যুদ্ধাপরাধ: রণদা প্রসাদের হত্যাকারীর প্রাণদণ্ড

মুক্তিযুদ্ধের সময় দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা, তার ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহাকে হত্যাসহ গণহত্যার তিন ঘটনায় টাঙ্গাইলের মাহবুবুর রহমানের ফাঁসির রায় দিয়েছে যুদ্ধাপরাধ আদালত।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 June 2019, 06:06 AM
Updated : 13 Jan 2022, 01:43 PM

বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বৃহস্পতিবার আসামির উপস্থিতিতে এ মামলার রায় ঘোষণা করে।

সত্তর বছর বয়সী মাহবুবুর একাত্তরে মির্জাপুর শান্তি কমিটির সভাপতি বৈরাটিয়া পাড়ার আব্দুল ওয়াদুদের ছেলে। মাহবুবুর ও তার ভাই আব্দুল মান্নান সে সময় রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়ে যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান, তা উঠে এসেছে এ মামলার বিচারে।

২৩৫ পৃষ্ঠার রায় ট্রাইব্যুনাল বলেছে, আসামির বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা তিনটি অভিযোগই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন, হত্যা- গণহত্যার তিন অভিযোগেই মাহবুবুরকে সর্বোচ্চ সাজা দিয়েছে আদালত।  ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে বলা হয়েছে রায়ে।

রণদা প্রসাদ সাহার পুত্রবধূ স্ত্রী শ্রীমতি সাহা ও নাতি রাজীব প্রসাদ সাহাসহ কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের বেশ কয়েকজন রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

একাত্তরে বাবা আর দাদাকে হারানো রাজীব এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “আমাদের পরিবারের ওপর এটা একটা বোঝা হয়ে ছিল। আজ আমরা বিচার পেলাম।”

রণদা প্রসাদ সাহার পুত্রবধূ ব‌লেন, “অত্যাচা‌রের বিচার পে‌য়ে‌ছি, স্বাধীনতার এত বছর পর হ‌লেও উত্তর পে‌য়ে‌ছে আগামী প্রজন্ম। বাংলা‌দে‌শে এ ধর‌নের ঘটনা লজ্জাজনক, মর্মা‌ন্তিক। আর‌পি সাহার ম‌তে মহান একজন ব্য‌ক্তি‌কে হত্যা করা হ‌য়ে‌ছে। আমরা এ রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। এবং সবার কাছে আশির্বাদ চাই।

অন্যদিকে আসামির আইনজীবী গাজী এম এইচ তামিম বলেন, এই রায়ে তারা সংক্ষুব্ধ, তারা আপিল করবেন।

নিয়ম অনুযায়ী, রায়ের এক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ পাবেন আসামি মাহবুবুর রহমান।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত রায় আসা ৩৮টি মামলার ৯৬ আসামির মধ্যে ছয়জন বিচারাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। মোট ৮৮ জনের সাজা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৬১ যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ সাজার রায় এসেছে।

 

দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার ম্যুরাল

দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা

মানবহিতৈষী কাজে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত থাকায় ব্রিটিশ সরকার রায় বাহাদুর খেতাব দিয়েছিল রণদা প্রসাদ সাহাকে। মানবসেবায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালে সরকার তাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক দেয়।

রণদা প্রসাদ সাহার পৈত্রিক নিবাস ছিল টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে। কিশোর বয়সে বাড়ি পালিয়ে কলকাতা গিয়ে কুলি, মজুর, ফেরিওয়ালার কাজে কাটে তার প্রথম যৌবন। এক পর্যায়ে স্বদেশী আন্দোলনে জড়িয়ে কারাগারেও যান।

তার চাকরিজীবন শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরের সদস্য হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্রে আহত ও অসুস্থদের সেবা দেওয়ার মধ্যে দিয়ে। যুদ্ধ শেষে রেলওয়ের টিকেট কালেক্টরে চাকরি পান তিনি। ১৯৩২ সালে ওই চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার সময় পাওয়া অর্থ দিয়ে শুরু করেন ব্যবসা।

প্রথমে লবণ ও কয়লার ব্যবসা শুরু করলেও পরে ঠিকাদারী ব্যবসায় বড় আকারের পুঁজি সংগ্রহ করেন রণদা প্রসাদ। এক পর্যায়ে তিনি বেশ কিছু লঞ্চের মালিক হয়ে যান এবং সেসব নৌযান মেরামতের জন্য গড়ে তোলেন নারায়ণগঞ্জের প্রথম ডকইয়ার্ড।

১৯৪০ সালে তিনি নারায়ণগঞ্জে জর্জ অ্যান্ডারসনের পাটের ব্যবসা কিনে নেন।  তখন থেকেই নারায়ণগঞ্জের খানপুরে থাকতে শুরু করেন।

ব্যবসায়ী হিসেবে পাওয়া সাফল্যে প্রথম জীবনের সেবার ধর্ম ভুলে যাননি রণদা প্রসাদ। ১৯৩৮ সালে তিনি মায়ের নামে প্রতিষ্ঠা করেন কুমুদিনী হাসপাতাল। দাদীর নামে গড়ে তোলেন মেয়েদের আবাসিক স্কুল ভারতেশ্বরী হোমস। ১৯৪৩ সালে টাঙ্গাইলে কুমুদিনী কলেজ এং ১৯৪৬ সালে মানিকগঞ্জে বাবার নামে  দেবেন্দ্র কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।

ওই সময় দুর্ভিক্ষের মধ্যে কলকাতা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে লঙ্গরখানা খুলে দেন রণদা প্রসাদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রেডক্রসের তহবিলে বড় অংকের অর্থ সহায়তা দেন। এছাড়া জনস্বার্থে নানা কাজে অর্থ দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন দানবীর আর পি সাহা। 

রণদা প্রসাদ তার সকল ব্যবসা, কল-কারখানা, সম্পত্তি এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য ১৯৪৭ সালে গঠন করেন ‘কুমুদিনী ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল’। সে সময় ট্রাস্টের প্রধান কার্যালয় ছিল নারায়ণগঞ্জে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ৭ মে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর সহযোগীরা কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট থেকে রণদা প্রসাদ সাহা ও তার ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহাকে ধরে নিয়ে যায়। পরে তাদের আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

কে এই মাহবুব

অভিযোগপত্রের তথ্য অনুযায়ী, মাহবুব একসময় জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক ছিলেন। তিনি তিনবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হলেও প্রতিবারই পরাজিত হন।

২০১৬ সালের ১৮ এপ্রিল মামলাটির তদন্ত শুরুর পর ট্রাইব্যুনাল থেকে পরোয়ানা জারি হলে ওই বছরের নভেম্বরে মাহবুবকে গ্রেপ্তার করা হয়।

২০১৭ সালের ২ নভেম্বর এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনে দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা মো. আতাউর রহমান।

তার আগে এক সংবাদ সম্মেলনে তদন্ত প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান ও জ্যেষ্ঠ সমম্বয়ক সানাউল হক।

হান্নান খান তখন বলেছিলেন, আসামি মাহবুবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মে মধ্যরাতে নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ২০-২৫ জন সদস্যকে নিয়ে রণদা প্রসাদ সাহার বাসায় হামলা চালায়।

“তারা রণদা প্রসাদ সাহা, তার ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহা, রণদা প্রসাদের ঘনিষ্ঠ সহচর গৌর গোপাল সাহা, রাখাল মতলব ও রণদা প্রসাদ সাহার দারোয়ানসহ ৭ জনকে তুলে নিয়ে হত্যা করে তাদের লাশ শীতলক্ষ্যায় ফেলে দেয়। তাদের লাশ আর পাওয়া যায়নি।”

অভিযোগপত্রে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় মির্জাপুরের ভারতেশ্বরী হোমসের আশপাশের এলাকা, নারায়ণগঞ্জের খানপুরের কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট ও তার আশপাশের এলাকা এবং টাঙ্গাইল সার্কিট হাউজ এলাকায় অপরাধ সংঘটন করেন আসামি মাহবুব।

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রসিকিউশনের দেওয়া অভিযোগপত্র আমলে নেওয়ার পর ২৮ মার্চ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। এক বছরের বেশি সময় শুনানির পর গত ২৪ এপ্রিল মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল

উদ্দেশ্য ছিল আরও গভীর

বৃহস্পতিবার আসামি মাহবুবুর রহমানের সর্বোচ্চ সাজার আদেশ দিয়ে ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, “কেবল আরপি সাহা এবং তার ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহাকে হত্যা করাই আসামিদের মূল উদ্দেশ্য ছিল না, আরপি সাহার জনক্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান, তার নেতৃত্ব, প্রভাব, গ্রহযোগ্যতাকে সমূলে ধ্বংস ও হিন্দু সম্প্রদায়কে ধ্বংস করাও ছিল তাদের উদ্দেশ্য।

“সুতরাং মানব হিতৈষী দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা ও তার ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহাকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া, তাদের হত্যা করা এবং হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে উদ্দেশ্যমূলক এবং পরিকল্পিতভাবে হত্যা-গণহত্যা পরিচালনা করার যে অপরাধগুলো আসামি করেছে সে অপরাধগুলোকে সহজভাবে নেওয়ার আদৌ কোনো কারণ নাই।”

কেবল আসমি মাহবুবুর রহমানিই নন, তার বড় ভাই মান্নান, বাবা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মওলানা ওয়াদুদ সে সময় পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে অপরাধ সংঘটিত করেছে বলেও উল্লেখ করা হয় রায়ে।

রাষ্ট্রপক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত। আসামিপক্ষে ছিলেন গাজী এম এইচ তামিম।

রানা দাশগুপ্ত রায়ের পর সাংবাদিকদের বলেন, প্রসিকিউশন সন্দেহাতীতভাবে তিনটি অভিযোগ প্রমাণ করতে পেরেছে। এ কারণে ট্রাইব্যুনাল তিনটি অভিযোগেই আসামি মাহবুবুর রহমানকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে।

“প্রসিকিউশনের দায়িত্ব হল মামলা প্রমাণ করা। সঙ্গত কারণেরই আমরা মনে করি আমরা আমাদের দায়িত্ব নিষ্ঠা, সততা এবং আন্তরিকতার সাথে পালন করতে পেরেছি। এ রায়ে অবশ্যই আমরা সন্তুষ্ট।”

‘এই রায় মাথা পেতে নিলাম’

আরপি সাহার ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহার স্ত্রী শ্রীমতি সাহা ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “আমাদের দেশের উপর, আমাদের পরিবারের উপর এত অন্যায় এত অবিচার হয়েছিল, আজকে এই রায়ের মাধ্যমে তা স্বীকার করে নেওয়া হল।”

চোখের পানি মুছতে মুছতে শ্রীমতি সাহা বলেন, “৪৮ বছর পর হলেও বিচার হয়েছে। এই বিচারের কথা যেন সবাই জানে- যে অপরাধের একদিন বিচার হয়। এই ভয়টা যেন তাদের (অপরাধীদের) থাকে। ন্যায়-অন্যায়ের ফলাফল কী হয় তা যেন সবার মধ্যে থাকে। আমরা সব সময় ত্যাগের মধ্যে দিয়ে দিন পার করছি। এই রায় আমরা মাথা পেতে নিলাম। আমরা শান্তি পেয়েছি। উনাদের আত্মার শান্তি হোক।”

রণদা প্রসাদ সাহার নাতি রাজীব সাহা বলেন, “এটা শুধু আমাদের পরিবারের না, পুরো দেশের মাথার ওপর থেকে একটা বোঝা নেমে গেছে। এতদিন নিঃস্ব অবস্থায় ছিলাম। জানতে পারছিলাম না, বুঝতে পারছিলাম যে কী হবে, কোথায় যাব। আজকে বিশাল একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল।”

ঠাকুরদার গড়া কুমুদিনী ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করে আসা রাজীব বলেন, আরপি সাহা আর ভবানী প্রসাদ সাহার ত্যাগ বুকে ধরে তারা তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করে আসছিলেন। সাধারণ মানুষের মত জীবন যাপন করলেও বুকের ‍ভেতরে ছিল গভীর বেদনা।

“আজকে অনেক হালকা বোধ করছি। তাই শুধু না, মনে হচ্ছে উনারা যা করেছেন এই দেশের জন্য, জাতির জন্য, এটার একটা প্রকৃত স্বীকৃতি সকলের কাজ থেকে, এই দেশের মাটির কাছ থেকে আমরা পেয়েছি এই রায়ের মধ্যে দিয়ে।

“আমরা প্রণাম জানাই এই দেশের মাটিকে, এই দেশের মানচিত্রকে। যারা এই দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন এবং যারা এখনও এই দেশের স্বার্থে, সকলের মঙ্গলের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তাদের সকলের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।”

আরপি সাহার শুরু করে যাওয়া কাজগুলো যেন যুগ যুগ ধরে চালিয়ে যাওয়ায় যায়, সেজন্য সবার সহযোগিতা চান রাজীব।

আক্ষেপ করে তিনি বলেন, “একাত্তরে মাহবুবুর রহমানের সাথে যারা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন, তারা বেঁচে থাকলে আজকের এই রায়ে অবশ্যই তাদেরও একটা কিছু হত। তবে যা হয়েছে, যে রায় হয়েছে তা শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করছি।”