এর জন্য সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের সব ধরনের আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়ে আদালত বলেছে, “তিন-চার বছরের বাচ্চারা ধর্ষিত হবে, মামলার বিচারকাজ তাড়াতাড়ি শেষ হবে না, তা দুঃখজনক।”
ধর্ষণ মামলার চার আসামির জামিন আবেদনের প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোস্তাফিজুর রহমানের হাই কোর্ট বেঞ্চ সাত দফা নির্দেশনাসহ এ আদেশ দেয়।
আদালত আদেশে বলেছে, সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সাত দফা নির্দেশনা দেওয়া হল-
# দেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালসমূহে বিচারাধীন ধর্ষণ এবং ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা মামলাসমূহ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আইনের নির্ধারিত সময়সীমার (বিচারের জন্য মামলা প্রাপ্তির তারিখ হতে ১৮০ দিন) মধ্যে যাতে বিচারকাজ সম্পন্ন করা যায় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের সব ধরনের আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া যাচ্ছে।
# ট্রাইব্যুনালসমূহকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০- এর ধারা ২০ এর বিধান অনুযায়ী মামলার শুনানি শুরু হলে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি কর্মদিবসে একটানা মামলা পরিচালনা করতে হবে।
# ধার্য তারিখে সাক্ষী উপস্থিতি ও সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতি জেলায় অতিরিক্তি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন), সিভিল সার্জনের একজন প্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটরের সমন্বয়ে একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করতে হবে। ট্রাইব্যুনালে পাবলিক প্রসিকিউটর কমিটির সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকবেন এবং কমিটির কার্যক্রম সম্পর্কে প্রতি মাসে সুপ্রিম কোর্ট, স্বারাষ্ট্র ও আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন প্রেরণ করবেন। যে সমস্ত জেলায় একাধিক ট্রাইব্যুনাল রয়েছে সে সমস্ত জেলায় সকল ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটরগণ মনিটরিং কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হবেন এবং তাদের মধ্যে যিনি জ্যেষ্ঠ তিনি সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবেন।
# ধার্য তারিখে রাষ্ট্রপক্ষ সঙ্গত কারণ ছাড়া সাক্ষীকে আদালতে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হলে মনিটরিং কমিটিকে জবাবদিহি করতে হবে।
# মনিটরিং কমিটি সাক্ষীদের উপর দ্রুততম সময়ে যাতে সমন জারি করা যায় সে বিষয়েও মনিটরিং করবেন।
# ধার্য তারিখে সমন পাওয়ার পরও অফিসিয়াল সাক্ষীগণ যেমন- ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, ডাক্তার বা অন্যান্য বিশেষজ্ঞগণ সন্তোষজনক কারণ ব্যতিরেকে সাক্ষ্য প্রদানে উপস্থিত না হলে, ট্রাইব্যুনাল উক্ত সাক্ষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ এবং প্রয়োজনে বেতন বন্ধের আদেশ প্রদান বিবেচনা করবেন।
# আদালতের সুচিন্তিত অভিমত এই যে, অবিলম্বে সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন এবং আদালত এটাও প্রত্যাশা করছে যে, সরকার অতি স্বল্প সময়ে উক্ত বিষয়ে আইন প্রণয়ন করবেন।
নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এই আদেশের অনুলিপি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব, আইন সচিব ও সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে দেওয়া হয়েছে।
গত বছরের ২৮ জুন তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় বগুড়ার সারিয়াকান্দি থানায় মামলা করেন ছাত্রীর বাবা। এ ঘটনায় তদন্ত শেষে পুলিশ গত বছর ২ সেপ্টম্বর আসামি মো. রাহেল ওরফে রায়হানের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়।
এই মামলায় এখন পর্যন্ত অভিযোগ গঠন না হওয়ায় বগুড়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এ আসামি জামিন আবেদন করেন। গত ১ জুলাই ট্রা্ইব্যুনাল জামিন আবেদনটি খারিজ করলে সে আদেশের বিরুদ্ধে হাই কোর্ট জামিন আবেদন করেন আসামি।
২০১৭ সালের ১১ অক্টোবর নোয়াখালীর নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনালে ধর্ষণের অভিযোগ এনে সারোয়ার রুবেল ও এমরানকে আসামি করে মামলা করেন এক তরুণী।
এই মামলায় আসামি দুজনকে গত বছরের ২৯ মে এক বছরের জন্য জামিন দেয় হাই কোর্ট। এই জামিনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নোয়াখালীর নারী শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ এ জামিন আবেদন করেন আসামিরা।
গত ৩ জুলাই ট্রাইব্যুনাল আসামিদের জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠায়। এই আদেশের বিরুদ্ধে জামিন চেয়ে হাই কোর্টে আবেদন করেন আসামিরা।
হাই কোর্ট জামিন মঞ্জুর করেছে বলে জানায় তাদের আইনজীবী মার্জিয়া জামান।
গত বছর ১৭ মার্চ ঢাকার শনিরআখড়ায় ৮ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে ২০ মার্চ শিশুটির মা সেকেন্দার আলীকে আসামি করে ডেমরা থানায় মামলা করেন।
গত ২৪ জুন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ আসামির জামিন আবেদন খারিজ করে দে। এ আদেশের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে জামিন আবেদন করেন সেকেন্দার আলী। সে আবেদনটি খারিজ করা হয়েছে বলে জানান আইনজীবী মো. আব্দুল্লাহ আল মাহবুব।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনোরেল মাহবুবে আলম, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল শাহানা পারভীন, হাসিনা মমতাজ ও মৌদুদা বেগম।
হাই কোর্টের সাত দফা নির্দেশনাসহ আদেশ দেওয়ার কিছুক্ষণ পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতে উপস্থিত হন। আদেশের বিষয়টি অ্যাটর্নি জেনারেলকে অবহিত করে আদালত।
এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এ ধরনের ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে বিচারের জন্য একজন বিচারক স্ট্যান্ডবাই থাকবেন। অভিযোগ পাওয়ার পর ভিকটিমকে মেডিকেল অফিসারের কাছে তিনি নিয়ে যাবেন।
“এরপর রিপোর্টের ভিত্তিতে তাৎক্ষণিক বিচার করে ফেলতে হবে। দ্রুত বিচার ছাড়া এ জাতীয় প্রবণতা কমানো যাবে না।”
এ সময় আদালত বলে, একটি মেয়ে বা শিশু ভিকটিম হবে আর বিচার বিলম্বিত হবে তা হতে পারে না। ভিকটিমের তো একটা ভবিষ্যত রয়েছে।
অ্যাটর্নি জোনারেল পরে সাংবাদিকদের বলেন, “এ আদেশ দেওয়া হয়েছে মামলাগুলোর বিচার তাড়াতাড়ি শেষ করার জন্য। আর ধর্ষণের বিষয়ে একটা সামাজিক আন্দোলন যদি না গড়ে তোলা হয় তাহলে এভাবে এটা আমার মনে হয় না প্রতিকার হবে। নির্দেশ দিয়ে তো ধর্ষণ কমানো যাবে না। ধর্ষণ কমাতে হলে এলাকায় এলাকায় জনগণকে কমিটি করতে হবে।”
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “যদি কেউ দেখে যে ধর্ষণ করার পরেও বিচারের সম্মুখীন হতে হচ্ছে না, বিচারটা কার্যকর হল না, সে তো এ অপরাধের ব্যাপারে আরও উৎসাহিত হবে। কিন্তু আমার কথা হল এই অপরাধটা কমাতে হলে এলাকায় এলাকায় জনগণকে আরও সোচ্চার হতে হবে এবং মিডিয়া এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে, আরও পালন করতে হবে।”