বুলিং: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অভিযোগ বাক্স চায় হাই কোর্ট

অসৌজন্য-অশালীন আচরণ, উপদ্রব, নির্যাতনের বিষয়ে শিক্ষার্থীরা যাতে অভিযোগ জানাতে পারে, সেজন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অভিযোগ বাক্স রাখার পক্ষে মত দিয়েছে হাই কোর্ট। 

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 July 2019, 03:47 PM
Updated : 10 July 2019, 03:47 PM

‘বুলিং’ প্রতিরোধে সরকারের করা খসড়া নীতিমালায় এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে বলেছে আদালত।

অভিযোগ বাক্স স্থাপন ও শিক্ষার্থীদের অভিযোগ বাক্সে অভিযোগ জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়াতে হাই কোর্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রচারও চালাতে বলেছে।

‘বুলিং’ প্রতিরোধে করা খসড়া নীতিমালার বাস্তবায়নের অগ্রগতি প্রতিবেদন বুধবার বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের হাই কোর্ট বেঞ্চে জমা দেওয়া হলে আদালত এ অভিমত দেয়।

এই নীতিমালা চূড়ান্ত করার কাজে কতটা অগ্রগতি হয়েছে- তা আগামী ২২ অক্টোবরের মধ্যে আদালতে জানাতে বলা হয়েছে।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের ছাত্রী অরিত্রি অধিকারীর আত্মহত্যার পর হাই কোর্ট গত বছর ৪ ডিসেম্বর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি আদেশ দেয়।

‘বুলিং’ ও শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রতিরোধের উপায় নির্ণয়ে একটি জাতীয় নীতিমালা তৈরির জন্য অতিরিক্ত শিক্ষা সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে দেয় আদালত।

ওই কমিটিকে অরিত্রীর আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধান করে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।

আদালতের ওই আদেশের ধারাবহিকতায় গঠিত কমিটি একটি খসড়া নীতিমালা করে সম্প্রতি হাই কোর্টে দাখিল করে। অগ্রগতি প্রতিবেদনের ওপর শুনানিতেই বুধবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘অভিযোগ বাক্স’ বসানোর অভিমত আসে।

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশারকে আদালতের এই অভিমত নীমিমালায় অন্তর্ভুক্ত করতে বলা হয়।

অরিত্রির আত্মহত্যার ঘটনা আদালতের নজরে আনা আইনজীবী অনীক আর হক, জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ও আইনুন্নাহার সিদ্দিকাও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

শুনানির সময় বিচারক বলেন, অনেক সময় দেখা যায় শিক্ষার্থী তার অভিযোগ অভিভাবক বা শিক্ষকের কাছে বলতে চায় না লজ্জা বা ভয়ে। সে যাতে নিঃসঙ্কচে তার অভিযোগ লিখিতভাবে জানাতে পারে, সেজন্যই অভিযোগ বাক্স রাখা উচিৎ।

সেসব অভিযোগ খুলে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া বা তদন্ত করার দায়িত্ব ব্যবস্থাপনা বা পরিচালনা পর্ষদের হাতে দিতে বলেছে আদালত।

আর শিক্ষক বা ব্যবস্থাপনা কমিটির কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে সে বিষয়টি তদন্তের জন্য জেলা প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের কাউকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠনের বিষয়টি নীতিমালায় রাখা যায় কী না সে বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ নিতে বলা হয়েছে।

তুলনামূলকভাবে বেশি শক্তিশালী বা ক্ষমতাধর কেউ যখন তার তুলনায় দুর্বল কাওকে বারবার উত্ত্যক্ত, আঘাত বা হয়রানি করে, তখন তাকে বলা হয় বুলিং। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশু, কিশোরদের ক্ষেত্রে এটা প্রায়ই দেখা যায়।

শিশুরা বেশিরভাগ সময় আরও নির্যাতিত হওয়ার ভয়ে প্রাপ্তবয়স্কদের কাছে বিষয়টি গোপন রাখে। কোনো ব্যবস্থা নেওয়া না হলে বুলিং চলতে থাকে।

খসড়া নীতিমালায় বুলিংয়ের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, বিদ্যালয় চলাকালীন সময় বা বিদ্যালয় শুরু হওয়ার আগে বা পরে, শ্রেণিকক্ষে বা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বা বাইরে কোনো শিক্ষার্থী কর্তৃক (এককভাবে বা দলগতভাবে) অন্য কোনো শিক্ষার্থীকে শারীরিকভাবে আঘাত করা, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করা, অশালীন বা অপমানজনক নামে ডাকা, অসৌজন্যমূলক আচরণ করা, কোনো বিশেষ শব্দ বারবার ব্যবহার করে উত্ত্যক্ত বা বিরক্ত করা স্কুল বুলিং হিসেবে গণ্য হবে।

নীতিমালায় তিন ধরনের বুলিংয়ের উল্লেখ করা হয়েছে। শারীরিক বুলিং, সামাজিক বুলিং ও মৌখিক বা মানসিক বুলিং।

#  কাউকে কোনো কিছু দিয়ে আঘাত, চড়-থাপ্পড় দেয়া, লাথি ও ধাক্কা মারা, থুথু নিক্ষেপ, জিনিসপত্র জোর করে নিয়ে যাওয়া বা ভেঙে ফেলা ও অসৌজন্যমূলক আচরণ শারীরিক বুলিংয়ের পর্যায়ে পড়বে।

#  উপহাস করা, খারাপ নামে সম্বোধন ও অশালীন শব্দ ব্যবহার ও হুমকি মৌখিক বুলিং হিসেবে চিহ্নিত হবে।

# এছাড়া, সামাজিক স্ট্যাটাস, ধর্মীয় পরিচিতি বা বংশগত অহংবোধ থেকে কোনো শিক্ষার্থীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন, কারো সম্পর্কে গুজব ছড়ানো এবং প্রকাশ্যে অপমান করা হলে তা সামাজিক বুলিং হিসেবে গণ্য হবে।

অতিরিক্ত শিক্ষা সচিবের নেতৃত্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের করা খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, সরকারি, বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায়ই স্কুল বুলিংয়ের প্রবণতা দেখা যায়  বুলিংয়ের শিকার শিক্ষার্থী অনেক ক্ষেত্রে স্কেুলে যেতে চায় না।

এতে শিক্ষণ কার্যক্রম ব্যাহত হয়, পরিবেশ নষ্ট হয় বিদ্যালয়ের। যদিও স্কুল বুলিং সাধারণত ফৌজদারি অপরাধের পর্যায়ে পড়ে না, তবে সেরকম কিছু ঘটতে পারে বলে মনে হলে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে তার অগেই পুলিশের সাহায্য নেওয়ার কথা নীতিমালায় বলা হয়েছে।

নীতিমালায় বলা হয়েছে, বিদ্যালয়ে কোনো প্রকার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যাবে না, যাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দল/উপদলের সৃষ্টি হয়।

যে বুলিং করবে এবং যে শিকার হবে, দুই পক্ষকেই অত্যন্ত যত্ন নিয়ে কাউন্সেলিং করতে হবে, যাতে তাদের আচরণে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়। স্কুল কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নিলে বিরোধিতা না করে অভিভাবকদেরও সহযোগিতা করতে হবে।

এছাড়া বুলিংয়ের ব্যাপারে স্কুল কর্তৃপক্ষের জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ, মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার, সচেতনতা সৃষ্টি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করা এবং স্কুলে আইসিটি ডিভাইস আনা নিষিদ্ধ করার কথাও নীতিমালায় বলা হয়েছে।