রিকশা বন্ধ: যানজট আগের মতোই, বেড়েছে ভোগান্তি

ঢাকার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক থেকে রিকশা উঠিয়ে দেওয়ায় বাসচালকরা খুশি হলেও অনেকটা আগের মতোই যানজট দেখা গেছে সড়কগুলোতে, পাশাপাশি গণপরিবহনের সংকটের শহরে বাসে উঠতে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে কর্মজীবী নারী ও স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 July 2019, 03:35 PM
Updated : 7 July 2019, 04:50 PM

পর্যাপ্ত বিকল্প না রেখে রিকশা উঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন অনেকে। গাড়ির পাশাপাশি রিকশা চলাচলের জন্য রাস্তার পাশে ছোট লেইন করে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা। তবে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন বলেছেন, এই সিদ্ধান্তের পক্ষে ব্যাপক সাড়া পেয়েছেন, তাই রিকশার লেইনের বিষয়ে ভাবছেন না তারা।

‘ঢাকা মহানগরীর অবৈধ যানবাহন দূর/বন্ধ, ফুটপাত দখলমুক্ত ও অবৈধ পার্কিং বন্ধে গঠিত’ কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাজধানীর কুড়িল-সায়েদাবাদ, গাবতলী-আজিমপুর ও সায়েন্সল্যাব-শাহবাগ রুটে রিকশা চলাচল বন্ধ করা হয়েছে, যার প্রথম দিন ছিল রোববার।

ট্রাফিক পুলিশ রিকশা কিংবা ভ্যান কিছুই চলতে দিচ্ছিল না রামপুরা সেতুর উপর দিয়ে। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

প্রগতি সরণি এবং এলিফ্যান্ট রোডে গিয়ে দেখা যায়, এসব সড়কে রিকশা চলাচল করছে না। তবে বাড্ডা, রামপুরা এলাকায় মাঝেমধ্যে কয়েকটি রিকশা চলাচল করেছে।

বেলা ১টায় প্রগতি সরণির কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় গিয়ে কোনো রিকশা চলাচল করতে দেখা যায়নি। এ সময় কুড়িল চৌরাস্তা থেকে নদ্দা বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত সড়কে যানজট ছিল। কুড়িল থেকে যমুনা ফিউচার পার্ক পর্যন্ত পার হতে ২৫ মিনিট লেগে যায়।

নতুন বাজার থেকে কুড়িল যাওয়ার পথে কোকাকোলা এলাকা থেকে যমুনা ফিউচার পার্ক পর্যন্ত সড়কেও যানজট ছিল একই রকম, যদিও সেখানে রিকশা দেখা যায়নি।

ওই সড়কের বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ডে অনেককে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। পুরুষরা উঠতে পারলেও নারীদের জন্য বাসে ওঠা ছিল বেশ কষ্টকর।

নদ্দা বাসস্ট্যান্ড থেকে নতুন বাজার যেতে বাসের অপেক্ষায় ছিলেন কালাচাঁদপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির কয়েকজন শিক্ষার্থী। তাদের একজন উম্মে আতিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাস পান না বলে বেশিরভাগ সময় রিকশায় যাওয়া-আসা করতেন তিনি। আজ তা পারছেন না।

“নতুন বাজার থেকে সহজে বাসে ওঠা যায় না। আবার কলেজের ইউনিফর্ম দেখলে বাসও থামায় না। রিকশা তুলে দেওয়ার বিরোধিতা করছি না, কিন্তু পর্যাপ্ত বাস থাকলে রিকশা না হলেও চলত। কিন্তু এই সড়কে এখনও পর্যাপ্ত বাস চলাচল করে না।”

প্রগতি সরণিতে স্কুলভ্যানেও আটকে দিচ্ছিল পুলিশ; যদিও তা নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে বলে জানানো হয়েছিল। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, এই রুটে বেশিরভাগ বাসের দরজা বন্ধ করে রাখা হয়। ফলে অনেকেই উঠতে পারে না। রিকশা উঠিয়ে দেওয়ার আগে বিষয়টি ভাবা উচিত ছিল।

“বেশিরভাগ বাস দরজা বন্ধ করে চালায়, এখন নারী শিশু ও বৃদ্ধরা কীভাবে যাতায়ত করবে? বাসের সংখ্যা না বাড়িয়ে এমন হঠকারি সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হয়নি। আর গরিব রিকশাওয়ালারা কীভাবে জীবিকা নির্বাহ করবে?”

কুড়িল বিশ্বরোড থেকে রামপুরা পর্যন্ত সড়কটি ছয় লেইনের। দুই পাশে একটি করে লেইন রিকশার জন্য আলাদা করে দিলে রিকশা চলতে পারত, এতে সবারই ভালো হতে বলে মনে করেন বাড্ডার বাসিন্দা মিল্লাত হোসেন।

“রিকশার জন্য আলাদা লেইন করতে খুব বেশি জায়গা লাগবে না। দুটি লেইন যান্ত্রিক বাহনের জন্য রেখে দুপাশে একটা করে সরু লেইনে রিকশা চলাচলের ব্যবস্থা করা যায়। এটি করলে সবার জন্যই ভালো হত। কারণ স্বল্প দূরত্বে রিকশা ছাড়া যাওয়ার সুযোগ নেই,” বলেন তিনি।

প্রগতি সরণিতে রিকশা চলাচল বন্ধ হওয়ায় খুশি বাস চালকরা। এতে এই সড়কে যানজট কমবে বলে মনে করছেন মিরপুর-বাড্ডা রুটের আকিক পরিবহনের চালক মোহাম্মদ দয়াল।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রিকশার লাইগা ডানে বামে লইতেও পারি না। রিকশাওয়ালারা খুব ডিস্টার্ব করে। চিপায় চাপায় ঢুকাইয়া দেয়। অহন একটু সুবিধা হইল। আরামে গাড়ি চালান যাইব।”

তবে রিকশা বন্ধের কারণে জীবিকা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন বাড্ডা আনন্দনগর এলাকার রিকশাচালক আলমগীর।

তিনি বলেন, প্রধান সড়ক ছাড়া এদিকে রিকশার যাত্রী খুব একটা পাওয়া যায় না।

প্রগতি সরণিতে রামপুরা সেতুতে রিকশা চলাচল করতে গেলে তা পুলিশের বাধার মু্খে পড়ে। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

“গলিতে যাত্রী কম থাকে। এই রোডে যাত্রী পাই বেশি, দূরের যাত্রীও আছে। রিশকা বন্ধ হইলে ঝামেলায় পরুম। ইনকাম কমলে চলুম ক্যাম্নে? এরমইধ্যে পোলারে আবার স্কুলে ভর্তি করাইছি।”

এদিন রাজধানীর শাহবাগ থেকে সায়েন্সল্যাব পর্যন্তও রিকশা চলাচল বন্ধ ছিল। বিকেল ৫টার দিকে সায়েন্সল্যাব এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সিটি কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী সড়কে গাড়ির অপেক্ষায় আছেন।

এদের একজন সিটি কলেজের শিক্ষার্থী সানজিদা তাবাসসুম বলেন, তার বাসা পরীবাগে। এখান থেকে নিয়মিত রিকশায় করে যান। রিকশা বন্ধ করে দেওয়ায় ঝামেলা বেড়েছে তার।

“অনেকক্ষণ ধরে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি, পাচ্ছি না। এখান থেকে বাসে ওঠা খুবই কঠিন। এখন বাটা সিগন্যাল পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে সেখান থেকে রিকশা নিতে হবে।”

বিকল্প ব্যবস্থা না করে শাহবাগ থেকে সায়েন্সল্যাব পর্যন্ত রিকশা বন্ধ করে দেওয়ায় ক্ষোভ জানিয়েছেন সরকারি কর্মকর্তা জান্নাতুল ফেরদৌস। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকার বাসা থেকে কর্মস্থল সেগুনবাগিচায় নিয়মিত রিকশায় যেতেন তিনি। রিকশা বন্ধে দুর্ভোগ-খরচ দুটোই বেড়েছে তার।

“আজ সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার পর কোনো রিকশা পাইনি। আর রাস্তায় যে বাস আসে সেগুলো আগে থেকেই ভর্তি হয়ে আসে। ফলে এখান থেকে ওঠা যায় না। এ কারণে সিএনজি অটোরিকশায় যেতে হয়েছে। আমাদের যাতায়াতের খরচ বেড়ে গেল। আর যানবাহনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে অফিসে যেতে দেরি হয়ে গেছে।”

রিকশা বন্ধ করে দেওয়ায় বেশিরভাগ মানুষের কাছ থেকেই ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছেন বলে দাবি করেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন।

রোববার নগর ভবনে এক অনুষ্ঠান শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, যেসব সড়কে রিকশা বন্ধ হয়েছে সেখানে ‘পর্যাপ্ত গণপরিবহন আছে’।

রিকশাহীন সড়কে যানজটের এই চিত্র রোববার বেলা দেড়টার দিকে প্রগতি সরণির নদ্দা এলাকার।

“আমি মনে করি, রিকশা বন্ধ হলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। স্কুলগামী শিশুদের বহনকারী ভ্যানগুলো চলাচল করতে পারবে। আমাদের কিছু বদভ্যাস আছে, স্বল্প দূরত্বে যাওয়ার জন্যও আমরা রিকশায় উঠি। রিকশা বন্ধ হওয়ায় মানুষের মধ্যে হাঁটার অভ্যাস তৈরি হবে।”

ধানমণ্ডি ও আশপাশের এলাকায় পর্যাপ্ত বাস আছে বলেও দাবি করেন মেয়র খোকন।

“আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, এই এলাকায় পর্যাপ্ত বাস রয়েছে। এসব বাস স্বল্প দূরত্বেও যাত্রী বহন করছে। আমাদের জনগণের যদি কোনো অসুবিধা হয় আমরা সেটা দেখছি।”

রিকশার জন্য আলাদা লেইন করে দেওয়া যায় কি না এমন প্রশ্নে মেয়র খোকন বলেন, আলাদা লেইন করার চিন্তা করছেন না তারা।

“আমরা এর আগেও পৃথক লেইন করেছিলাম। কিন্তু কিছুদিন পর রিকশা আবার মূল সড়কে চলে আসে।”

স্কুল শিক্ষার্থীদের বহনকারী রিকশাভ্যান চলাচলে বাধা দেওয়া হবে না বলে জানান তিনি।