যুদ্ধাপরাধ: পুঠিয়ার সামাদের রায় যে কোনো দিন

রাজশাহীর পুঠিয়ার মো. আব্দুস সামাদ (মুসা) ওরফে ফিরোজ খাঁর বিরুদ্ধে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ মামলার রায় হবে যে কোনো দিন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 July 2019, 01:46 PM
Updated : 8 July 2019, 01:46 PM

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগের মত মানবতাবিরোধী অপরাধের চারটি ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে এ আসামির বিরুদ্ধে।

প্রসিকিউশন ও আসমি পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে সোমবার বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন বিচারকের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে।

প্রসিকিউশনের পক্ষে এ মামলায় শুনানি করেন প্রসিকিউটর ঋষিকেশ সাহা ও জাহিদ ইমাম। আসামি পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আব্দুস সাত্তার পালোয়ন।

প্রসিকিউটর জাহিদ ইমাম পরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তাপদের সহযোগীদের নিয়ে এ মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা-হত্যাসহ যেসব অপরাধ করেছে মামলার শুনানি ও যুক্তিতর্কে সেসব তথ্য-প্রমাণ, সাক্ষ্য আমরা আদালতে তুলে ধরেছি।

“ভিকটিমসহ ভিকটিম পরিবারের ১৪ জন চাক্ষুস সাক্ষী আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন। ফলে আমরা আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চেয়েছি ট্রাইব্যুনালের কাছে।”

অন্যদিকে আসমিপক্ষের আইনজীবী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এ মামলার সাক্ষী এবং পুঠিয়ার সাঁওতাল পল্লীর লোকজনের সঙ্গে আসামির বাবার জমি সংক্রান্ত বিরোধ ছিল।

“১৯৬৪ সালে জমি বিনিময় করে তারা এসেছিল। কিন্তু দেশ স্বাধীনের বছরে এসে সাঁওতালরা ৫০ একর জমি ফেরত চাইলে আসামি, আসামির বাবা এবং এলাকার লোকদের সাথে সাঁওতালদের সংঘর্ষ হয়। সেই সংঘর্ষে আসামির বাবাও মারা যান। সাক্ষীরা সে সুযোগ নিয়ে তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে।”

এ আইনজীবী বলেন, “উভয় পক্ষের মধ্যে এটা মূলত জায়গা-জমি সংক্রান্ত বিরোধ এবং বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আদালতে সেটা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি বলে মনে করি। তাই আসামির খালাস চেয়েছি।”

কে এই সামাদ

এ মামলার আসামি মো. আব্দুস সামাদ (মুসা) ওরফে ফিরোজ খাঁর বাড়ি রাজশাহীর পুঠিয়ার ত্রিমোহিনী বাজারের কাঁঠালবাড়িয়া গ্রামে। ১৯৭১ সালে দেশে যখন স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয়, সময় তার বয়স ২০ বছরের মত। 

প্রসিকিউশনের তথ্য অনুযায়ী, সামাদের পূর্বপুরুষ এদেশে এসেছিলেন ভারতের মুর্শিদাবাদ থেকে। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন।

এ মামলার অভিযোগপত্রের বিবরণ অনুযায়ী, চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করা সামাদ  এক সময় মুসলিম লিগ করলেও একাত্তরে তিনি জামায়াতে ইসলামীতে ভেড়েন এবং স্থানীয় রাজাকার বাহিনীতে নাম লেখান।

মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষ নিয়ে পুঠিয়ার বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান এবং চারজন সাঁতালসহ ১৫ জনকে হত্যা, ২১ জনকে নির্যাতন, ৮ থেকে ১০টি বাড়িঘরে লুণ্ঠন এবং ৫০ থেকে ৬০টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগে অংশ নেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে এ মামলায়।

অভিযোগ ১:  একাত্তরের ১৯ এপ্রিল পুঠিয়ার ভালুকগাছী ইউনিয়নের দমদমা, সুখদেবপুর, বাঁশবাড়ি ও গতিয়া গ্রামে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যা।   

অভিযোগ ২: একাত্তরের ১৯ এপ্রিল পুঠিয়ার গণ্ডগোহালী, চকপলাশী, বৈরাগীবাজার ও বাঁশবাড়ি গ্রামে  ছয়জনকে অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যা।   

অভিযোগ ৩: একাত্তরের ১৯ এপ্রিল পুঠিয়ার ভালুকগাছী ইউনিয়নের পশ্চিমবাগ গ্রামের সাঁওতাল পাড়ায় গিয়ে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন, হত্যা ও গণহত্যা।   

অভিযোগ ৪: একাত্তরের ২০ এপ্রিল পুঠিয়ার ভালুকগাছী ইউনিয়নের ঢোকরাকুল গ্রামে একজনকে আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যা।

মামলা বৃত্তান্ত

প্রসিকিউশনের তদন্ত দল ২০১৬ সালের ১১ ডিসেম্বর যখন এ মামলার তদন্ত শুরু করে, তখন আসামি করা হয়েছিল ৬ জনকে। কিন্তু তদন্ত চলার সময়ই বাকি পাঁচ আসামির মৃত্যু হলে একমাত্র আসমি হিসেবে থাকেন মো. আব্দুস সামাদ (মুসা) ওরফে ফিরোজ খাঁ।

তদন্ত চলার মধ্যেই নাশকতার একটি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় সামাদকে। পরে ২০১৭ সালের ২৪ জানুয়ারি তাকে যুদ্ধাপরাধের এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।

তদন্ত কর্মকর্তা তার প্রতিবেদনে মোট পাঁচটি অভিযোগ আনলেও যাচাই-বাছাই শেষে চারটি অভিযোগের ভিত্তিতে আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র দাখিল করে প্রসিকিউশন।

তার ওপর শুনানি করে আদালত গতবছর ৯ সেপ্টেম্বর আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।

এরপর ১০ অক্টোবর প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ।

প্রসিকিউশনের পক্ষে তদন্ত কর্মকর্তাসহ মোট ১৫ জন এ মামলায সাক্ষ্য দেন। আসামির পক্ষে কোনো সাক্ষী ছিলেন না।

প্রসিকিউটর জাহিদ ইমাম জানান, এ মামলার চার অভিযোগে মোট ১৪ জন চাক্ষুস সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাদের মধ্যে পাঁচজন সরাসরি ভিকটিম এবং নয়জন ভিকটিম পরিবারের সদস্য। 

গত ১৪ এপ্রিল এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তার জেরা শেষ হয়। এরপর গত বৃহস্পতিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত যুক্তিতর্ক শুনানি চলে।

এখন আদালত যে কোনো দিন রায় ঘোষণা করতে পারে বলে জানান প্রসিকিউটর জাহিদ ইমাম।