তিন দশক পর সচল হচ্ছে সগিরা মোর্শেদ সালাম হত্যা মামলা

তিন দশক আগে রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সামনে ছিনতাইয়ের সময় সগিরা মোর্শেদ সালাম হত্যার ঘটনায় করা মামলার উপর স্থগিতাদেশ তুলে নিয়েছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 June 2019, 09:10 AM
Updated : 26 June 2019, 10:02 AM

মামলাটিতে অধিকতর তদন্তের আদেশের বিরুদ্ধে করা ২৮ বছর আগের আবেদন খারিজ করে দিয়ে বুধবার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের বেঞ্চ রায় দেয়।

সেসঙ্গে ৬০ দিনের মধ্যে মামলাটির অধিকতর তদন্ত শেষ করতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দিয়েছে আদালত এবং তদন্ত শেষ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করতে বলেছে।

আবেদনের পক্ষে আদালতে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন। তার সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী মোতাহার হোসেন। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ফরহাদ আহমেদ।

মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই সগিরা মোর্শেদ সালাম ভিকারুননিসা নূন স্কুল থেকে মেয়েকে আনতে যাচ্ছিলেন। বিকাল ৫টার দিকে সিদ্ধেশ্বরী রোডে পৌঁছামাত্র মটরবাইকে আসা ছিনতাইকারীরা তার হাতের সোনার চুড়ি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। তিনি দৌড় দিলে তাকে গুলি করা হয়। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পথেই সগিরা মোর্শেদ সালাম মারা যান।

ওই দিনই রমনা থানায় অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে মামলা করেন সগিরা মোর্শেদ সালামের স্বামী সালাম চৌধুরী। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রিকশাচালক জড়িত দুজনকে শনাক্ত করলেও অজ্ঞাতকারণে মিন্টু ওরফে মন্টু ওরফে মরণ নামে একজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় গোয়েন্দা পুলিশ।

১৯৯১ সালের ১৭ জানুয়ারি আসামি মন্টুর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতের বিচারক আবু বকর সিদ্দীক। সাক্ষ্য নেওয়া হয় সাতজনের।

সাক্ষ্যে বাদীপক্ষ থেকে বলা হয়, তদন্তকালে আসামি মন্টু এবং তৎকালীন (১৯৮৯) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসানের নিকটাত্মীয় মারুফ রেজা গ্রেপ্তার হন। কিন্তু মারুফ রেজার নাম বাদ দিয়েই অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।

সাক্ষ্যগ্রহণ চলাকালে মারুফ রেজার নাম আসায় রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে ১৯৯১ সালের ২৩ মে মামলার অধিকতর তদন্তের আদেশ দেয় ঢাকার বিচারিক আদালত।

ওই আদেশের বিরুদ্ধে মারুফ রেজার রিভিশন আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯১ সালের ২ জুলাই হাই কোর্ট মামলাটির অধিকতর তদন্তের আদেশ ও বিচারকাজ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করার পাশাপাশি অধিকতর তদন্তের আদেশ কেন বাতিল করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে।

পরের বছর ২৭ অগাস্ট জারি করা রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ওই মামলার বিচারকাজ স্থগিত থাকবে বলে আরেকটি আদেশ দেয় হাই কোর্ট।

এ মামলার সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা সম্প্রতি বিষয়টি অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের নজরে আনলে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেয় রাষ্ট্রপক্ষ। এরপর বিষয়টি বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের বেঞ্চে তোলা হয়।

শুনানি করে আদালত বুধবার এ হত্যা মামলার বিচারকাজ স্থগিত করে জারি করা রুল খারিজ করে রায় দেয়।

‘২৮টা বছরে ভিকটিমকে আমরা কী দিলাম?’

শুনানিতে ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, ১৯৯১ সালে এ মামলার সাতজনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। তখন অধিকতর তদন্তের আদেশ হলো। আবেদনকারীর নাম এফআইআর-চার্জশিটে তো ছিল না।

বিচারক বলেন, “তাহলে তিনি সংক্ষুব্ধ হলেন কেন? কীভাবে তিনি হাই কোর্টে আবেদন করলেন? অধিকতর তদন্তে তার নাম তো নাও আসতে পারত। রাষ্ট্রপক্ষের উকিল আগের শুনানিতে বলেছিলেন, ‘ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না’ বিষয়টা তো এরকম! মন্ত্রী সাহেবের ভাগ্নে…এত ক্ষমতাবান তারা! অধিকতর তদন্তে বাধা কোথায়?

ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, মামলার ২ বছর পরে সাক্ষি হয়েছে।

বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক বলেন, মাত্র সাতটা সাক্ষী হল। তদন্ত হলে কী যে হয়! দেখবেন চিকিৎসক হয়ত মারা গেছেন। আল্লাই জানে কী হবে! এত দিনেও ভিকটিমের পরিবারকে রাষ্ট্র কোনো বিচার দিতে পারেনি। ২৮টা বছরে এ মামলার ভিকটিমকে আমারা কী দিতে পারলাম! সামগ্রিকভাবে এটা আমাদের ব্যার্থতা।’

আবেদনকারীর আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন তখন বলেন, আসামি মন্টু আছে তো।

বিচারক বলেন, “মন্টু থেকে কী হবে? মন্ত্রী সাহেবের ভাগ্নের নাম আসলে যে তিনি দোষী হতেন এমন তো না। তদন্ত হতে বাধা কোথায়? সামগ্রিকভাবে বিচার বিভাগসহ সবাই আমরা ভিকটিমের পরিবারকে বিচার দিতে পারিনি। এখন তো ওই রিকশাচালককে খুঁজে পাওয়া যাবে না। পেলেও তিনি কি আসবেন?”

এ পর্যায়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ফরহাদ আহমেদ বলেন, “নিম্ন আদালতের অধিকতর তদন্তের আদেশ ভুল এমন কোনো কথা তারা বলেননি। এখন অধিকতর তদন্তের জন্য টাইমফ্রেম ঠিক করার আবেদন জানাচ্ছি।”

এরপর আদালত আবেদন খরিজ করে রায় দেয়।

তার সঙ্গে ২০১০ সাল পর্যন্ত যেসব ফৌজদারি মামলার উপর হাই কোর্টের স্থগিতাদেশ রয়েছে তার তালিকা তিন সপ্তাহের মধ্যে প্রস্তুত করে প্রধান বিচারপতির কাছে উপস্থাপন করতে হাই কোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আদালত বলে, “এসব মামলা (ফৌজদারি রিভিশন/ফৌজদারি কার্যবিধি ৫৬১(ক) ধারার মামলা বাতিলের  আবেদন) যদি নিষ্পত্তির জন্য প্রধান বিচারপতি আমাদের বেঞ্চে পাঠান আমরা তা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করব।”