মশার ওষুধ অকার্যকর- মানতে নারাজ সাঈদ খোকন

ঢাকার মশা মারার ওষুধের মূল উপাদান অকার্যকর প্রমাণিত হলেও মেয়র সাঈদ খোকন বলছেন, আইসিডিবিআর,বির ওই গবেষণায় সিটি করপোরেশনের ওষুধের নমুনা নেওয়া হয়নি বলে এটি অকার্যকর মানতে চান না তিনি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 July 2019, 02:39 PM
Updated : 23 July 2019, 08:51 PM

তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন আওতাধীন এলাকায় ব্যাপকহারে মানুষের মশাবাহিত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার কারণ সম্পর্কে কোনো ব্যাখ্যা তিনি দেননি। ওই গবেষণার ফলও সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেননি তিনি।

গত মাসের শুরুর দিকে ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়, যা এ মাসে ব্যাপক আকার নিয়েছে। বর্তমানে ডেঙ্গু রোগীর চাপ এত বেশি যে তাদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। ঢাকার বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে নতুন রোগী ভর্তি করাই এখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, মঙ্গলবার পর্যন্ত পাঁচ হাজার ৬৩৭ জন মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪৭৩ জন ডেঙ্গু রোগী।  আর ডেঙ্গুতে অন্তত ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

ডেঙ্গুর প্রকোপের মধ্যে মঙ্গলবার মশার ওষুধের কার্যকারিতা এবং মশক নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে নতুন ওষুধ নির্ধারণ বিষয়ক সভা হয় নগর ভবনে। ওই সভা শেষে মেয়র সাঈদ খোকন সাংবাদিকদের বলেন, আইসিডিডিআর,বি যে রিপোর্টটি দিয়েছে, সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে তা আমলে নেওয়ার সুযোগ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নেই।

“সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আইইডিসিআর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিলে সে ওষুধ আমরা ব্যবহার করি। বৈঠকে অ্যাডাল্টিসাইডিংয়ে ব্যবহৃত ওষুধ নিয়ে প্রশ্ন এসেছে, এ অবস্থায় আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি বর্তমানে আমাদের ব্যবহৃত ওষুধের নমুনা আমরা আইইডিসিসিআরে পাঠিয়ে দেব। যদি ওষুধের একটা অংশ অকার্যকর থাকে এবং তাহলে তার পরিবর্তে কোন ওষুধ ব্যবহার করা যায় সেটা তারা আমাদের জানাবেন। আমরা তাদের পরামর্শ নিয়ে ডব্লিউএইচওর থেকে অনুমোদন নিয়ে ব্যবহার করব।”

আইসিডিডিআর,বি কিসের ভিত্তিতে গবেষণা করেছে, তাদের গবেষণালব্ধ ফল কী সে বিষয়ে কথা বলতে সভায় থাকা আইসিডিডিআর,বির সহযোগী বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ সফিউল আলমকে আহ্বান জানান মেয়র।

সফিউল আলম সাংবাদিকদের জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি প্রতিষ্ঠান সিডিসির কারিগরি সহযোগিতায় তাদের সঙ্গে নিয়ে এই গবেষণা করা হয়েছে।

“আমরা ওষুধে ব্যবহৃত মূল উপাদানগুলো দেখেছি। কিন্তু ফিনিশড প্রোডাক্টটা নিয়ে গবেষণা করি নাই। ফিনিশড প্রোডাক্ট নিয়ে ম্যান্ডেট আছে আইইডিসিআরের, তারা গবেষণা করবে। আমরা যেটা দেখেছি এডিস মশা পারমেথ্রিনের পুরোপুরি রেজিস্ট্যান্ট হয়ে গেছে। এটা যেহেতু অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আর এটাই রেজিস্ট্যান্ট হয়ে গেছে, সে হিসেবেই আমরা প্রতিবেদনটা দিয়েছি।”

ফিনিশড প্রোডাক্ট নিয়ে গবেষণা করেননি কেন- একজন সাংবাদিকের এমন প্রশ্নে শফিউল ইসলাম বলেন, “একটা ফিনিশড প্রোডাক্টে তিনটা জিনিস থাকে। তার মধ্যে একটা হল… আমরা এমন বিতর্কে যাব না।”

এ পর্যায়ে শফিউল ইসলামের কাছ থেকে মাইক্রোফোন নিয়ে মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ডিএসসিসির ওষুধের নমুনা নিয়ে তারা গবেষণা করেনি।

“তারা তাদের মতো করে একটি এজেন্ট নিয়ে গবেষণা করেছেন। যে বিভ্রান্তিটা ছড়িয়েছে, সিটি করপোরেশন যে ওষুধ ব্যবহার করছে সেটা সম্পূর্ণভাবে অকার্যকর। আমরা আজ বৈঠকে আলোচনায় বুঝতে পারলাম, সিটি করপোরেশনের ব্যবহৃত ওষুধ নিয়ে গবেষণা হয়নি। তারা তাদের মতো করে একটি এজেন্ট নিয়ে গবেষণা করেছে।”

এ সময় ড. মোহাম্মদ শফিউল আলম কথা বলতে চাইলে মেয়র বলেন, “আমি শেষ করি।

“যে বিভ্রান্তিটা ছড়িয়েছে সিটি করপোরেশন যে ওষুধ ব্যবহার করছে তার স্যাম্পল নিয়ে গবেষণা হয়নি। তার ফল দেওয়া হয়েছে, কারণ যা-ই থাকুক এই বক্তব্যের পরে এর অবসান হবে।”

মেয়র একথা বলার পর সাংবাদিকরা আইসিডিডিআর,বির প্রতিনিধির বক্তব্য শুনতে চান। তবে মেয়র সবাইকে নিয়ে তার কার্যালয়ে চলে যান। কিছুক্ষণ পর সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে আবার সাংবাদিকদের সামনে আসেন সাঈদ খোকন।

এ সময় তার সঙ্গে আইসিডিডিআর,বি, আইইডিসিআর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ছিলেন না।

সাঈদ খোকন সাংবাদিকদের আবারও বলেন, “আইসিডিডিআর,বি যে রিপোর্টটি করেছে, ডিএসসিসির ব্যবহৃত ওষুধের স্যাম্পলের ভিত্তিতে সেটা হয়নি।

“আমাদের ওষুধের উপাদানগুলো কী সেটা আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় পাঠিয়েছি। আমরা আশা করছি, খুব দ্রুত তাদের পরামর্শ পেয়ে যাব। জনমনে যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল সিটি করপোরেশনের ওষুধ অকার্যকর- আজকের বৈঠকের আলোচনায় প্রমাণ হল বিষয়টি সঠিক না। কারণ সিটি করপোরেশনের ব্যবহৃত ওষুধ নিয়ে এ গবেষণা করা হয়নি।”

আইসিডিডিআর,বির গবেষণা প্রতিবেদনের পর উত্তর সিটি করপোরেশনের মশার ওষুধ পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, তিনি কারও রিপোর্টকে ভুল বলেননি।

“আইসিডিডিআর,বি- সিডিসির রিপোর্ট ভুল বলিনি। আমি বলেছি, এ রিপোর্ট দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ব্যবহৃত ওষুধের স্যাম্পলের ওপর ভিত্তি করে করা হয়নি। উত্তর সিটি করপোরেশন কোন প্রক্রিয়ায় কোন ওষুধ ব্যবহার করছে সেটা সম্পূর্ণভাবে তাদের বিষয়। এ বিষয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কোনো বক্তব্য নেই।”

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে পূর্ণ বয়স্ক মশা মারতে এক লিটার কেরোসিনের সঙ্গে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ পারমেথ্রিন, শূন্য দশমিক ২ শতাংশ টেট্রামেথ্রিন এবং শূন্য দশমিক ১ শতাংশ এস বায়ো অ্যালাথ্রিনের মিশ্রন ফগার মেশিন দিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

আর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে এক লিটার কেরোসিনের সঙ্গে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ পারমেথ্রিন, শূন্য দশমিক ২ শতাংশ টেট্রামেথ্রিন এবং শূন্য দশমিক ২ শতাংশ অ্যালেথ্রিন মেশানো হয়।

এই মিশনে মশা মারার মূল উপাদান হিসেবে থাকে পারমেথ্রিন, যেটা এখন মশা মারতে কাজ করছে না বলে আইসিডিডিআর,বির গবেষণায় উঠে এসেছে।

তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, পরীক্ষায় মশার পারমেথ্রিন, ডেল্টামেথ্রিন, টেট্রামেথ্রিন, ম্যালাথিয়ন প্রতিরোধী হয়ে ওঠার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইসিডিডিআর,বির সহযোগী বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ শফিউল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মশার ওষুধের তিনটি উপাদান থাকে যার একটি পারমেথ্রিন।

“আমরা প্রথমেই বলেছি, উপাদানগুলো নিয়ে আলাদা গবেষণা করেছি। কিন্তু পারমেথ্রিন হল মেইন কিলিং এজেন্ট, বাকি দুইটা সহযোগী। এখন যদি কিলিং এজেন্টই কাজ না করে, সেখানে বাকিগুলো সহযোগী। একটা নক ডাউন করে আরেকটা এক্টিভিটি বাড়ায়। এখানে মেইন উপাদানই কাজ করছে না।”

গবেষণায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মশার ওষুধের নমুনা না নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এটা একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণা। ডব্লিউএইচও এবং সিডিসির একটা নিয়ম আছে, প্রেসক্রাইবড ফরমেট আছে। কিছু নিয়ম আছে যে এ ধরনের পরীক্ষা কীভাবে করতে হবে। আমরা সেটা ফলো করেছি। সেখানে সিটি করপোরেশনের ওষুধ নেওয়াটা মুখ্য নয়।”

সভায় মেয়র সাঈদ খোকন ছাড়াও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ডা. সানিয়া তহমিনা, আইইডিসিআরের পরিচালকা ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা, উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের পরিচালক এ জেড এম ছাব্বির ইবনে জাহান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার, ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শরীফ আহমেদ, প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমডোর মো. জাহিদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন।