কিছু কিছু ওসি, ডিসি নিজেদের জমিদার মনে করেন: হাই কোর্ট

কারও দায়িত্ব পালনে অবহেলার কারণে কোনো অপরাধ ঘটে থাকলে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির দায়ও যে সমান হয়, ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের আইনজীবীকে সে কথা মনে করিয়ে দিয়েছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 July 2019, 02:31 PM
Updated : 9 July 2019, 02:46 PM

আদালত বলেছে, থানার ওসি এবং জেলার ডিসিদের মধ্যে কেউ কেউ অছেন, যারা নিজেদের ‘জমিদার’ মনে করেন।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার পুলিশ পরিদর্শক মোয়াজ্জেমের জামিন শুনানিতে মঙ্গলবার বিচারপতি মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাই কোর্ট বেঞ্চ থেকে এমন মন্তব্য আসে।

ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির জবানবন্দি ভিডিও করে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার এই পুলিশ কর্মকর্তার জামিন আবেদন আদালত ‘উত্থাপিত হয়নি’ মর্মে খারিজ করে দিয়েছে।

নুসরাত গত মার্চ মাসে তার মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানীর অভিযোগ করলে সোনাগাজী থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম তাকে থানায় ডেকে জবানবন্দি নিয়েছিলেন।

তার কয়েক দিনের মাথায় মাদ্রাসার ছাদে নিয়ে নুসরাতের গায়ে অগ্নিসংযোগ করা হলে ওসির বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে সারাদেশে আলোচনার মধ্যে নুসরাতের সেই জবানবন্দির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

অগ্নিদগ্ধ নুসরাতের মৃত্যুর পর গত ১৫ এপ্রিল ওই ভিডিও ছড়ানোর জন্য ওসি মোয়াজ্জেমকে আসামি করে ঢাকায় বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন।

তদন্ত করে পিবিআই জানায়, নুসরাতের জবানবন্দি ভিডিও করে ওসি মোয়াজ্জেম যে তা ছড়িয়ে দিয়েছেন, সেই প্রমাণ তদন্তে মিলেছে।

মোয়াজ্জেমের জামিন শুনানিতে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক বলেন, নুসরাতকে নিরাপত্তা দিলে এ ধরনের ঘটনা হয়ত এড়ানো যেত।

“তার (ওসি মোয়াজ্জেমের) উচিৎ ছিল তাকে (নুসরাত জাহান রাফিকে) নিরাপত্তা দেওয়া। কিন্ত ক্ষমতা থাকার পরও তা না করে ওই ছাত্রীর বক্তব্য ভিডিও রেকর্ড করে তা ইন্টারনেট মাধ্যমে ছড়ানো হয়েছে। এ কাজ করে চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন।”

বিচারক বলেন, “দায়িত্ব বা ক্ষমতা থাকার পরও সে দায়িত্ব পালন না করার কারণে যদি কোনো দুর্ঘটনা বা অপরাধ ঘটে তবে তার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ওই ব্যক্তিও সমান দায়ী।”

ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন

আদালতে জামিন আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আহসান উল্লাহ ও সালমা সুলতানা। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

জামিনের বিরোধিতা করে অ্যাটর্নি জেনারেল শুনানিতে বলেন, “এটি একটি বার্নিং ইস্যু। নুসরাতের বক্তব্য ভিডিও করেছেন আবার ভাইরালও করেছেন। উনাকে জামিন দেওয়া হলে সমাজে কী বার্তা যাবে?”

জ্যেষ্ঠ বিচারক তখন জানতে চান, মোয়াজ্জেম হোসেন কতদিন ধরে পুলিশ হেফাজতে আছেন, তার শারীরিক অবস্থা কেমন, মামলাটি কোন পর্যায়ে আছে।

উত্তরে মাহবুব আলম বলেন, পরিদর্শক মোয়াজ্জেম মাস খানেক ধরে কারাগারে আছেন। তার শারীরিক অবস্থার বিষয়টি কারা কর্তৃপক্ষ দেখবে। আর মামলাটি অভিযোগ গঠনের শুনানি পর্যায়ে রয়েছে, বুধবার সেই শুনানি হওয়ার কথা। 

জামিন না দেওয়ার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “ওই (জবানবন্দির) ভিডিওতে অশ্লীলতা আছে। এটা করে ভাইরাল করে দেওয়া হয়েছে। একজন পুলিশ অফিসারের এমন দায়িত্বহীন কাজ মেনে নেওয়া যায় না। একজন পুলিশ অফিসার (নুসরাতকে) এমন প্রশ্ন করে! এসব প্রশ্ন করা কতটা ঠিক! আবার অনুমতি ছাড়া ভিডিও করে!”

বিচারপতি মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী তখন বলেন, “কিছু কিছু ওসি, ডিসি অছেন, যারা নিজেদের জমিদার মনে করেন। সবার কথা বলছি না, কিছু কিছু ওসি ডিসি অছেন। অন্যান্য দেশেও যে নেই তা না।”

নুসরাত কেন থানায় গিয়েছিলেন তা আদালত জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “নিরাপত্তার জন্য হয়ত। এফআইআর বা অভিযোগ করতে হয়ত গিয়েছিল। ওসির কাছে ডায়রি থাকে। কোনো ডিউটি অফিসার সে সময় যদি না থাকে, তাহলে সে নোট নেবে যে অমুক এসেছিল এই অভিযোগ নিয়ে।

“তা না করে মেয়েটাকে এসব অবান্তর প্রশ্ন করা হল, মজা করল, ভিডিও করল, তারপর সেটা ভাইরাল করে দিল। সে বলতে পারত ‘তোমার বক্তব্যের লিখিত দিয়ে যাও বা লিখিত নিয়ে আসো’।”

বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী তখন বলেন, “আরও দেখলাম মামলা হওয়ার পরও পুলিশ কিছু করছে না। তখন যদি প্রটেকশন দিত বা অ্যাকশন নিত, তাহলে হয়ত এই ঘটনা ঘটত না।”

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে যারা আছেন তাদের দায়িত্বে অবহেলার কোনো সুযোগ নেই।

এ পর্যায়ে মোয়াজ্জেমের আইনজীবী আহসান উল্লাহ বলেন, “তিনি খুবই দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি যে ভিডিওটি করেছেন, তাতে কোনো ভালগার প্রশ্ন নেই। সে তার মা-ভাই এবং একজন নারী পুলিশের উপস্থিতিতে বক্তব্য দিয়েছেন। ওসি তাকে মা সম্বোধন করেছেন।”

এ সময় তিনি ভিডিও রেকর্ডের কথোপকথন পড়ে শোনাতে থাকলে এক পর্যায়ে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক প্রশ্ন করেন- “সাধারণত এমনটা হয়? এসব প্রশ্ন পুলিশ করে? সব যদি পুলিশই করবে, তাহলে আদালত কী করবে? আপনি-আপনারা কী করবেন? আমরা পড়েছি।”

তারপরও মোয়াজ্জেমের আইনজীবী বলতে থাকেন, পুলিশকে ‘হেয় করার জন্যই’ এরকম ‘উদ্ভট’ মামলা করা হয়েছে।

‘ওসি মোয়াজ্জেমের কান খারাপ’

শুনানির শুরুতে মোয়াজ্জেমের আইনজীবী আহসান উল্লাহ বলেন, “উনার বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছে তাতে সাজা মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন নয় যে তাকে জামিন দেওয়া যাবে না। তিনি জামিনযোগ্য মামলায় আছেন। তাছাড়া তার বয়স হয়েছে, হার্টেও সমস্যা আছে।

বিচারপতি মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী তখন আইনজীবীকে প্রশ্ন করেন, “আপিনি কী ভিডিওর কথাগুলো শুনেছেন?

জবাবে আইনজীবী বলেন, “ওসি মোয়াজ্জেমের কান খারাপ। কানে সমস্যা আছে। উনার কানের চিকিৎসা হচ্ছে।”

বিচারক তখন বলেন, “কানে কম শুনলে ওসি থাকেন কেমনে?”

সাংবাদিকতা প্রসঙ্গ

মোয়াজ্জেমের আইনজীবী দাবি করেন, তার মক্কেল কোনো অপরাধ করেননি। তার কাছ থেকে ভিডিওটি নিয়ে একজন সাংবাদিক তা ভাইরাল করে দিয়েছে।

“সাংবাদিকরা তো এখন তেলাপিয়া মাছের মত। তখন যদি ভিডিও না করে মামলা নিত, তাহলে এদের (সাংবাদিকদের) কেউ কেউ প্রশ্ন করত- ‘কত টাকা খেয়ে প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন’।”

বিচারক তখন বলেন, “এই ঘটনার পেছনে সাংবাদিকরা যদি শুরু থেকে লেগে থাকত তাহলে এই ঘটনা (নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়া) ঘটত না।”

এ পর্যায়ে বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারক খিজির হায়াত বলেন, “সাংবাদিকরা সমাজের দর্পণ। তারা না থাকলে সমাজের এইসব ঘটনা এইভাবে প্রকাশ পেত না।”

মোয়াজ্জেমের আইনজীবী তখন ‘শর্ষের মধ্যে ভূত আছে’ বলতে বলতে শুনানি শেষ করেন।

শুনানি শেষে আদালত জামিন আবেদনটি ‘উত্থাপিত হয়নি’ মর্মে খারিজ করে দেয়।