ঢাকার বাইরে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী, সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা

ঢাকায় ব্যাপক হারে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের মধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলার হাসপাতালে বাড়ছে মশাবাহিত এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা, যাদের অধিকাংশই ঢাকা থেকে রোগটি নিয়ে যাচ্ছেন বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 July 2019, 07:12 PM
Updated : 27 July 2019, 07:12 PM

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বাইরে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে গত একদিনের ব্যবধানে ডেঙ্গু রোগী বেড়েছে ১২৬ জন। এ বছরের পহেলা জানুয়ারি থেকে ২৭ জুলাই পর্যন্ত ঢাকার বাইরে ৩৭৩ জন ডেঙ্গু রোগী চিহ্নিত হয়েছে, যা একদিন আগেও ছিল আড়াইশ’র নিচে।

সরকারি হিসাবে গত বছর ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ছিল পাঁচজন। সেখানে এ বছরের প্রথম সাত মাসেই ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৩৬৮ জন বেশি।

জেলা পর্যায়ের চিকিৎসকরা বলছেন, প্রতিদিনই নতুন নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছেন হাসপাতালে। সঙ্কটাপন্ন রোগীর ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না থাকায় ডেঙ্গু আক্রান্তদের অনেককে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

রাজধানীর বাইরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নেওয়া অধিকাংশই ঢাকা থেকে গেছেন বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ডা. সানিয়া তহমিনা।

তিনি শনিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আজ আমরা ঢাকার বাইরের যেসব জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে সেসব হাসপাতালের পরিচালকদের সঙ্গে কথা বললাম। তারা জানাল, যে কেসগুলো পাওয়া গেছে তার প্রায় ৯৫ ভাগই ঢাকা থেকে গিয়েছে। এ বিষয়ে কী করা যায় সেসব বিষয়ে পরামর্শ ও নির্দেশনা আমরা কাল সংবাদ সম্মেলনে জানাব।”

দেশজুড়ে প্রাণঘাতী এই ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়া অস্বাভাবিক নয়। মানুষ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায়। এডিস মশাও এখন সবখানেই আছে। একজন ডেঙ্গু রোগী ঢাকার বাইরে গেলে এডিস মশা তাকে কামড়ে আবার অন্য কাউকে কামড়াল, এভাবে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।

“এজন্য মানুষের সচেতন হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।”

এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু বাংলাদেশে প্রথম দেখা দেয় ২০০০ সালে, সে সময় এই রোগে মারা যান ৯৩ জন। তিন বছর পর থেকে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার কমতে থাকে এবং কয়েক বছর এতে মৃত্যু শূন্যের কোটায় নেমে আসে।

তবে গত বছর আবার ব্যাপকভাবে দেখা দেয় ডেঙ্গু, ১০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি ২৬ জনের মৃত্যু হয় সরকারি হিসাবে। আর এবার বছরের শুরুর দিন থেকে শনিবার (২৭ জুলাই) পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১০ হাজার ৫২৮ জন ডেঙ্গু রোগী। গত ২৪ ঘণ্টায় শুধু ঢাকার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেই ভর্তি হয়েছেন ৬৪৩ জন ডেঙ্গু রোগী।

ঢাকায় ডেঙ্গু রোগীর চাপ এত বেশি যে নতুন করে এই রোগে আক্রান্তদের অনেকেই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। এরইমধ্যে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলার হাসপাতলে ডেঙ্গু রোগী বৃদ্ধির খবর আসছে।

গত বছর সারা দেশে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দুই হাজার ৭৬৭ জন ডেঙ্গু রোগী চিহ্নিত হয়েছিল। সেখানে এ বছর ২৭ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা গতবারের মোট আক্রান্তের চেয়ে বেশি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের হিসাবে, ২৭ জুলাই সকাল ৮টা পর্যন্ত ঢাকার বাইরে ৩৭৩ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১২৮ জন হাসপাতালে ভর্তি আছেন, বাকি ২৪৫ জনকে চিকিৎসা শেষে বাড়ি পাঠানো হয়েছে।

২৬ জুলাই পর্যন্ত ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ছিল ২৪৭ জন, হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ৪৭ জন। ২৭ জুলাই তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭৩ জনে। অর্থাৎ একদিনেই রোগী বেড়েছে ১২৬ জন।

গত বছর ঢাকার বাইরে কতজন ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায় সে পরিসংখ্যান জানাতে পারেননি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা।

তবে আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত বছর ঢাকার বাইরে পাঁচজন ডেঙ্গু রোগীর তথ্য পেয়েছিলেন তারা।

এবার ঢাকার বাইরে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী দেখা গেছে গাজীপুরে। শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৬১ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এরপর ফেনী জেলায় ৪৯ জন এবং বগুড়ায় চিহ্নিত হয়েছেন ৪০ জন ডেঙ্গু রোগী।

এছাড়া মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে তিনজন, কিশোরগঞ্জে একজন, নারায়ণগঞ্জে ১৩ জন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৫ জন, চট্টগ্রাম জেলা হাসপাতালে ২৪ জন, কুমিল্লায় একজন, চাঁদপুরে ২৯ জন, লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালে চারজন, নোয়াখালী জেলা হাসপাতালে পাঁচজন, কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ১৯ জন, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৪ জন, যশোর ২৫০ শয্যার হাসপাতালে ২০ জন, ঝিনাইদহের ২৫০ শয্যা হাসপাতালে তিনজন, বগুড়ায় ৪০ জন, বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৬ জন এবং বরিশাল জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে নয়জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে।

বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন গাজীপুরে ১৪ জন, বগুড়ায় ২৯ জন, মুন্সীগঞ্জে তিনজন, নারায়ণগঞ্জে দুই জন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৬ জন, জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে সাতজন, ফেনীতে চারজন, চাঁদপুরে চারজন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একজন, লক্ষ্মীপুরে দুইজন, নোয়াখালীতে একজন, কুষ্টিয়ায় পাঁচজন, খুলনায় আটজন, যশোরে ১২ জন, বরিশালে ১২ জন এবং সিলেটে আটজন ডেঙ্গু রোগী।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকায় ঢাকার বাইরের বেসরকারি কোনো হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর তথ্য নেই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবের বাইরে কুড়িগ্রামে একজন এবং শেরপুরে তিনজন ডেঙ্গু রোগী শনাক্তের খবর জানিয়েছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জেলা প্রতিনিধিরা।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ফেনীতে যারা চিকিৎসা নিয়েছেন বা নিচ্ছেন তাদের প্রায় সবাই ঢাকা থেকে এই রোগ নিয়ে গেছেন বলে মনে করছেন ফেনী ২৫০ শয্যা হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. আবু তাহের পাটোয়ারি।

“তাদের কেউ ঢাকায় চাকরি করেন, কেউ ট্রেনিংয়ে গেছেন, কেউবা কোচিং করতে ঢাকা গিয়েছেন ফিরে এসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।”

একই তথ্য দিয়েছেন বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক স্বপন কুমার সরকার।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে প্রথম ভর্তি হন বরিশাল নগরীর ঝাউতলার বাসিন্দা রিফাতুল ইসলাম।

“তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করতে ঢাকায় গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে কোচিং শেষ না করেই বরিশালে ফিরে আসনে। পরে ডাক্তারের কাছে গেলে তার রক্ত পরীক্ষায় ডেঙ্গুর উপস্থিতি পাওয়া যায়।”

শনিবার ঢাকার বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দেখা যায় মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের উত্তম বনিককে।

তিনি জানান, মঙ্গলবার থেকে জ্বরে ভুগছেন। শুক্রবার এই হাসপাতালে আসলে পরীক্ষার পর ডেঙ্গু ধরা পড়ে।

সপ্তাহ দুয়েক আগে ঢাকায় আসার পর তাকে এডিস মশা কামড়েছে বলে ধারণা উত্তমের।

“আমাদের এলাকায় মশার উৎপাত কম। এডিস মশা আছে কি না জানি না। গত সপ্তাহে পিজি (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) হাসপাতালে আসছিলাম এক আত্মীয়কে দেখতে। মনে হয়, সে সময় ডেঙ্গু মশা কামড় দিয়েছে।”

ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গাইবান্ধা জেলা সদর আধুনিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাশেদুল ইসলাম (২২), প্রিয়া আকতার (২০) ও সাগর খন্দকার (১৯) ঢাকা থেকেই এই রোগ নিয়ে গেছেন বলে সেখানকার একজন চিকিৎসকের ভাষ্য।

ওই হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মাহফুজার রহমান বলেন, গত সোমবার সাগর প্রচণ্ড জ্বর ও মাথাব্যাথা নিয়ে হাসপাতালে আসেন।

“পরে তার রক্ত পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যায় তিনি ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। সাগর ঢাকায় একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন। সেখানে থাকা অবস্থায় তিনি এই ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হন।

“প্রিয়া কয়েকদিন আগে ঢাকায় তার বোনের বাড়ি বেড়াতে যান। সেখানে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে গাইবান্ধায় ফিরে আসেন। রাশেদুল ঢাকায় লেখাপড়া করেন। তিনিও ঢাকায় ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হন।”

তবে ঢাকার বাইরেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। ঢাকার পাশের নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার রূপসী গন্ধর্বপুর এলাকার গৃহিণী শিল্পী বেগম ১১ বছরের সন্তান সিয়াম হোসেন শান্তকে ভর্তি করিয়েছেন ঢাকা ন্যাশনাল হাসপাতালে।

শিল্পী বলেন, তারা সব সময় রূপগঞ্জেই থাকেন। সেখানে ডেঙ্গু হতে পারে তার ধারণা ছিল না।

“আমাগোর এলাকা গ্রামের মতো। মোশা আছে কিন্তুক খুব বেশি না। হেইখানে ডেঙ্গু মশা ক্যাম্নে কামড়াইল কিছুই বুজবার পারতাছি না। জ্বর হওয়ার পর মিটফোর্ড হাসপাতালে আনি, ডাক্তাররা পরীক্ষা কইরা কয় হের নাকি ডেঙ্গু অইছে। কয়েকটা হাসপাতাল ঘুইরা এইহানে সিট পাইছি।”

বরগুনা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু আক্রান্ত হালিমা বেগম জানান, বরগুনা সদর উপজেলার আয়লা পাতাকাটা ইউনিয়নের কদমতলা গ্রামের বাড়িতেই থাকেন তিনি। সম্প্রতি তিনি কোথাও বেড়াতেও যাননি। হঠাৎ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসকরা তার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার কথা জানান।

এদিকে জেলার হাসপাতালগুলোতে সংকটাপন্ন ডেঙ্গু রোগীদের সামলানোর জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু নেই বলে জানান ফেনী ২৫০ শয্যা হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. আবু তাহের পাটোয়ারি।

“রোগ নির্ণয়ের সব ব্যবস্থা এখানে আছে। কিন্তু প্লাটিলেট বেশি মাত্রায় কমে গেলে তাদের রেফার্ড করে দিতে হয়। কারণ এই সব রোগীদের প্লাটিলেট দেওয়ার জন্য ডোনারের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ করে তার থেকে প্লাটিলেট আলাদা করার ব্যবস্থা আমাদের নেই।”

অবস্থা গুরুতর হওয়ায় এখন পর্যন্ত পাঁচজন ডেঙ্গু রোগীকে ঢাকায় পাঠিয়েছেন বলে জানান তিনি।