দিনে ঢাকার ‘সাড়ে ১১ লাখ ঘনমিটার’ পয়ঃবর্জ্য যাচ্ছে নদীতে

ঢাকাবাসীর মলমূত্র ত্যাগে প্রতিদিন যে পয়ঃবর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে তার বেশিরভাগই যাচ্ছে আশপাশের নদীতে, যার প্রভাব পড়ছে ঢাকায় পানি সরবরাহে।

জয়ন্ত সাহাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 May 2019, 02:46 PM
Updated : 25 May 2019, 03:02 PM

এভাবে নদী দূষণ বন্ধ না হলে কোটি কোটি টাকা খরচ করেও ওয়াসার পক্ষে ঢাকায় বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানি সরবরাহ সম্ভব হবে না বলে বাংলাদেশ ইনস্টিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

নগর উন্নয়নবিদদের এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘কতটা বাসযোগ্য ঢাকা মহানগরী’ শিরোনামে এক সংলাপে ওই গবেষণা প্রতিবেদনের নানা তথ্য তুলে ধরেন।

বিআইপির তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন ঢাকায় ১৫ লাখ ঘনমিটার পযঃবর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার ২০ শতাংশ রয়ে যায় উৎসে। আর মাত্র সাড়ে ৪০ হাজার ঘনমিটার যায় পাগলা পয়ঃশোধনাগারে। বাকি ১১ লাখ ৬০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য অপরিশোধিত অবস্থায় নিঃসরিত হয়ে নদীতে যাচ্ছে।

ঢাকার চারপাশের বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা নদীতে এই সব বর্জ্য গিয়ে পানি দূষিত করছে বলে জানান আদিল মুহাম্মদ।  

“নদীর পানি দূষণের ফলে ওয়াসা বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে পারছে না। আমরা ওয়াসাকে দোষারোপ করছি। কিন্তু এই অবস্থায় ওয়াসা কোটি কোটি টাকা খরচ করেও নানা প্রকল্প শুরু করেও নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানি দিতে পারবে না,” বলেন এই নগর উন্নয়নবিদ।

এই সমস্যা সমাধানে প্রতিটি কল-কারখানায় বর্জ্য শোধনাগার স্থাপন, বৃষ্টির পানি প্রবাহ ও বর্জ্য প্রবাহের জন্য আলাদা লাইন, বৃষ্টির পানি ধরে ভূর্গভস্থ পানির স্তর বাড়ানো, নগরীর জন্য আরও বেশ কয়েকটি পয়ঃশোধনাগার স্থাপন এবং নিয়মিত ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে ঢাকার প্রধান চার নদীর তলদেশ থেকে বর্জ্য অপসারণের পরামর্শ দেন তিনি।

বিআইপির তথ্য মতে, ঢাকা মহানগরীতে প্রতিদিন ৭ থেকে ৮ হাজার টন বর্জ্য উৎপাদন হয়, ৭৬ শতাংশই কঠিন বর্জ্য।

এই বিপুল পরিমাণ বর্জ্যের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ সংগ্রহ করে দুই সিটি করপোরেশন। তার মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য। নগরীর ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ এই বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যুক্ত।

এই বর্জ্যকে ‍পুনর্ব্যবহারে করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল্যবান কাঁচামাল তৈরি, রি অ্যাডজাস্টমেন্ট বা রি-ডিস্ট্রিবিউশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কমিউনিটিতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চালু এবং মেডিকেল ও ই-বর্জ্য উৎসেই আলাদা করার ব্যবস্থা রাখার সুপারিশ করেছে বিআইপি।

এই অনুষ্ঠানে ঢাকার আবাসন, পরিবহন, জলাবদ্ধতাসহ নানা সংকটের চিত্র তুলে ধরা হয়

সংলাপে ঢাকার ঘনবসতি, যানবাহন সংকট, জলাবদ্ধতা ও শব্দ দূষণসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন বিআইপির সাধারণ সম্পাদক।

তাদের গবেষণার বরাত দিয়ে আদিল বলেন, নতুন করে যুক্ত হওয়া ৩৬টি ওয়ার্ড বাদ দিয়ে ঢাকার ৯৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৫৮টি ওয়ার্ডে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪০০ জন মানুষ বসবাস করছে। অথচ আধুনিক নগর পরিকল্পনা অনুযায়ী, নগরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে সর্বোচ্চ ১৫০ জনের বসবাসের কথা বলা আছে।

জনসংখ্যার চাপে ঢাকায় নগর উন্নয়নের সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাচ্ছে জানিয়ে আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, “কোনো একটি শহরের অবকাঠামোর বিবেচনায় বলা হয়, নগরে ৭০ লাখের বেশি লোক বাস করলে নগর তার ভারবহন ক্ষমতা হারায়। সে হিসেবে ঢাকা শহর অনেক আগেই তার ভারবহন ক্ষমতা হারিয়েছে।

“জনসংখ্যার অধিক চাপে নগর উন্নয়নের সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে যাচ্ছে। পরিসেবা খাতে সরকার যা বিনিয়োগ করছে তার রিটার্ন কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। ”

ইকোনমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)- এর বিচারে বসবাসযোগ্যতার মানদণ্ড অনুযায়ী ঢাকার অবস্থান বিশ্বের ১৪০টি শহরের মধ্যে ১৩৯তম বলে সভায় জানান আদিল।

সক্ষমতার কয়েক গুণ মানুষ এখন বসবাস করছে ঢাকায়

তিনি বলেন, “ঢাকাকে ঘিরে উন্নয়ন প্রবণতা প্রবলভাবে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় ঢাকামুখী জনসংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তারপর উন্নয়ন কার্যক্রমে দুর্বলতা ও সমন্বয়হীনতা ঢাকাকে ধ্বংসের জন্য দায়ী।”

নগরবাসীর এক তৃতীয়াংশ এখনও বস্তি এলাকায় বসবাস করে, যা অস্বাস্থ্যকর বলে বিআইপির পর্যবেক্ষণ।

এ সমস্যার সমাধানে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের জন্য সামাজিক আবাসন প্রক্রিয়া চালু করার পাশাপাশি  স্বল্প (২০১৫-২০২০) ও দীর্ঘমেয়াদি (২০৩১ -২০৩৫) পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে তারা। প্লটভিত্তিক আবাসনের পরিবর্তে ফ্ল্যাটভিত্তিক আবাসন প্রক্রিয়া চালুর কথা বলেছে তারা।

আবাসন এলাকায় অগ্নি নিরাপত্তা ও দুর্যোগ ঝুঁকি এড়াতে ইমারত নকশা কঠোরভাবে মেনে চলা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। নির্দিষ্ট দূরত্বে ফায়ার হাইড্রেন্ট রাখারও সুপারিশ করেছে তারা।

ঢাকায় যানজট সমস্যার জন্য ব্যক্তিগত গাড়ির (প্রাইভেটকার) সংখ্যা বৃদ্ধিকে দায়ী করেছে বিআইপি। ২০১১ সালের জরিপের তথ্য দিয়ে তারা বলছে, ঢাকা মহানগরীতে প্রতি এক হাজার জনে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ১২৩টি।

একটি বাসের ধারণ ক্ষমতা গড়ে ৫২, প্রাইভেটকারের ক্ষেত্রে তা মাত্র ১.৫।

ঢাকায় যানজটের এই ছবি নিত্যদিনের, বাসের তুলনায় কয়েক গুণ প্রাইভেটকার থাকে সড়কে

ঢাকায় এখন যেসব বাস চলছে, তা মোট চাহিদার মাত্র ২০ থেকে ২৫ শতাংশ পূরণে সক্ষম এবং বাস সার্ভিসগুলো মানসম্মত না হওয়ায় পরিবহন সঙ্কট ক্রমশ বাড়ছে বলে মনে করে বিআইপি।

তাদের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহরে মানুষ প্রতিদিন গড়ে ২.২ ঘণ্টা জার্নি করে, এর মধ্যে ১.১৫ ঘণ্টাই যানজটে কাটে তাদের।

ঢাকা শহরে মেট্রো রেল চালু হলেও  ৮০ ভাগ যাত্রী বাসের উপর নির্ভর করবে বলে জানান বিআইপির সাধারণ সম্পাদক আদিল।

পরিবহন সঙ্কট নিরসনে ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক বাস রুট দ্রুত বাস্তবায়ন, কমিউনিটিভিত্তিক প্যারা ট্রানজিট যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রচলন, বহু মাধ্যমভিত্তিক সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করার সুপারিশ করেছে বিআইপি। এছাড়া নারী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা বাসের ব্যবস্থা এবং রিকশা চলাচলের জন্য আলাদা লেন চালুর ওপর গুরুত্ব দিয়েছে তারা।

শব্দের সহনীয় মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল হলেও  ঢাকার সব এলাকাতেই তা ১৩ থেকে ৪০ ডেসিবেল বেশি বলে উঠে এসেছে বিআইপির গবেষণায়।

শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি শব্দ শোষণকারী উপাদান ব্যবহার শুরু করার সুপারিশ করেছে বিআইপি।

ঢাকায় জলাবদ্ধতার জন্য জলাভূমি ভরাট করার কথা উঠে এসেছে গবেষণা প্রতিবেদনে। বিআইপির তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় ৯ হাজার ৫৫৬ একর জলাভূমি থাকলেও তার ৩ হাজার ৪৮৩ একর ভরাট হয়ে গেছে। শতকরা হিসেবে যার পরিমাণ ৩৬ শতাংশ।

এই সংকট থেকে উত্তরণে শহরে নতুন করে কোনো আবাসন প্রক্রিয়াকে অনুমোদন না দেওয়া, ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা, ঢাকায় সমন্বিত ওয়াটার মডেলভিত্তিক ড্যাপে সংরক্ষিত সব জলাশয় ও জলাধার অবৈধ দখলমুক্ত করা এবং বন্যা ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছে বিআইপি।

যা বললেন মেয়র    

এই সংলাপে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম।

বিপুল জনসংখ্যার শহর ঢাকাকে বাসযোগ্য করে তুলতে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ঢাকাবাসীর সংকট নিরসনে মেয়র আতিকুল ইসলাম শোনালেন নানা পরিকল্পনার কথা

কাজের ক্ষেত্রে সমস্যার উদাহরণ দিয়ে মেয়র বলেন, “নগরে খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করতে গেলে রাজউক, ডিপিডিসি, ওয়াসার পক্ষ থেকে ফোন আসে ৷ তারা বলেন, খোঁড়া বন্ধ হলে তাদের বাজেটের টাকা ফিরে যাবে।” 

কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরে আতিকুল ইসলাম বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য এসটিএস নির্মাণ করা হবে৷ ডাম্পিংয়ের জন্য কালেকটিভ ওয়ে ফলো করা হবে৷ 

অগ্নিকাণ্ড প্রতিহত করার জন্য প্রতিটি ওয়ার্ডে প্যারা মেডিকেল টিম ও ফায়ার ফাইটিং টিম গঠন করা হবে, যেন অন্তত ১০ মিনিট তারা লড়াই করতে পারে। 

জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণের জন্য নগরে খাল উদ্ধার কার্যক্রম জোরদার করা হবে৷ খালে যেন ময়লা ফেলা না হয় তার জন্য সামাজিক সচেতনতা কার্যক্রম চলবে। মশা নিধনের ওষুধ কাজ করছে কি না, তা পরীক্ষা করা হবে।