বাংলাদেশের সুন্দরবনকে ঘিরে বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ভারত ও চীনের চেষ্টায় সরকারে ইন্ধন রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।
Published : 08 Jul 2019, 07:39 PM
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বাংলাদেশে কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র করার ক্ষেত্রে প্রতিবেশী ভারত ও চীনের ‘স্বার্থের দ্বন্দ্ব’ রয়েছে। বাংলাদেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার জন্য তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা নিজেদের দেশে কয়লা থেকে সরে গিয়ে অন্য ‘সোর্স অব এনার্জির’ মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনে চলে যাচ্ছে।”
তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিকভাবে আমাদেরও অঙ্গীকার আছে যে পরিবেশ দূষণ কমিয়ে আনব, কিন্তু তাদের (ভারত-চীন) স্বার্থের বিষয়টি দেখে আমাদের ওপর কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রে চাপিয়ে দিচ্ছে, তা আবার সুন্দরবনকে ঘিরে করা হচ্ছে। কাজেই এটা অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় যে, সরকার সেটা মেনে নিচ্ছে, সরকার সেখানে ইন্ধন যোগাচ্ছে।”
‘সদ্য সমাপ্ত ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির সভা, উপকূল ও সুন্দরবনের ভবিষৎ এবং আমাদের করণীয়’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজক ছিল সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি।
সুন্দরবনের কাছে বাগেরহাটের রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ভারত হেভি ইলেক্ট্রিক্যালকে ২০১৭ সালের এপ্রিলে কাজ শুরুর অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী বিদ্যুৎ কোম্পানি।
কয়লাভিত্তিক ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে সুন্দরবনের পরিবেশ ও প্রতিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দাবি করে পরিবেশবাদীদের একটি অংশ শুরু থেকেই রামপাল প্রকল্পের বিরোধিতা করে আসছে। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সুন্দরবনের যাতে ক্ষতি না হয়, তার সব ব্যবস্থাই নেওয়া হচ্ছে।
এছাড়া সুন্দরবনের উজানে ১৫০টির বেশি শিল্প প্রকল্প চালু আছে, যেগুলোর সঙ্গে নৌ ও খনন কার্যক্রম পানি ও প্রতিবেশগত বৈচিত্র্যের বাড়তি হুমকি সৃষ্টি করছে।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “সরকার ইউনেস্কোর কাছে যেসব অঙ্গীকার করেছে সেগুলো বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট ও সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এজন্য দেশবাসী ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনকে সম্পৃক্ত করতে হবে। এর মাধ্যমে সুন্দরবন ঘিরে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন ও কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষা করে ইউনেস্কোর কাছে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিপোর্ট দিতে হবে।
“ইতোমধ্যে যে সকল প্রকল্প সেখানে চলমান রয়েছে সেগুলো স্থগিত করতে হবে। পরিবেশের প্রভাব মূল্যায়ন এবং কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষার যে কথা বলা হচ্ছে, তা যদি ইতিবাচক হয় তাহলে আমাদের কোনো আপত্তি থাকবে না। যদি মূল্যায়নে আসে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না, সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না, উপকূলের ক্ষতি হবে না, এতে করে উন্নয়ন প্রকল্প আরও ১০টি হোক সে ক্ষেত্রে আমাদের কোনা আপত্তি থাকবে না।”
সরকারকে সবার আগে জনগণের স্বার্থ দেখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “জনস্বার্থের কোনো কাজ কখনই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। যে সরকার টেকসই উন্নয়ন, অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়নের কথা বলছে, অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়ন এই নয় যে প্রতিবেশী দেশের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে জাতীয়ভাবে স্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব।”
রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং ব্যাপক সংখ্যায় শিল্প কারখানা নির্মাণের কারণে সুন্দরবন ‘মারাত্মক হুমকির মুখে রয়েছে’- এমন পর্যবেক্ষণ দিয়ে বাংলাদেশের বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনকে ‘বিপদাপন্ন বিশ্ব ঐতিহ্যের’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার (আইইউসিএন)। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার ছিল ২১ সদস্যের বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির ওপর।
তবে সম্প্রতি আজারবাইজানের বাকুতে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির ৪৩তম সভায় আপাতত সুন্দরবনকে ওই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না করার সিদ্ধান্ত হয়।
সংবাদ সম্মেলনে সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আব্দুল মতিন বলেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ইউনেস্কোর পর্যবেক্ষণ দল সরেজমিন সুন্দরবন দেখতে আসার কথা রয়েছে। বাংলাদেশকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে সুন্দরবনকে ঘিরে কাজের প্রতিবেদন জমা দিতে হবে, যা বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির ৪৪তম সভায় মূল্যায়ন করা হবে।
“সেই সভায় সরকারের কাজে সন্তুষ্ট না হলে ‘সুন্দরবন বিপদাপন্ন ঐতিহ্যের’ তালিকায় চলে যেতে পারে, যা হবে আমাদের জন্য অযোগ্যতা, ব্যর্থতা, দুঃখজনক, লজ্জাকর ও অপমানজনক।”
সংবাদ সম্মেলনে কমিটির সদস্য শরীফ জামিল, সিপিবির নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্সও বক্তব্য দেন।