ওসি মোয়াজ্জেম কারাগারে, অভিযোগ গঠন ৩০ জুন

নুসরাত জাহান রাফির জবানবন্দির ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়ানোর মামলায় গ্রেপ্তার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে কারাগারে পাঠিয়ে অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্য ৩০ জুন দিন রেখেছে আদালত।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 June 2019, 08:48 AM
Updated : 17 June 2019, 02:52 PM

এই পুলিশ কর্মকর্তার জামিন আবেদন নাকচ করে বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মাদ আস সামছ জগলুল হোসেন সোমবার এই আদেশ দেন।

সাইবার ট্রাইব্যুনাল পরোয়ানা জারির ২০ দিন পর রোববার বিকালে ঢাকার হাই কোর্ট এলাকা থেকে ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেমকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রায় তিন সপ্তাহ লাপাত্তা থাকার পর আগাম জামিন চাইতে হাই কোর্টে গিয়েছিলেন তিনি।

আদালতের জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সোনাগাজী থানায় পাঠানো হয়েছিল বলে সেখান থেকে পুলিশের একটি দল ঢাকায় এসে সোমবার সকালে পরিদর্শক মোয়াজ্জেমের দায়িত্ব বুঝে নেন। দুপুরে একটি প্রিজন ভ্যানে করে তাকে পুরান ঢাকার আদালতপাড়ায় নেওয়া হয়।  

বাদামি রঙের টি শার্ট ও কালো চশমা পরা মোয়াজ্জেমকে বেলা সোয়া ২টার পর আদালত কক্ষে নেওয়া হলে প্রথমে তাকে কাঠগড়ার বাইরে হেলান দিয়ে দাঁড়াতে দেখা যায়। থানা থেকে আনার পর কখনোই তার হাতে হাতকড়া দেখা যায়নি। 

সেখানে উপস্থিত বেশ কয়েকজন আইনজীবী এবং আদালতের পেশকার এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এ আসামিকে কাঠগড়ার ভেতরে নেওয়া হয়।

মোয়াজ্জেমের পক্ষে আদালতে জামিন আবেদন করেন তার আইনজীবী সালমা সুলতানা। আর জামিন আবেদনের শুনানি করেন মো. ফারুক আহাম্মাদ। শুননির সময় ওসি মোয়াজ্জেমকে আশপাশে থাকা পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়।

জামিন আবেদনের ওপর শুনানি শুরুর আগে বিচারক আসামিপক্ষের আইনজীবীর কাছে জানতে চান, এই আবেদন তিনি বাদী অথবা রাষ্ট্রপক্ষেকে দেখিয়েছেন কি না।

এ সময় আসামিপক্ষ এজলাসে উপস্থিত মামলার বাদী সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনকে আবেদনের অনুলিপি সরবরাহ করলে তিনি তাতে ‘অবজেকশন’ লিখে দেন।

বাদী বলেন, “গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির ২০ দিন পর তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে। আইনের লোক হয়ে তিনি এতদিন পালিয়ে ছিলেন। তিনি পালিয়ে থেকে পুলিশ বিভাগের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছেন। ইনস্টিটিউশন ধ্বংস করেছেন। এ কারণে তার নিজের ও তার ইনস্টিটিউশনের সংশোধন দরকার।”

উত্তরে আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক বলেন, “তার সিকিউরিটি সমস্যা ছিল। যে কারণে মাননীয় আদালতে এসে এতদিনে আত্মসমর্পণ করনেনি।”

তার এ কথার প্রেক্ষিতে বিচারক বলেন, “কি রকম কথা বললেন! সে আইনের লোক। আইনের সেবক হয়ে তার ইনসিকিউরিটি কেন?”

উত্তরে ফারুক বলেন, “বিভিন্ন লোক তাকে জিজ্ঞাসা, খোঁচাখুচি করবে… আর মিডিয়া রয়েছে, সে কারণে।”

পরিদর্শক মোয়াজ্জেমের আইনজীবী বলেন, তার মক্কেল কেবল নুসরাতের জবানবন্দি নিয়েছেন। কোথাও তা প্রচার করেননি। তিনি পলাতকও ছিলেন না।

শুনানি শেষে বিচারক মোজাম্মেলের জামিন আবেদন নাকচ করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। সেই সঙ্গে অবিযোগ তদন্ত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) দেওয়া প্রতিবেদনকে অভিযোগপত্র হিসেবে নিয়ে অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্য ৩০ জুন দিন ঠিক করে দেন।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৬, ২৯ ও ৩১ ধারায় দায়ের করা এ মামলায় দোষী প্রমাণিত হলে পুলিশ পরিদর্শক মোয়াজ্জেমের সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড হতে পারে।

ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত গত মার্চ মাসে তার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ করলে ওসি মোয়াজ্জেম তাকে থানায় ডেকে জবানবন্দি নিয়েছিলেন।

তার কয়েক দিনের মাথায় নুসরাতের গায়ে অগ্নিসংযোগ করা হলে সারাদেশে আলোচনা শুরুর হয়। তখন ওই জবানবন্দির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নুসরাতের মৃত্যু হলে গত ১৫ এপ্রিল ওসি মোয়াজ্জেমকে আসামি করে ঢাকায় বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন আইনজীবী সুমন।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা ওই মামলায় অভিযোগ করা হয়, মোয়াজ্জেম বেআইনিভাবে মোবাইল ফোনে নুসরাতের জবানবন্দির ভিডিও করেছেন এবং তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়েছেন। 

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ওই অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার কথা জানালে বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মাদ আস সামছ জগলুল হোসেন গত ২৭ মে মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন।

পিবিআইয়ের প্রতিবেদনে যা ছিল

আদালতে দাখিল করা পিবিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, ওসি মোয়াজ্জেম একজন সুশৃঙ্খল পুলিশ বাহিনীর সদস্য হয়েও নিয়ম বহির্ভূতভাবে ভিকটিমের শ্লীলতাহানির ঘটনার বক্তব্যের ভিডিও ধারণ ও প্রচার করে অপেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। এর ফলে পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে।

প্রতিবেদনের মতামতে অংশে বলা হয়, মামলার ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া সংক্রান্তে বিশেষজ্ঞ মতামত এবং দালিলিক সাক্ষ্যের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়েছে যে, ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন গত ২৭ মার্চ থানায় তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন দ্বারা ভিকটিম নুসরাতের বক্তব্যের ভিডিও ধারণ করেন, যাতে ভিকটিমের ব্যক্তিগত তথ্যপরিচিতি প্রকাশ পায়। এ অপরাধে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৬ ধারার অপরাধ প্রমাণিত হয়।

এছাড়া, ধারণকৃত ভিডিও গত ৮ এপ্রিল শেয়ারইট অ্যাপের মাধ্যমে সজল নামের ডিভাইসে পাঠিয়ে প্রচার করায় একই আইনের ২৯ ধারায় তার অপরাধ প্রমাণিত হয়।

অন্যদিকে, ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করে তা ডিজিটাল বিন্যাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ায় সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়ায় ও আইন-শৃঙ্খলার অবনতির উপক্রম করায় একই আইনের ৩১ ধারায়ও ওসি মোয়াজ্জেম অপরাধ করেছেন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

এদিকে নুসরাতের মৃত্যুর পর ওসি মোয়াজ্জেমকে প্রথমে সোনাগাজী থানা থেকে প্রত্যাহার করে রংপুর রেঞ্জে পাঠান হয়। পরে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় পুলিশ বাহিনী থেকে।

কিন্তু আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দিলে তা তামিল করা নিয়ে ফেনী ও রংপুর পুলিশের মধ্যে বেশ কয়েক দিন ঠেলাঠেলি চলে। এই পরিস্থিতিতে সংবাদমাধ্যমে পরিদর্শক মোয়াজ্জেমের লাপাত্তা হয়ে যাওয়ার খবর আসে।

ফলে পুলিশ বাহিনী তাদের কর্মকর্তা মোয়াজ্জেমকে গ্রেপ্তারে আদৌ আন্তরিক কি না- সেই প্রশ্ন তোলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।

ঈদের আগে মোয়াজ্জেম হোসেনের একটি আগাম জামিনের আবেদন হাই কোর্টে জমা পড়লেও সেই শুনানি তখন হয়নি। ফলে আদালতেও তাকে দেখা যায়নি।

সুপ্রিম কোর্টের অবকাশ শেষে রোববার আদালত খুললে হাই কোর্টের নিয়মিত বেঞ্চে নতুন করে আবেদন করেন এই পুলিশ পরিদর্শক। সেখান থেকে ফেরার সময়ই পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।