রেনুর কথা ‘বুঝতে চায়নি কেউ’

একজন মা কেন মাঝ বছরে বাচ্চাকে ভর্তি করার তথ্য নিতে স্কুলে আসবেন- সেই সন্দেহ করেছিলেন কয়েকজন অভিভাবক। সেই সন্দেহ থেকে তারা জানতে চেয়েছিলেন ঠিকানা, কিন্তু তাতে তাদের সন্দেহ আরও বাড়ে। 

ফয়সাল আতিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 July 2019, 06:31 PM
Updated : 23 July 2019, 06:31 PM

সন্দেহ থেকে ডানা মেলে গুজব; বাইরে থেকে দল বেঁধে ঢোকে কয়েকজন কিশোর-তরুণ। উত্তর বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিচ তলার কলাপসিবল গেইটের তালা ভেঙে টেনে হিঁচড়ে প্রধান শিক্ষকের কক্ষ থেকে বের করে আনা হয় দুই সন্তানের মা তাসলিমা বেগম রেনুকে।

স্কুলের গেইটে এনে মাটিতে ফেলে ‘ছেলেধরা’ আখ্যা দিয়ে যখন তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হল, চারপাশ ঘিরে ছিল শতাধিক মানুষ, তাদের অনেকেরই হাতে ছিল মোবাইল ফোন, সবাই ভিডিও করতে ব্যস্ত। 

গত শনিবার সকালের ওই হত্যাকাণ্ডের একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, প্রধান শিক্ষকের কক্ষে বা সেখান থেকে বের করে আনার সময় ৪২ বছর বয়সী ওই নারীর কথা কেউ বুঝতে চাননি। 

পরিস্থিতি বেসামাল দেখে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুলিশে খবর দিলেও মূল হামলাকারীরা বেশি সময় নেয়নি, শুনতে চায়নি কোনো কথা।

অভূতপূর্ব ওই হামলা আর মানুষের রোষ দেখে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় পড়ে গিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন শিক্ষকরা।

উত্তর বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে আলী মোড় এলাকাতেই এক সময় থাকতেন রেনু। পারিবারিক কলহের কারণে দুই বছর আগে স্বামী তসলিম হোসেনের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয়ে যায়। 

এরপর ১১ বছরের ছেলে তাহসিন আলমাহিদ আর চার বছরের মেয়ে তাসমিন তুবাকে নিয়ে মহাখালীর ওয়্যারলেস গেইট এলাকার এক বাসায় থাকছিলেন রেনু।

স্বজনরা জানান, শনিবার সকালে উত্তর বাড্ডায় ওই স্কুলে তিনি গিয়েছিলেন মেয়ে তুবাকে ভর্তি করা যায় কি না- সেই খোঁজ খবর নিতে। পরে হাসপাতালের মর্গে রেনুর লাশ শনাক্ত করেন তার ভাগ্নে সৈয়দ নাসির উদ্দিন টিটু।

ঘটনার তিন দিন পর মঙ্গলবার সকালে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ। যারা দোকান খুলেছেন, তারাও ঘটনার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন না বলে দাবি করেছেন।

তবে কথা বলেছেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন অভিভাবক, শিক্ষকরাও সেই ভয়াবহ দৃশ্যের কথা বর্ণনা করেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে। 

গণপিটুনির শিকার রেনু হামলাকারীদের সন্দেহের মুখে পড়ার আগে কাউকে অপহরণের চেষ্টা করেছেন- এমন কথা কেউ বলেননি।

সন্দেহ থেকে উত্তেজনা

অন্যদিনের মতই সেদিন সকালে নিজের ছেলেকে স্কুলে দিয়ে মাঠে বসেছিলেন ত্রিশোর্ধ হাসনা বেগম। স্কুলের গেইটে রেনুর ওপর উন্মত্ত জনতার হামলা নিজ চোখেই দেখেছেন তিনি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, হামলাকারীদের অধিকাংশই ছিল বয়সে কিশোর-তরুণ।

ঘটনার বর্ণনায় হাসনা বলেন, অন্যদিনের মতই সেদিন সকাল ৮টা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের অ্যাসেম্বলি চলে। জাতীয় সংগীত চলার সময় অপেক্ষমাণ অভিভাবকদের ভিড়ের মধ্যে অপরিচিত রেনুকে দেখে তার পরিচয় জানতে চান কয়েকজন নারী।

“তিনি একবার বলেছেন জাতীয় সংগীত শুনতে স্কুলে ঢুকেছেন্ আবার বলেন সন্তানকে এখানে ভর্তি করানো যাবে কিনা তা জানতে এসেছেন।

“বছরের মাঝামাঝি সময়ে ভর্তির কথা পছন্দ না হওয়ায় আরও কয়েকজন অভিভাবক তখন ওই মহিলার বাসা কোথায় জানতে চান। তখন উনি বলেন- তার বাসা আলীর মোড় এলাকায় (স্কুল থেকে কয়েকশ গজ দূরে)।

একজন অভিভাবক তখন বলেন, ‘চলেন আপনার বাসায় গিয়ে দেখি।’ এই সময় ওই মহিলা (রেনু) বলেন, আমি বর্তমানে মহাখালী ওয়্যারলেস এলাকায় থাকি, তবে শিগগিরই আলীর মোড়ে বাসা নেব।”

“রেনু তার বাসা নিয়ে আরও কিছু বলতে চাইছিলেন। কিন্তু কেউ তার কথা শুনতে চায়নি।”

অ্যাসেম্বলি মাঠ থেকে বিদ্যালয়ের ভবনে প্রবেশ করতে একটি কলাপসিবল গেইট পার হতে হয়। উত্তেজনার এক পর্যায়ে রেনু দ্বিতীয় তলায় প্রধান শিক্ষকের কাছে যেতে চান। আয়া জান্নাত বেগম তাকে বলেন, বছরের মাঝামাঝি ভর্তির সুযোগ কোনো নেই।

অপেক্ষমাণ অভিভাবকরা তখন আরও ক্ষেপে যান। কেউ কেউ ‘ছেলে ধরা’ আখ্যায়িত করে রেনুকে মারতে উদ্যত হন। কয়েকজন তখন তাকে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে নিয়ে যান।

আয়া জান্নাত জানান, উত্তেজনা দেখে নিচ তলার কলাপসিবল গেইটে তিনি তালা মেরে দিয়েছিলেন। কিন্তু বহু মানুষ ততক্ষণে মাঠে জড়ো হয়েছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই তারা তালা ভেঙে দোতলায় উঠে যায়।

প্রধান শিক্ষক শাহনাজ বেগম ও সহকারী শিক্ষক জিয়াউর রহমান বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসা লোকজন রেনুকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে নামিয়ে নিয়ে যায়। এরপর শুরু হয় মারধোর।

শিক্ষকরা ছিলেন আতঙ্কিত

উত্তর পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে সাতশ। দুইজন শিক্ষক এবং ১২ জন শিক্ষিকা রয়েছেন তাদের পাঠদানের দায়িত্বে।

শিক্ষক আব্দুল গফুর তালুকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অ্যাসেম্বলি মাঠে কী হচ্ছে তা অনেক শিক্ষকই প্রথমে বুঝে উঠতে পারেনি। ক্লাস বসার পর যখন অনেক লোক মাঠে ঢুকে পড়ল, তখন তারা দরজা বন্ধ করে দিয়ে ভেতরে অবস্থান নিয়েছেন আতঙ্কে।

“জিয়া স্যার এবং শাহনাজ ম্যাডাম ওই লোকজনকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে নাজেহাল হয়েছেন। পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ আসার আগেই ওরা ছোঁ মেরে মহিলাটা নিয়ে যায়।”

কী ঘটেছিল জানতে চাইলে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন পঞ্চাশোর্ধ এক শিক্ষিকা। তবে তিনি নিজের নাম বলতে চাননি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা হতভাগা। আমাদের চোখের সামনে একজন মাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এতো মানুষের স্রোতে সেখানে কারও কিছু করার ছিল না।“

বাড্ডা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক জানান, ওই বিদ্যায়ের এক শিক্ষিকা থানায় ফোন করেছিলেন। কিন্তু ফোর্স সেখানে যাওয়ার আগেই সবকিছু ঘটে যায়।

‘এখন বলে লাভ কি?’

দুই বছর আগে রেনুরা যখন আলীর মোড়ে থাকতেন, তার বড় ছেলে বাড্ডা প্রাইমারি স্কুলের পাশেই আরেকটি স্কুলে পড়ত।

প্রত্যক্ষদর্শী হাসনা বলেন, “ওই নারী (রেনু) আলীর মোড়ে থাকা কিংবা মহাখালীতে থাকার বিষয়টি স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কেউ তার কথা শুনছিল না। সবাই শুধু প্রশ্ন করছিল। ওই মহিলা বোঝানোর চেষ্টা করলেও কেউ বুঝতে চায়নি।”

এখন আর এসব বলে কি লাভ- সেই প্রশ্ন করেন রেনুর বোনের ছেলে নাসির উদ্দিন টিটু।

তিনি বলেন, “আমার খালা প্রতিদিন সকালে হাঁটতে বের হত। যে এলাকায় সেদিন গিয়েছিলেন, সেটা ছিল তার জীবনের অনেক স্মৃতি বিজড়িত জায়গা। তিনি কোনো অসংলগ্ন কথা বলেছিলেন বলে আমাদের বিশ্বাস হচ্ছে না।

“আলীর মোড়েও তিনি এক সময় ছিলেন। এখন তিনি মহাখালীর বাসায় থাকছিলেন। ছোট্ট তুবাকে কোথাও ভর্তি করানোর ইচ্ছা তার ছিল। এখানে অসংলগ্নতার কিছু নেই্ কিন্তু ওদের মাথায় যেটা সেট হয়ে আছে (ছেলে ধরা), তা থেকে তারা বের হতে পারেনি।

গা ঢাকা দিয়েছেন অনেকে

সাঁতারকুল রোড থেকে যে গলিটি থানা রোডের দিকে গেছে, তার মুখেই উত্তরপূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলের বিপরীত পাশে রয়েছে উত্তর বাড্ডা কমিল মাদ্রাসা।

দুই প্রতিষ্ঠানের কারণে গলির প্রবেশ পথে সকাল থেকেই ফেরিওয়ালা ও হকাররা বসে রাস্তার দুই ধারে। পাশপাশি রয়েছে মুদি দোকান, রেস্তোরাঁ, পান দোকান, কনফেকশনারি, স্টেশনারি দোকান। ফলে সকালেই বেশ ভিড় থাকে সেখানে।

ঘটনার দিন এসব দোকান থেকেই প্রথমে জনতা হুমড়ি খেয়ে পড়ে বিদ্যালয়ের ভেতরে। মঙ্গলবার স্কুল গেইটের অনেক দোকান বন্ধ পাওয়া যায়। চিহ্নিত কয়েকজন গ্রেপ্তার হওয়ার পর অনেকেই গা ঢাকা দিয়েছেন।

গেইটের বিপরীত পাশে একটি স্টেশনারি দোকানের মালিক মামুন বলেন, ঘটনার শুরু থেকে তিনি এলাকায় ছিলেন না। সকাল ১০টার সময় দোকান খুলতে এসে পরিস্থিতি জানতে পারেন।

প্রায় একই ধরনের কথা বলেন প্লাস্টিক ব্যবসায় ইমাদুল ইসলাম রনিসহ আরও কয়েকজন দোকানি।

তবে ওই হামলায় হৃদয় নামের এক ভ্রাম্যমাণ সবজি বিক্রেতার অগ্রণী ভূমিকা ছিল বলে জানিয়েছেন স্থানীয় অন্তত ৫ জন দোকনি।

বাড্ডা থানার পরিদর্শক  (তদন্ত)  মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “মানুষের হুজুগ ও অতি উৎসাহের বলি হয়েছেন দুই সন্তানের জননী রেনু। বিচ্ছেদের পর থেকে কিছুটা মানসিক অবসাদেও ভুগছিলেন বলে স্বজনরা জানিয়েছেন। ওই ঘটনায় জড়িতদের ধরতে পুলিশের তৎপরতা চলছে।”

আতঙ্ক

‘পদ্মা সেতুর জন্য মানুষের মাথা লাগবে’- এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ার পর সারা দেশেই সন্দেহের ওপর ভরে করে গণপিটুনি চলছে।

এসব ঘটনার কোনোটির পেছনেই অপহরণ চেষ্টার কোনো আলামত পায়নি পুলিশ। মানসিক ভারসাম্যহীন কয়েকজনও গণপিটুনির শিকার হয়েছেন শুধু সন্দেহের কারণে।  

এই পরিস্থিতিতে জরুরি কাজেও অপরিচিত এলাকায় যেতে ভয় পাচ্ছেন অনেকে।

উত্তর বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুল গফুর বলেন, ঢাকায় এখন ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ চলছে। বাসায় বাসায় গিয়ে তাদের ভোটার তালিকার তথ্য সংগ্রহ করার কথা।

“আমার একজন পরিচিত স্যার সাঁতারকুল এলাকার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর লোকজন তাকে নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতে শুরু করে। তখন তিনি কাজ না সেরেই ওই এলাকা থেকে সরে আসেন।”

গফুর বলেন, “আমার নিজেরও ভোটার তালিকার তথ্য সংগ্রহ করার দায়িত্ব পড়েছে। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে অপরিচিত এলাকায় যাওয়া শঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।”