আরপি সাহার খুনিদের লক্ষ্য ছিল পুরো সম্প্রদায়কে ধ্বংস করা: ট্রাইব্যুনাল

মুক্তিযুদ্ধের সময় দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা, তার ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহাসহ ৬০ জনকে হত্যার রায় ঘোষণা করে আদালত বলেছে, কেবল ব্যক্তি বা পরিবার নয়, ওই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল পুরো হিন্দু সম্প্রদায়কে ধ্বংস করা।

তাবারুল হকমেহেদী হাসান পিয়াস ওবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 June 2019, 04:11 PM
Updated : 27 June 2019, 04:16 PM

বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বৃহস্পতিবার এ মামলার রায় ঘোষণা করে।

একাত্তরে গণহত্যার তিন ঘটনায় সেই সময়ের রাজাকার বাহিনীর সদস্য টাঙ্গাইলের মাহবুবুর রহমানের ফাঁসির রায় দিয়েছে আদালত।

৭০ বছর বয়সী মাহবুবুর টাঙ্গাইলের মির্জাপুর শান্তি কমিটির সভাপতি বৈরাটিয়া পাড়ার আব্দুল ওয়াদুদের ছেলে। মাহবুবের ভাই আব্দুল মান্নানও সে সময় যুদ্ধাপরাধে অংশ নেন বলে উঠে এসেছে এ মামলার বিচারে।

২৩৫ পৃষ্ঠার রায় ট্রাইব্যুনাল বলেছে, আসামির বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা তিনটি অভিযোগই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন, হত্যা- গণহত্যার তিন অভিযোগেই মাহবুবুরকে সর্বোচ্চ সাজা দিয়েছে আদালত। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে বলা হয়েছে রায়ে।

দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার ম্যুরাল

মানবহিতৈষী কাজে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত থাকায় ব্রিটিশ সরকার রায় বাহাদুর খেতাব দিয়েছিল রণদা প্রসাদ সাহাকে। মানবসেবায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালে সরকার তাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক দেয়। তিনি আর পি সাহা নামেও পরিচিত।

তার পৈত্রিক নিবাস ছিল টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে। এক সময় নারায়ণগঞ্জে পাটের ব্যবসায় নেমে সেখানেই থাকতে শুরু করেন।

১৯৩৮ সালে তিনি মায়ের নামে প্রতিষ্ঠা করেন কুমুদিনী হাসপাতাল। দাদীর নামে গড়ে তোলেন মেয়েদের আবাসিক স্কুল ভারতেশ্বরী হোমস। ১৯৪৩ সালে টাঙ্গাইলে কুমুদিনী কলেজ এং ১৯৪৬ সালে মানিকগঞ্জে বাবার নামে দেবেন্দ্র কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।

ওই সময় দুর্ভিক্ষের মধ্যে কলকাতা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে লঙ্গরখানা খুলে দেন রণদা প্রসাদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রেডক্রসের তহবিলে বড় অংকের অর্থ সহায়তা দেন।

রণদা প্রসাদ তার সকল ব্যবসা, কল-কারখানা, সম্পত্তি এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য ১৯৪৭ সালে গঠন করেন ‘কুমুদিনী ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল’। সে সময় ট্রাস্টের প্রধান কার্যালয় ছিল নারায়ণগঞ্জে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ৭ মে রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট থেকে রণদা প্রসাদ সাহা ও তার ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহাসহ সাতজনকে ধরে নিয়ে যায়। ওই রাজাকার দলের নেতৃত্বে ছিলেন মাহবুবুর রহমান।

এ মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, মাহবুব ও তার সহযোগীরা সাতজনকে তুলে নিয়ে হত্যা করে তাদের লাশ শীতলক্ষ্যায় ফেলে দেয়। তাদের লাশ আর পাওয়া যায়নি।

আসামি মাহবুবুর রহমান

প্রায় পাঁচ দশক পর সেই হত্যাকাণ্ডের জন্য আসামি মাহবুবকে দেষী সাব্যস্ত করে ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “আরপি সাহা এবং তার ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহাকে হত্যা করাই মূল উদ্দেশ্য ছিল না। আরপি সাহার জনক্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান, তার নেতৃত্ব, প্রভাব, গ্রহযোগ্যতা এবং মানব হিতৈষীমূলক কাজকে সমূলে ধ্বংস এবং হিন্দু সম্প্রদায়কে ধ্বংস করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। সুতরাং এটি মানবতার বিরুদ্ধে ‘গণহত্যা’র অপরাধ।”

আদালত বলেছে, “মানব হিতৈষী দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা ও তার ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহাকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া, তাদের হত্যা করা এবং হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে উদ্দেশ্যমূলক এবং পরিকল্পিতভাবে হত্যা-গণহত্যা পরিচালনা করার যে অপরাধ আসামি করেছে, সে অপরাধকে সহজভাবে নেওয়ার আদৌ কোনো সুযোগ নেই।

“কেবল আসমি মাহবুবুর রহমানই নয়, তার বড় ভাই মান্নান, বাবা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মওলানা ওয়াদুদ পাকিস্তানি সেনাদের নিয়েই অপরাধ সংঘটিত করেছে।”

বৃহস্পতিবার এই রায়ের সময় রণদা প্রসাদ সাহার পুত্রবধূ শ্রীমতি সাহা, তার ছেলে রাজীব সাহা এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

রায়ের পর সাংবাদিকদের সামনে কথা বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন ভবানী প্রসাদের স্ত্রী ও ছেলে। কথা বলার সময় তাদের চোখে দেখা যায় অশ্রু।

চোখের পানি মুছতে মুছতে শ্রীমতি সাহা বলেন, “৪৮ বছর পর হলেও বিচার হয়েছে। এই বিচারের কথা যেন সবাই জানে- যে অপরাধের একদিন বিচার হয়। এই ভয়টা যেন তাদের (অপরাধীদের) থাকে। ন্যায়-অন্যায়ের ফলাফল কী হয় তা যেন সবার মধ্যে থাকে। আমরা সব সময় ত্যাগের মধ্যে দিয়ে দিন পার করছি। এই রায় আমরা মাথা পেতে নিলাম। আমরা শান্তি পেয়েছি। উনাদের আত্মার শান্তি হোক।”

রণদা প্রসাদ সাহার নাতি রাজীব সাহা বলেন, “এটা শুধু আমাদের পরিবারের না, পুরো দেশের মাথার ওপর থেকে একটা বোঝা নেমে গেছে। এতদিন নিঃস্ব অবস্থায় ছিলাম। জানতে পারছিলাম না, বুঝতে পারছিলাম যে কী হবে, কোথায় যাব। আজকে বিশাল একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল।”

ঠাকুরদার গড়া কুমুদিনী ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করে আসা রাজীব বলেন, আরপি সাহা আর ভবানী প্রসাদ সাহার ত্যাগ বুকে ধরে তারা তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করে আসছিলেন। সাধারণ মানুষের মত জীবন যাপন করলেও বুকের ‍ভেতরে ছিল গভীর বেদনা।

“আজকে অনেক হালকা বোধ করছি। তাই শুধু না, মনে হচ্ছে উনারা যা করেছেন এই দেশের জন্য, জাতির জন্য, এটার একটা প্রকৃত স্বীকৃতি সকলের কাজ থেকে, এই দেশের মাটির কাছ থেকে আমরা পেয়েছি এই রায়ের মধ্যে দিয়ে।”

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও পাকিস্তানিরা যে যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, তা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরা উচিৎ।

“মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে পাকিস্তানি সৈন্য এবং যেসব পাকিস্তানিরা জড়িত ছিল তাদের বিচার আমরা আইনগতভাবে করতে পারছি না। কিন্তু এ বিষয়গুলো তো বারবারই উঠে এসেছে। আমার মনে হয় যে এ বিষয়টি নানারকমভাবে প্রচার হওয়া উচিৎ।

জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিকভাবে পাকিস্তানি এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের যুদ্ধাপরাধের বিচার করা আইনগত ও প্রক্রিয়াগত কারণে জটিল হলেও ‘মানবতার দায়’ থেকেই তা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন মফিদুল হক।  

“যদি এটা মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়, যদি গণহত্যা হয়, বিশ্বমানবতার বিরুদ্ধে যদি অপরাধ হয়ে থাকে তবে এ দায় শুধু একটা দেশের দায় না, জাতির দায় না, গোটা মানবজাতির দায়।

“ফলে আমার মনে হয় যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই দায়টা তুলে ধরা দরকার। এবং নিশ্চয় এই বিচার (আন্তার্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার) সেখানে সহায়তা করবে।”

মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের এই ট্রাস্টি বলেন, বিভিন্ন রায়ে ট্রাইব্যুনাল বরাবরই বলে আসছে যে মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটনা হয়েছে, সেগুলো ছিল সংঘবদ্ধ অপরাধ।

“এর সাথে পাকিস্তানিদের বিশাল একটি সম্পৃক্ততা ছিল, ভূমিকা ছিল। এ সমস্ত সংঘবদ্ধ অপরাধের জন্য পাকিস্তানিদের বিচারের দাবিটি নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।”