ভদ্রতার সীমা আছে: নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে হাই কোর্ট

বিএসটিআইয়ের মান পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ ৫২টি ভোগ্যপণ্যের বিক্রি বন্ধ, জব্দ, ধ্বংস করাসহ এসব পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ বন্ধের নির্দেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন না করায় উষ্মা প্রকাশ করেছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 May 2019, 07:11 PM
Updated : 23 May 2019, 07:27 PM

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে উদ্দেশ্য করে আদালত বলেছে, “আমাদের ভদ্রতার একটা লিমিট আছে। বেশি দিন লাগবে না এখানে (আদালতে) ডক বসিয়ে একজনকে দাঁড় করিয়ে দিতে। ভদ্রতাকে মনে করেন যে দুর্বলতা। দুর্বলতা মনে করবেন না।”

এমন উষ্মা প্রকাশের পর আদেশ বাস্তবায়ন না করার বিষয়ে ব্যাখ্যা জানতে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে তলব করা হয়েছে।

সেই সঙ্গে আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন না করায় কেন তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়েছে। দুই সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। 

বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাই কোর্ট বেঞ্চ বৃহস্পতিবার রুলসহ এই তলবের আদেশ দেয়। 

আদালতে রিটকারী পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী শিহাব উদ্দিন খান, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের পক্ষে আদালতে প্রতিবেদন তুলে ধরেন আইনজীবী মোহাম্মদ ফরিদুল ইসলাম ফরিদ, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী কামরুজ্জামান কচি। বিএসটিআইয়ের পক্ষে শুনানি করেন সরকার এম আর হাসান মামুন।

রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোখলেছুর রহমান।

এছাড়াও এসিআই লিমিটেডের পক্ষে আইনজীবী রোকন উদ্দিন মাহমুদ, প্রাণের পক্ষে এম কে রহমান, বাঘাবাড়ি ঘি-এর পক্ষে মোমতাজ উদ্দিন আহমেদ মেহেদী, সান চিপস-এর পক্ষে তানজীব উল আলম শুনানি করেন।

শুনানির শরুতেই আদালত রিটকারীর আইনজীবী শিহাব উদ্দিন খানকে গত ১২ মের অদেশটি পড়ে শোনান।

এরপর নিরাপদ খাদ্য কর্তুপক্ষের আইনজীবী মেহাম্মদ ফরিদুল ইসলাম বলেন, বিএসটিআইয়ের পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ ৫২টি পণ্য বাজার থেকে প্রত্যাহারের জন্য ইতোমধ্যে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ১৩টি পত্রিকায় সচেতনতার জন্য ১৩টি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে।

এর বইরেও জেলা-উপজেলায় আদালতের আদেশ বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসক, সিভিল সার্জন ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ বলেন, “আমরা আপনাকে ৫২টি পণ্য রিম্যুভ করতে নির্দেশ দিয়েছি। আর আপনি আরেকজনকে নির্দেশ দিয়ে দিলেন?”

আইনজীবী তখন বলেন, “আমরা রিম্যুভ করার জন্য ১৭টা পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছি।”

তখন বিচারক জানতে চান, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কতগুলো পণ্য বাজার থেকে রিম্যুভ করেছে। জবাবে আইনজীবী বলেন, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের ‘লোকবল কম’।

বিচারক নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের লোকবল সম্পর্কে জানতে চাইলে আইনজীবী বলেন, চেয়ারম্যানসহ ১৭ জন।

বিচারপতি হাসান আরিফ তখন বলেন, “এই ১৭ জন একটা স্টোরে গিয়ে একটা পণ্য রিম্যুভ করেছেন, উদাহরণ দেন।”

আইনজীবী বলেন, “আমরা তো মোবাইল কোর্ট দিয়ে এসব পণ্য বাজেয়াপ্ত করতে উপজেলায় নির্বাহী কর্মকর্তাদের চিঠি দিয়েছি।”

বিচারপতি বলন, “আমরা উপজেলা টু উপজেলা অ্যাকশন নেওয়ার আদেশ দেইনি। আমরা অ্যাকশন নিতে বলেছি সেটা মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে নিবেন, নেন। আমরা এটা নির্দেশনা দিয়েছিলাম ৫২টি প্রোডাক্ট রিম্যুভ করার জন্য। একটা উদাহরণ দেখান।

“আপনাদের ১৭ জনের মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেট কতজন?”

আইনজীবী বলেন, একজন।

তখন বিচারক বলেন, “আপনারা চাইলে পুলিশের সহযোগিতা নিতে পারেন, আইনে আছে সেটা। অথচ একটা মসলার প্যাকেট রিম্যুভ করেননি আপনারা। এই রিপোর্টের (নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের আদেশ বাস্তবায়ন প্রতিবেদনে) আছে কোথাও?”

আইনজীবী বলেন, “আমরা ১৩টা পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছি যে, স্ব প্রোডাক্টগুলো তুলে নিতে “

বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ প্রশ্ন করেন, “সবাই তুলে নিয়েছে?”

আইনজীবী বলেন, “অনেকেই করেছেন।”

বিচারক তখন জানতে চান, যারা তুলে নেয়নি তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

আইনজীবী বলেন, “তাদের বিরুদ্ধে ৫২টা মামলা করেছি।”

বিচারক বলেন, “আমরা যে রিম্যুভ করতে বললাম এবং জব্দ করতে বললাম, কী করেছেন? আপনার প্রতিবেদনের কোথায় আছে যে, এত তারিখে ওই দোকানে গিয়ে ৫২টা আইটেমের মধ্যে একটা আইটেম পেয়েছি। আর এইটা আমি জব্দ করলাম। কোথায় আছে এটা?”

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের আইনজীবী এ পর্যায়ে বিএসটিআই কী কী করেছে, তা তাদের প্রতিবেদন থেকে তুলে ধরতে থাকলে জ্যেষ্ঠ বিচারক বলেন, “বিএসটিআই কী নোটিশ দিয়েছে, না দিয়েছে তা দেখার বিষয় না। আমরা আপনাকে বলেছি দোকানে মাল রিম্যুভ করতে, আপনারা কী করেছেন সেটা দেখান। বিএসটিআই লাইসেন্স বাতিল করল কি না করল সেটা বিএসটিআইয়ের ব্যাপার।

“বিএসটিআইয়ের জন্য পারলেন না, বলছেন? শোনেন, আমাদের ভদ্রতার একটা লিমিট আছে। বেশি দিন লাগবে না এখানে ডক বসিয়ে একজনকে দাঁড় করিয়ে দিতে।

“ভদ্রতাকে মনে করেন যে দুর্বলতা। আমাদের কি অন্যভাবে শুরু করতে হবে? একটি পণ্য বাজার থেকে জব্দ করেছেন? দেখান, তা তো করেননি। আবার বলছেন, অনেক কাজ করেছেন।”

এ সময় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের আইনজীবী কিছু বলতে চাইলে জ্যেষ্ঠ বিচারক তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, “উল্টাপাল্টা বলবেন না। আদালতের টেম্পার চেঞ্জ করবেন না। আমাকে রিপোর্ট দিয়ে দেখান কোন কোন জায়গায় লিখেছেন যে, এই প্রোডাক্টটা বাজার থেকে সরিয়েছেন।

“আসলে বলতে পারছেন না যে, এটা আপনার রিপোর্টে নেই। আলতু-ফালতু কথা বলতে কোর্টে আসবেন না। প্লিজ বসেন আপনি।”

এ সময় আইনজীবী আবার কিছু বলতে গেলে বিচারক উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, “কী শুনব? আপনি আমার আদেশ বাস্তবায়ন করেননি। মোবাইল কোর্ট দিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ড্রাইভ দিতে পারতেন। কিন্তু আতঙ্ক সৃষ্টি করে টেলিভিশনের ক্যামেরা-ট্যামেরা নিয়ে মাইর খায়া গেলেন। সেটাতে জনগণের কোনো সমস্যা হচ্ছে না, বিএসটিআইয়ের কারণে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না, আর একটা প্রোডাক্ট সেখান থেকে সরাতে আনতে মহা অসুবিধা হয়ে গেল?”

আইনজীবী বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের কাছ থেকে প্রত্যাহারের বিস্তারিত প্রতিবেদন এখনও পাওয়া যায়নি।

“সে কারেণ আমরা এটা লিখতে পারিনি।”

বিচারক শেখ হাসান আরিফ তখন বলেন, “আপনার একজন ম্যাজিস্ট্রেট তো আছে এটলিস্ট। সে কী করেছে? সে একটা দোকানে গিয়ে একটা প্যাকেটও নিতে পারে নাই? এই সাহস তার নাই? এমনে এক লাখ-দুই লাখ টাকা জরিমানা করতে পারে, টেলিভিশন ক্যামেরা নিয়ে গিয়ে শোডাউন করতে পারে, লম্বা লম্বা কথা বলতে পারে। কোর্ট একটা আদেশ দিয়েছে, ওই কাজটা করতে পারে না? ঠিক আছে মিনিমাম রেসপেক্টটা করে তো দেখাতে পারে।”

আইনজীবী বলেন, “আমরা প্রোডাক্ট কস্ট নিয়ে মামলা করেছি।”

বিচারক তখন বলেন, “এসব মামলা আপনি শেখাবেন? কেন হাই কোর্টকে হাই কোর্ট দেখাচ্ছেন? এগুলো আমরা বুঝি না? বিভিন্ন এক্সকিউজ দিয়ে সরে সরে যাওয়া- সরে সরে যাওয়া, জায়গা মতো না আসা। বসে বসে সারা দিন তো এগুলোই দেখছি। খালি চালাকি। সোজা কথা না বলে, বাঁকা কথা বলা, ঘুরিয়ে বলা। আপনার মক্কেলকে কি এসব অ্যাডভাইস দিয়েছেন? এ রকম রিপোর্ট দেখার জন্য?”

আইনজীবী বলেন, “এই রিপোর্টটার ব্যাপারে আমি জানতামই না। কাল রাতে পেয়েছি। আমি হয়ত সহযোগিতা করতে পারতাম রিপোর্ট রেডি করার সময়।”

বিচারক বলেন, “আপনি পেয়েছেন, সকাল থেকে রেডি করেন না কেন? না পড়েই কোর্টে দাঁড়িয়ে গেছেন? বসেন আপনি, জায়গায় যান। আমরা ডক রেডি করব।”

এরপর ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পক্ষে আইনজীবী কামরুজ্জামান কচিকে তাদের বাস্তবায়ন প্রতিবেদন উপস্থাপন করতে বললে তিনি তা উপস্থাপন করেন।

দেশের প্রতিটি জেলায় অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে জানিয়ে প্রতিবেদন থেকে তিনি নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মানিকঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় নিম্নমানের এসব পণ্য জব্দ, ধ্বংস করার পরিসংখ্যান তুলে ধরেন।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন তুলে ধরার পর রিটকারী আইনজীবী শিহাব উদ্দিন খান বলেন, “নিম্নমানের এসব পণ্য এখনও বাজারে আছে। গতকালও আমরা কিছু পণ্য বাজার থেকে সংগ্রহ করেছি। এখনও বাজারে আছে।”

বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ বলেন, “কিছু কার্যক্রম যে হয়নি তা না, কিছু হয়েছে। কিন্তু নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ আমাদের আদেশটা মানে নাই। আমরা বলেছিলাম প্রোডাকশন বন্ধ করতে, তাদের চিঠি দিতে বলি নাই তো। তদের রিকোয়েস্ট করতে বলি নাই। এখানে রিকোয়েস্ট করার কিছু নাই।”

এ সময় বিচারক নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের অফিসের ঠিকানা জানতে চায় আইনজীবীর কাছে।

জবাবে আইনজীবী বলেন, ইস্কাটনে।

বিচারক বলেন, “সকলে মিলে ইস্কাটনের একটি স্টোরে গিয়েও যদি একটা মাল নিতে পারতেন, সেটাও পরেননি। পাশের একটি বাজারে গিয়ে একটা মসলার প্যাকেটও নিয়ে আসতে পারেন নাই। আইওয়াশ করেছেন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে, নির্দেশনা পাঠিয়ে।

“আপনাদের চেয়ারম্যানের উদ্দেশ্য কী, আমাকে বলেন। একটা দোকানে গিয়ে একটা মসলার প্যাকেট নেওয়ার মতো সাহস নাই। ভয় পাচ্ছেন বড়লোকরা, বড় বড় ব্যবসায়ীরা আপনাদের কী না কি করে। এসিআইয়ের মালিক, বড় বড় ব্র্যান্ডের মালিক, বিরাট বিরাট ব্যবসায়ীদের ভয় পাচ্ছেন আপনারা।

“এত ভয় যদি থাকে উনারা (নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানসহ কর্মকর্তারা) গিয়ে রান্নাবান্না শুরু করে দিক। চাকরি করার দরকার কী? এসব সেনসেটিভ জায়গায় চাকরি করার দরকার নাই। কোনো একটা অফিসে, ব্যাংকে-ট্যাংকে গিয়ে চাকরি করতে বলেন। বসে বসে টাকা গুনবেন আর হিসাব রাখবেন, ব্যস।”

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ ফরিদুল ইসলাম তখন বলেন, “আমি আমার মক্কেলকে জানাব।”

বিচারক হাসান আরিফ তখন বলেন, “আপনার কনভে করতে হবে না। কনভে করার বহু মানুষ আশেপাশে আছে। আপনার কনভে করে লাভ নাই। আমাদের আদেশ কনভে করেছে সাংবাদিকরা। কী হয়েছে, হচ্ছে দেখিয়েছে। কী আদেশ দিয়ছি অক্ষরে অক্ষরে লিখেছে। কিন্তু আপনারা তা করেননি। কোনো মামলাও করতে পারেননি, কোনো কিছুই না।”