জাহালমের কারাভোগের দায় দুদকেরই

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্ত কর্মকর্তার ভুলের কারণে আসামি না হয়েও জাহালমকে কারাভোগ করতে হয়েছে বলে দুদকেরই তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 July 2019, 10:47 AM
Updated : 11 July 2019, 06:09 PM

তাতে বলা হয়েছে, “জাহালমকে আবু সালেকরূপে চিহ্নিত করার যে ভুলটি হয়েছে, তা দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তাদের কারণেই ঘটেছে।”

বৃহস্পতিবার হাই কোর্টে তদন্ত প্রতিবেদনটি জমা পড়ার পর বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের বেঞ্চ শুনানির জন্য আগামী মঙ্গলবার দিন রেখেছে।

আদালতে দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। জাহালমের পক্ষে ছিলেন অমিত দাশ গুপ্ত। ব্র্যাক ব্যাংকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো. আসাদুজ্জামান।

জাহালমকাণ্ডে কে বা কারা দায়ী, তা দেখার জন্য গত ১৭ এপ্রিল দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রতিবেদন চেয়েছিল আদালত। আদেশ অনুযায়ী দুদকের তদন্ত কমিটির প্রধান আবুল হাসনাত মো. আব্দুল ওয়াদুদের ২২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন বৃহস্পতিবার আদালতে দাখিল করা হয়।

প্রতিবেদনের শুরুতেই আসামি আবু সালেকের পরিবর্তে জাহালমকে আসামি করার প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়। এরপর রয়েছে জাহালমের বিরুদ্ধে ২৬ মামলার বর্ণনা।

আরেক ভাগে জাহালমকাণ্ডে ব্যাংক কর্মকর্তাসহ অন্যান্য ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা এবং তাদের দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করে ভবিষ্যতে এ জাতীয় ঘটনা রোধে অনুসন্ধান ও তদন্ত পদ্ধতিতে কী কী সংস্কার প্রয়োজন সে বিষয়ে সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে।

তদন্তে জাহালমের বিরুদ্ধে ৩৩ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, জাহালমকে আবু সালেক হিসেবে সনাক্তকারী ব্র্যাক, ইউসিবিএল সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা, টাঙ্গাইলের ধুবুড়িয়া ও সালিমাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. সফিকুর রহমান খান ও মো. আজহারুল ইসলাম মন্টু, বিচারিক আদালতে কমিশনের পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীদের (পিপি) বক্তব্য নেওয়া হয়।

আসামি আবু সলেকের পরিবর্তে জাহালমকে আসামি করার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩৩টি মামলা করার আগে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ২০১০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর মতিঝিল থানায় একটি মামলা করে। পুলিশ এর তদন্ত শুরু করলেও পরে সে মামলাটি তদন্তের জন্য দুদকের কাছে হস্তান্তর করা হয়। দুদক সেই মামলায় অব্যাহতি দিয়ে ৩৩ মামলা নিয়ে অগ্রসর হয়।

অনুসন্ধানে ত্রুটি-বিচ্যুতি

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাপক প্রকৃতির (বিপুল পরিমাণ রেকর্ডপত্র ও অধিকসংখ্যক ব্যক্তির সম্পৃক্ততা) অভিযোগের পর কোনো অনুসন্ধান দল গঠন না করে একজন মাত্র অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তাও বিষয়টি কমিশনের নজরে আনেননি।   

“একটি মামলার পরিবর্তে ৩৩টি মামলা দায়ের করা এবং মামলার ঘটনাস্থল পরিবর্তন করে ফেলার সাথে গুরুত্বপূর্ণ আইনগত প্রশ্ন জড়িত ছিল। অভিযোগটির অনুসন্ধান বা তদারককারী কর্মকর্তা বা সংশ্লিষ্ট মহাপরিচালক বিষয়টি নিয়ে লিগ্যাল অনুবিভাগের আইনগত মতামত গ্রহণ করেনিনি।

“মতামত গ্রহণ করলে এই ভুলটি এড়ানো সম্ভব হত। এ ভুলের দায় অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ-আল-জাহিদ, তদারককারী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আশরাফ আলী ফারুক কিংবা সংশ্লিষ্ট মহাপরিচালক হনিফ ইকবাল এই ভুলের দায় এড়াতে পারেন না।”

এছাড়া কোনো আসামির ঠিকানা যাচাই না করে, সরেজমিনে না গিয়ে শুধু ব্যাংকের প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা তার অনুসন্ধান প্রতিবেদন দিয়েছিলেন; যা দুদক বিধিমালা ২০০৭ অনুসরণ করা হয়নি বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

মামলার তদন্তে ত্রুটি-বিচ্যুতি

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবু সালেকসহ অন্যদের ধরিয়ে দিতে ছবি দিয়ে পত্রিকা বা টিভিতে বিজ্ঞাপন দেওয়া যেত, তা দেওয়া হয়নি। জাহালমের সঙ্গে মামলার অন্য আসামিদের মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি, জাহালমের সামাজিক ও আর্থিক সঙ্গতি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি, ব্যাংক কর্মকর্তাদের দায়-দায়িত্ব সঠিকভাবে নিরূপণ করা হয়নি এবং আত্মসাৎকৃত টাকার গন্তব্যের পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়নি এবং আইন অনুযয়ী ব্যাংক কর্মকর্তাদের অভিযুক্ত করা হয়নি।

এছাড়াও তদন্তের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরে বলা হয়েছে, মামলাগুলোতে ১২ জন তদন্ত কর্মকর্তার মধ্যে কেউই জাহালমের বাড়ি পরিদর্শন করেননি। করলে জাহালমের বাড়ির দৈন্যদশা দেখে তদন্ত কর্মকর্তাদের মনে অবশ্যই সন্দেহ দেখা দিত।

এই তদন্তকারী কর্মকর্তারা নবীন হওয়ায় দক্ষতার অভাব ও যথাযথ তদারকি না করার কারণে এ ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

এই তদন্ত কর্মকর্তাদের প্রত্যেকেই ২০১১ সলের আগস্টে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল শিক্ষানবীশ কর্মকর্তা হিসেবে।

ফলে কমিশনের পরিচালক (লিগ্যাল) মো. আব্দুল ওয়াদুদ তার প্রতিবেদনে বলেন, “সার্বিক বিবেচনায় আমার নিকট প্রতীয়মান হয়েছে যে জাহালমকে আবু সালেক রূপে চিহ্নিত করার যে ভুলটি হয়েছে, তা দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তাদের কারণেই ঘটেছে। আর তাদেরকে ভুল পথে চালিত করতে সহায়তা করেছে ব্র্যাক ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংকের কর্মকর্তাবৃন্দ এবং একাউন্টের ভুয়া ব্যক্তিকে পরিচয়দানকারীরা। তবে সঠিক ঘটনা তথা সত্য উদঘাটন করে আদালতের নিকট তা উপস্থাপন করাটাই তদন্তকারী কর্মকর্তাদের দায়িত্ব।

“এক্ষেত্রে ব্যাংক কর্মকর্তাদের ওপর বা অন্য কারো ওপর এই দয়িত্ব অর্পন করার সুযোগ নেই। বিশেষ করে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের এটা লক্ষ্য করা উচিত ছিল যে, প্রথমে কিন্তু ব্যাংক কর্মকর্তারা কিংবা একাউন্টের সনাক্তকারীরা আবু সালেককে সনাক্ত করতে কিংবা তাকে খুঁজে বের করতে তৎপর হয়নি।’

সুপারিশ

# অনুসন্ধান ও তদন্তকাজে কার্যকর তদারকি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা (অনুসন্ধান তদারকি প্যানেল) করা।

# ট্রেইল দ্য মানি (কোনো দুর্নীতির অপরাধ সংঘটনের পর ওই ঘটনার প্রকৃত সুবিধাভোগী নির্ধারণ এবং আইনের আওতায় আনার জন্য) প্রতিষ্ঠা করা।

# অপরাধলব্ধ অর্থ বা সম্পদের গতিবিধি অনুসরণ করে মূল অপরাধী সনাক্ত করার লক্ষ্যে ফরেনসিক অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট প্রতিষ্ঠা করা।

# সাক্ষী ও আসামিদের ব্যক্তিগত তথ্য যাচাই করা। এর জন্য নির্বাচন কমিশনের সাথে সমঝোতা চুক্তি করে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রকল্পের তথ্য ভাণ্ডার ব্যবহার করা যেতে পারে।

# অনুসন্ধান নোটবই ও কেস ডায়রি যথাযথভাবে লেখা ও সংরক্ষণ করা।

# গুরুত্বপূর্ণ আসামিদের রিমান্ডে এনে ব্যাপক ও নিবিঢ় জিজ্ঞাসাবাদ করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ডের ব্যবস্থা করা।

# একই ঘটনায় একাধিক মামলা দায়ের না করা।

# সাক্ষ্য হারিয়ে যাওয়া এবং আসামিরা পালিয়ে যেতে পারে এ কারণে মামলার তদন্ত গোপনে দ্রুত শেষ করা। 

# দুদক আইনজীবীদের সঠিকভাবে মামলা পরিচালনা করা। একই আদালতে বিচার চলার পরও কিছু মামলায় জাহালমকে পলাতক আবার কিছু মামলায় হাজির দেখানো হয়েছে। দুদকের আইনজীবীর এরকম নানা শৈথিল্য তুলে ধরা হয়েছে।

দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান প্রতিবেদনের বিষয়ে বলেন, “আমার কছে মনে হয়েছে যে, সমন্বয়হীনতার কারণেই এমনটা হয়েছে। জাহালম তিন বছর জেল খেটেছে- এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। এখন এর জন্য কে কতটুকু দায়ী তা আদালত নির্ধারণ করবেন।”

অমিত দাস গুপ্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলে, “দুদক স্বচ্ছভাবেই তদন্তটা করেছে বলে আমি মনে করি। প্রকৃত দোষীদের বের করে আনার জন্য তদন্তে সঠিক প্রয়াস ছিল বলেই মনে হয়েছে। ভবিষ্যতে দুদক যাতে এরকম ভুল আর না করে তার জন্য সুপারিশও আছে প্রতিবেদনে। সেই সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন হলে এমনটা আর ঘটবে না বলে আমি মনে করি। যেখানে দুদক নিজেই নিজেদের দায় স্বীকার করে নিয়েছে।”

সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগে আবু সালেক নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা করে দুদক। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তাদের ভুলে সালেকের বদলে তিন বছর ধরে কারাগারে কাটাতে হয় টাঙ্গাইলের জাহালমকে।

ফাইল ছবি

জানুয়ারির শেষ দিকে গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন আইনজীবী অমিত দাশ গুপ্ত আদালতের নজরে আনলে দুদকের ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। কারাগারে থাকা ‘ভুল’ আসামি জাহালমকে কেন অব্যাহতি দেওয়া হবে না এবং তাকে মুক্তি দিতে কেন ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে স্বতঃপ্রণোদিত একটি রুলও জারি করা হয়।

এরপর দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ দুঃখ প্রকাশ করে ভুলের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। আদালতের আদেশে ৩ ফেব্রুয়ারি রাতে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পান জাহালম।

পাটকল শ্রমিক জাহালমের তিন বছর কারাগারে থাকার ঘটনায় তদন্ত কর্মকর্তাদের গাফিলতি ছিল কি না- তা খতিয়ে দেখতে একটি কমিটি করে দুদক।

তবে হাই কোর্টে দুদকের পক্ষ থেকে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকের ওপর দায় চাপিয়ে বলা হয়, ব্যাংকগুলোর অনুসন্ধান প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্তের উপর ভিত্তি করেই দুদকের তদন্ত কর্মকর্তারা অভিযোগপত্র দিয়েছিলেন।

কিন্তু দুদকের ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট না হয়ে ৩৩টি মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণী (এফআইআর), অভিযোগপত্রসহ (সিএস) যাবতীয় নথি তলব করে হাই কোর্ট।

দুদকের কার্যক্রমে উষ্মা প্রকাশ করে আদালত বলে, ইঁদুর ধরতে না পারলে সেই বিড়ালের প্রয়োজন নেই।

পরে আরেক অদেশে গত ১৭ এপ্রিল আসামি না হয়েও জাহালমের কারাভোগের জন্য কে বা কারা দায়ী তা দেখতে দুদকের কাছে প্রতিবেদন চায় হাই কোর্ট।

সে প্রতিবেদনই বৃহস্পতিবার দাখিল করা হয় আদালতে।