গত বছরের শেষ প্রান্তে ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে ৮০ শতাংশের মতো ভোটার ভোট দিয়েছিলেন।
এরপর দুই মাস পর গত মার্চে উপজেলা পরিষদের নির্বাচন শুরু হয়ে পাঁচ ধাপে ভোটগ্রহণ শেষ হয় মঙ্গলবার। এরপর ইসি দেওয়া হিসাবে দেখা যায়, গড়ে ভোট পড়েছে ৪০ দশমিক ২২ শতাংশ।
অর্থাৎ ৩০০ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচনে যত সংখ্যক ভোটার ভোট দিয়েছিলেন, তার অর্ধেক ভোটার পাঁচশর মতো উপজেলায় ভোট দিতে যাননি।
“অন্য কারও হস্তক্ষেপ হলে উপজেলা নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, স্বাভাবিক ও শুদ্ধ হবে না। এমতাবস্থায় স্থানীয় নির্বাচন বা উপজেলা নির্বাচন সংবিধানসম্মতভাবে হয়েছে কি না, এ প্রশ্ন থেকে যায়,“ বলেন তিনি।
উপজেলা নির্বাচনের শুরু থেকেই ভোট কেন্দ্রে ভোটার অনুপস্থিতির বিষয়টি ছিল আলোচিত; প্রথম ধাপে ৪১ শতাংশ ভোটগ্রহণের পর তা ক্রমান্বয়ে কমতে কমতে চতুর্থ ধাপে ৩৬ শতাংশে নেমে আসে। মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত শেষ ধাপের নির্বাচনে ভোটের হার আগের ধাপের চেয়ে সামান্য বেড়েও ৩৯ শতাংশে আটকে যায়।
কয়েক মাসের ব্যবধানে নির্বাচনে ভোটের হারের এই অধঃগতিতে রাজনৈতিক অঙ্গনের অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।
নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার এতে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়েই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
সংসদ নির্বাচনের আগে থেকে ইসিতে সহকর্মীদের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণের জন্য আলোচিত মাহবুব তালুকদার বলেছেন,
তিনি বলেছেন, “এবারের উপজেলা নির্বাচনে সবচেয়ে আশঙ্কার দিক হচ্ছে ভোটারদের নির্বাচনবিমুখতা। একটি গণতান্ত্রিক দেশ ও জাতির জন্য নির্বাচনবিমুখতা অশনি সংকেত। এই নির্বাচন বিমুখতা জাতিকে গভীর খাদের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।”
এর আগে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্প ধারা বাংলাদেশের সভাপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীও ভোটারদের এই বিমুখতাকে ‘বিপজ্জনক’ বলেছিলেন; এর কারণ খুঁজে দেখার পরামর্শও দিয়েছিলেন তিনি।
ভোটের হার কমে যাওয়ার পেছনে নানা কারণ উঠে এসেছে উপজেলা নির্বাচন চলাকালীন নানা জনের কথায়।
মাহবুব তালুকদার বলছেন, “কর্তৃত্ববাদী শাসনের অনিশ্চিত গন্তব্যে বাংলাদেশ।”
উপজেলা নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ না করার বিষয়টি দেখিয়ে তিনি বলেন, “একতরফা নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয় …
কিন্তু আমরা ক্রমাগত একতরফা নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হচ্ছি, যা গণতন্ত্রের জন্য অনভিপ্রেত। যথোপযুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে অবশ্যই সমুন্নত রাখতে হবে।”
২০১৪ সালের ছায়া কাটিয়ে উৎসাহের মধ্যে সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়েছিল একাদশ সংসদ নির্বাচন। কিন্তু তাতে ‘ভোট ডাকাতি’র অভিযোগ তুলে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপিসহ নিবন্ধিত অধিকাংশ রাজনৈতিক দল। ইসির প্রতি অনাস্থাও জানিয়ে আসছে তারা।
উপজেলায় ভোটের হার কমে যাওয়ার জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপিকেই দায়ী করে আসছেন। তারা বলছেন, বিএনপির বর্জন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনকে দূরে ঠেলে দিয়েছে, আর এতে ক্ষমতাসীনদের কিছু করার নেই।
ক্ষমতাসীনরা কিছুটা দায় ইসির দিকে ঠেলে দিলেও ভোটার অনুপস্থিতি নিয়ে সমালোচনার জবাবে ইসি বরাবরই তাদের দায় অস্বীকার করে আসছে।
উপজেলা ভোটের আগে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে উপনির্বাচনে ৩১ শতাংশ ভোটের হার নিয়েও সন্তোষ প্রকাশ করে সিইসি কে এম নূরুল হুদা বলেছিলেন, বিএনপি অংশ না নিলেও ঢাকার ভোট ‘তাৎপর্যপূর্ণ হয়েছে’।
উপজেলা নির্বাচনের মধ্যে তৎকালীন ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, তারা ভোটের হার নিয়ে চিন্তিত নন। ভোটার বাড়লে অনিয়ম বাড়ত- এমন মন্তব্যও এসেছিল তার কাছ থেকে।
হেলালুদ্দীন আবার এটাও বলেছিলেন, “পৃথিবীজুড়ে মানুষের ভোট দেওয়ার প্রবণতা ক্রমেই কমে আসছে। এর অন্যতম কারণ হল- কোনো সরকারের কাছে মানুষের যে প্রত্যাশা থাকে, সেটি যদি পূরণ হয়, তখন স্বাভাবিকভাবে মানুষের ভোট দেওয়ার আগ্রহ কমে যায়।”
তবে সব দলের অংশগ্রহণ না হওয়া যে উপজেলায় ভোটের হার কমে যাওয়ার মূল কারণ, তা স্বীকার করে নিয়েছেন সিইসিসহ ইসির কর্তাব্যক্তিরা, নানা সময়ে।
ভোটের হার কমে যাওয়া নিয়ে আওয়ামী লীগের জোট শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননও উদ্বেগ জানিয়েছেন। তবে তিনি এজন্য ভিন্ন একটি কারণ চিহ্নিত করেছেন।
বর্ষীয়ান এই বাম নেতা মনে করেন, নির্বাচনের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে গেছে নির্বাচন ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কারণে।
মেনন বলেন, “পাঁচ দফা উপজেলা নির্বাচনে আমাদের দলের অভিজ্ঞতা, এমনকি আওয়ামী লীগ নিজ দলের প্রার্থীদের অভিজ্ঞতা করুণ। নির্বাচন কমিশন, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বলেও কোনো লাভ হচ্ছে না। বরং তাদের যোগসাজশ রয়েছে।”
মেননের মতো অন্য বাম নেতারাও মনে করেন, নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতিই মানুষ এখন আস্থা হারিয়ে ফেলেছে।
“এটা নির্বাচনের জন্য কেবল নয়, গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক। নির্বাচনকে যথাযথ মর্যাদায় ফিরিয়ে আনার কাজটি আমাদের করতে হবে,” বলেছেন তিনি।
উপজেলায় দুই-তৃতীয়াংশ নৌকার
সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের মধ্যেও যেমন নিরঙ্কুশ জয় ছিল আওয়ামী লীগের; উপজেলায় বেশিরভাগ দলের বর্জনের মধ্যেও নৌকার জয় একই রকম।
দুই-তৃতীয়াংশ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। নৌকা প্রতীক তিন শতাধিক উপজেলায় জয়ী হয়েছে, দলটির বিদ্রোহী প্রার্থীও জিতেছেন অনেক স্থানে।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, ৪৭০টির মতো উপজেলার মধ্যে ১১৫টির চেয়ারম্যান প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন।
ভোটাভুটিতে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের ৩১৭ জন নৌকা প্রতীকে জয় পান। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছেন ১৪৯টি উপজেলায়; তাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগেরই নেতা।