকে যেন মশা না কামড়াতে পারে- সেজন্য সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে।
বাড়িতে মশারি ব্যবহার, ফুলহাতা শাট ও ফুলপ্যান্ট পরা, শরীরে মশা প্রতিরোধী ওষুধ ব্যবহার করা, ঘরে মশার ওষুধ ব্যবহার করা এবং সর্বোপরি নিজের বাড়িঘর পরিষ্কার রাখা- এ নিয়মগুলো মানতেই হবে।
ঢাকা ছেড়ে যাওয়া আন্তঃজেলা বাসে মশক নিধনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মালিকদের নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে বলে জানান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ফেডারেশনের মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ।
শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে তারা মালিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
“আমরা ঢাকার বিভিন্ন টার্মিনালের মালিকদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছি। ডেঙ্গু নিয়ে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছি আমরা। রোববার আমাদের এ বিষয়ে একটা মিটিং আছে। সেখানে আমরা সব মালিকদের ডেকেছি।
“তাদের আমরা বলব যেন গাড়িগুলোকে মশামুক্ত করে ছাড়া হয়। এ ছাড়াতো বিকল্প কিছু নাই। এটা সারাদেশে সার্কুলার আকারে জানাব।”
শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে তারা কমলাপুর ও ঢাকা বিমানবন্দর রেলস্টেশন এলাকায় পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চালিয়েছেন।
“আমরা আমাদের স্টেশনগুলো পরিষ্কার রাখছি যেন এইডিস মশার বিস্তার না ঘটে। যেকোনো ট্রেন কমলাপুর স্টেশনে এলে ওয়াশফিডে নিয়ে পরিচ্ছন্ন করা হয়, জীবাণুমুক্ত করা হয়। জীবন্ত মশা যেন ট্রেনে থাকতে না পারে সেজন্য আমরা প্রতিটি ট্রেনে মশার ওষুধ স্প্রে করে দেব। এজন্য কিছু ফগার মেশিনও কেনা হবে।”
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমডোর এম মাহবুব-উল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এইডিস মশার বিস্তার রোধে তারাও কাজ করছেন। লঞ্চ মালিকদের ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
“আমরা গত রোববারই বৈঠক করেছি। দেশের বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী লঞ্চের মালিকদের নির্দেশ দিয়েছি যাত্রী তোলার আগে লঞ্চগুলোকে মশামুক্ত করে নেওয়ার জন্য। তারা ঠিকমত এটা করছে কিনা তা তদারক করার জন্য প্রতিটি বন্দরের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।”