এজলাসে উদ্ধত পুলিশ কর্মকর্তাকে থামালেন বিচারক

গুলশান হামলার মামলার শুনানিতে সাক্ষ্য দিতে এসে পুলিশের এক কর্মকর্তা আসামি পক্ষের আইনজীবীর সঙ্গে উদ্ধত আচরণ করলে তাকে থামাতে হস্তক্ষেপ করতে হল বিচারককে।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 June 2019, 04:50 PM
Updated : 25 June 2019, 05:13 PM

মঙ্গলবার ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইবুনালে সাক্ষ্য দিতে উপস্থিত হন ২০১৬ সালে হামলার সময় গুলশান জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনারের দায়িত্বে থাকা আব্দুল আহাদ।

হলি আর্টিজান বেকারিতে ওই জঙ্গি হামলা ঠেকাতে গিয়ে আহত হয়েছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা আহাদ। চিকিৎসার জন্য বিদেশেও যেতে হয়েছিল তাকে।

মঙ্গলবার আদালতে পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তা সাক্ষ্য দেন; তার মধ্যে প্রথমে সাক্ষ্য দেন আহাদ।

তিনি জবানবন্দিতে বলেন, ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনা জানতে পেরে ৫-৭ মিনিটের মধ্যে সেখানে উপস্থিত হন তিনি। তার সঙ্গে গুলশান জোনের উপকমিশনার মোস্তাকও ছিলেন।

আহাদ বলেন, ওই এলাকা ঘিরে ফেলার পর যখন হলি আর্টিজানের ফটকে মহানগর পুলিশ কমিশনার ‘ব্রিফ করছিলেন’, তখন জঙ্গিরা ভেতর থেকে গ্রেনেড ছোড়ে। তাতে তিনি,  ডিবির সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিন  মারাত্মক আহত হন।

“১০-১২টা স্প্লিন্টারের আঘাত আমার শরীরে লাগে। আমার শরীর থেকে অঝোরে রক্ত ঝরছিল। এরপর অচেতন অবস্থায় আমাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। জ্ঞান ফেরার পর শুনতে পারি সালাউদ্দিন ও রবিউল মারা গেছেন।”

২১ দিন ইউনাইটেড এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকার সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে পাঠায় আহাদকে।

আহাদ জবানবন্দি দেওয়ার পর আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহমেদ জেরা শুরু করেন।

ফারুক বলেন, “আপনি যে ১৬১ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন, সেখানে ডিসি মোস্তাকের নাম উল্লেখ করেননি “

জবাবে আহাদ বলেন, “আমি সেখানে ডিসি গুলশান উল্লেখ করেছিলাম।”

আইনজীবী ফারুক তখন বলেন, “আপনি তো নাম বলেননি।”

তখন আহাদ বলেন, “আমি প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করেছি। তিনি তখন ওই খানে কর্মরত ছিলেন।”

আসামিপক্ষের আইনজীবী প্রশ্ন করেন, “আপনি যে জবানবন্দিতে বললেন, আপনি থাইল্যান্ডে চিকিৎসা নিয়েছেন, একথা কি মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেওয়া ১৬১ ধারায় জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছিলেন?”

আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, থাইল্যান্ডে এ পুলিশ কর্মকর্তা ২০১৯ সালে চিকিৎসা নেন। আর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তার জবানবন্দি নেন ২০১৬ সালের ১৪ ডিসেম্বরে।

এসব নিয়ে জেরার এক পর্যায়ে আহাদ চেঁচিয়ে উঠে বলেন, “আমি আহত হয়েছি। আমি জানি কী ঘটনা হয়েছিল । আপনি তো জানেন না “

আইনজীবী ১৬১ ধারায় দেওয়া জবানবন্দির অনুলিপি দেখাতে গেলে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আহাদ বলেন, “আপনি এখানে এসেছেন কেন? আপনি ডায়াসে যান। আপনি আমাকে চেনেন?”

ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী চেষ্টা করেও আহাদকে থামাতে না পারার পর বিচারক হস্তক্ষেপ করেন।

বিচারক মো. মজিবুর রহমান এই পুলিশ কর্মকর্তাকে বলেন, “এটা কোর্ট, এখানে অবান্তর প্রশ্নও আসতে পারে। টেম্পার হারালে চলবে না। কোর্টকে সম্মান দেখাতে হবে।”

আলোচিত এই মামলায় আহাদ রাষ্ট্রপক্ষের ৫৬তম সাক্ষী। তারপর মঙ্গলবার সাক্ষ্য দেন বর্তমানে ঢাকার  কদমতলী থানার পরিদর্শক মাহবুব আলম, বর্তমানে নড়াইলের এসপি জসীমউদ্দিন, ঢাকার মহানগর পুলিশের সহকারী কমিশনার মো. ওবায়দুল হক, বর্তমানে ভাটারা থানায় কর্মরত এসআই মো. বিল্লাল হোসেন। তারা সবাই সেদিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।

৬০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে বিচারক মজিবুর রহমান আগামী ২ জুলাই পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন।

এদিন কারাগারে থাকা আসামি মামুনুর রশীদ ওরফে রিপন, শফিকুল ইসলাম ওরফে খালেদ, আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে আবু জাররা ওরফে র‌্যাশ, হাদিসুর রহমান সাগর, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব ওরফে রাজীব গান্ধী ও আব্দুস সবুর খান (হাসান) ওরফে সোহেল মাহফুজকে আদালতে হাজির করা হয়।

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে হলি আর্টিজান বেকারিতে পাঁচ তরুণের ওই হামলায় ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে জবাই ও গুলি করে হত্যা করা হয়।

নজিরবিহীন ওই হামলা দেশে জঙ্গিবাদের বিপদজনক বিস্তারের মাত্রা স্পষ্ট করে তোলে। বড় ওই ধাক্কা বাংলাদেশকে বদলে দেয় অনেকখানি।

দুই বছরের বেশি সময় ধরে তদন্তের পর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির গত ২৩ জুলাই হামলায় জড়িত ২১ জনকে চিহ্নিত করে তাদের মধ্যে জীবিত আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন।

চিহ্নিত বাকি ১৩ জন বিভিন্ন অভিযানে নিহত হওয়ায় তাদের অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, নব্য জেএমবির জঙ্গিরা ছয় মাস ধরে পরিকল্পনা করে ওই হামলা চালিয়েছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, দেশকে ‘অস্থিতিশীল’ করা, বাংলাদেশকে একটি ‘জঙ্গি রাষ্ট্র’ বানানো।

পাঁচ তরুণের সরাসরি অংশগ্রহণে হলি আর্টিজান বেকারিতে ওই হামলায় ২০ জনকে জবাই ও গুলি করে হত্যা করা হয়।

পরদিন কমান্ডো অভিযানে নিহত হন হামলাকারী পাঁচ তরুণ - রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিবরাজ ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল।