সেই ৫২ পণ্য না সরায় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে তলব

বাজারে থাকা বিএসটিআইর মানের পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ বিভিন্ন কোম্পানির ৫২টি খাদ্যপণ্য বাজেয়াপ্ত বা তুলে নিয়ে ধ্বংস করার নির্দেশনা বাস্তবায়ন না করায় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে তলব করেছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 May 2019, 06:57 AM
Updated : 23 May 2019, 07:27 PM

সেই সঙ্গে আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন না করায় কেন তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল জারি হয়েছে।

দুই সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। 

বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাই কোর্ট বেঞ্চ বৃহস্পতিবার রুলসহ এই তলবের আদেশ দেয়।

আদালত আদেশে বলে, বিএসটিআইর পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ ৫২টি পণ্য বাজার থেকে তুলে নিতে, জব্দ করে ধ্বংস করতে এবং এসব পণ্যের উৎপাদন ও বাজারে সরবরাহ বন্ধ করে উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে গত ১২ মে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, সে বিষয়ে তাদের দেওয়া আদেশ বাস্তবায়ন প্রতিবেদনে একটি শব্দও নেই। এমনকি দেশের কোনো এলাকার কোনো একটি দোকান থেকে তারা একটি নিম্নমানের পণ্যও তুলে নিতে পারেনি।

“ফলে হাই কোর্টের আদেশ অনুযায়ী নির্দেশনাগুলো প্রতিপালন না করায় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারমানের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ কেন আনা হবে না, মর্মে রুল জারি করা হল।

আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হচ্ছে। এছাড়া আগামী ১৬ জুন আদালতে স্বশরীরে হাজির হতে বলা হচ্ছে।”

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের আদেশ বাস্তবায়ন প্রতিবেদনের বিষয়ে আদালত আদেশে বলে, “আদলতের আদেশ অনুযায়ী তারা যে নির্দেশনাগুলো প্রতিপালন প্রশংসাযোগ্য। আদালতের আদেশ প্রতিপালনে তাদের ভূমিকার প্রশংসনীয়। আমরা আশা করি কেবল এই রমজান মাস উপলক্ষ্যেই না, সারা বছর তারা তাদের এই অভিযান অব্যাহত রাখবে।”

সম্প্রতি বিএসটিআই ৪০৬টি খাদ্য পণ্যের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেছে। এর মধ্যে ৩১৩টি পণ্যের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। ৩১৩টি পণ্যের মধ্যে ৫২ পণ্য মানহীন বলে প্রতিবেদন দেয়।

রিটকারী আইনজীবীর সম্পূরক আবেদনের প্রেক্ষিতে বাকি ৯৩টি পণ্যের পরীক্ষার ফলাফল প্রতিবেদনও আগামী ১৬ জুনের মধ্যে দিতে বিএসটিআইকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এদিকে ৫২টি নিম্নমানের পণ্যের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আদালতের আদেশ সংশোধন চেয়ে আবেদন করলে আদালত তা আমলে নেয়নি।

তবে ৫২টি নিম্নমানের পণ্যে প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোনো প্রতিষ্ঠান যদি তাদের পণ্য বাজারজাত করতে চায় সেক্ষেত্রে বিএসটিআই থেকে পুনঃপরীক্ষা করাতে বলা হয়েছে। বিএসটিআইকে সে পুনঃপরীক্ষার প্রতিবেদন ১৩ জুনের মধ্যে প্রকাশ করতে বলা হয়েছে।

আদালতে রিটকারী পক্ষে শুনানি করেন, আইনজীবী শিহাব উদ্দিন খান, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের পক্ষে আদালতে প্রতিবেদন তুলে ধরেন আইনজীবী মোহাম্মদ ফরিদুল ইসলাম ফরিদ, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী কামরুজ্জামান কচি। বিএসটিআইর পক্ষে শুনানি করেন সরকার এম আর হাসান মামুন।

রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোখলেছুর রহমান।

এছাড়াও এসিআইর পক্ষে আইনজীবী রোকন উদ্দিন মাহমুদ, প্রাণের পক্ষে এম কে রহমান, বাঘাবাড়ি ঘির পক্ষে মোমতাজ উদ্দিন আহমেদ মেহেদী, সান চিপস’র পক্ষে তানজীব উল আলম শুনানি করেন।

বৃহস্পতিবার এ আদেশের পর শিহাব উদ্দিন খান সাংবাদিকদের বলেন, “আজকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের আদেশ বাস্তবায়ন প্রতিবেদন দেওয়ার কথা ছিল। তারা তা দিয়েছে। কিন্তু নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদন দেখে আদালত উষ্মা প্রকাশ করেছেন।

“কারণ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদনে ৫২টি নিম্নমানের পণ্য বাজার থেকে জব্দ, সরিয়ে ফেলা বা পণ্য ধ্বংস করে ফেলার বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই। এতে আদালত নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কঠোর সমালোচনা করেছেন এবং তাদের দায়িত্ব অবহেলার বিষয়েও সতর্ক করেছেন। এবং আদালত নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করে দুই সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলেছেন। এমনকি আগামী ১৬ জুন চেয়ারম্যানকে তলব করেছেন।”

তিনি আরও বলেন, “আজ আমরা আরেকটি আবেদন নিয়ে গিয়েছিলাম, বিএসটিআইর যে সার্কুলারের ভিত্তিতে আমরা রিটটা দায়ের করেছিলাম, সেখানে বিএসটিআই ক্লেইম করেছিল যে, তারা বাজার থেকে ৪০৬টি পণ্য সংগ্রহ করে টেস্ট করেছেন। পরবর্তীতে তারা ক্লেইম করলেন যে, ৩১৩টি পণ্যের ল্যাব টেস্টের ফলাফল পাওয়ার পর ৫২টি পণ্য নিম্নমানের পেয়েছে। এই যে ৩১৩টির বাইরে ৯৩টি পণ্যের ফলাফল যেহেতু জনগণ জানেন না, ভোক্তারা যেহেতু এই পণ্যগুলো নিয়ে উদ্বিগ্ন, এইগুলো কাদের পণ্য, কী পণ্য, এগুলো নিয়মিত ভোগ্যপণ্য কিনা আবেদনের মাধ্যমে তা আদালতের নজরে এনেছি।”

“এই ৯৩টি পণের ল্যাবটেস্ট রেজাল্ট আগামী ১৬ জুন পরবর্তী তারিখে আদালতে দাখিল করতে বলেছেন। এছাড়া বিভিন্ন পণ্য প্রতিষ্ঠানের আবেদনের প্রেক্ষিতে আগামী ১৩ জুনের মধ্যে বিভিন্ন পণ্য বিএসটিআইকে পুনঃপরীক্ষা করে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে বলেছে,” বলেন আইনজীবী  শিহাব।

শিল্প মন্ত্রণালয় বিএসটিআইর মান পরীক্ষার প্রতিবেদন প্রকাশের পর একটি রিট আবেদনে গত ১২ মে হাই কোর্টের এই বেঞ্চ বিএসটিআইর মানের পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ ১৮টি কোম্পানির ৫২টি পণ্য বিক্রি বন্ধ রাখতে নির্দেশ দেয়। একই সঙ্গে উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। 

এছাড়াও বাজারে থাকা এসব নিম্নমানের পণ্য বাজার থেকে দ্রুত বাজেয়াপ্ত, অপসারণ করে ধ্বংস এবং মানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তার উৎপাদন ও বাজারে সরবরাহ বন্ধ রাখতেও নির্দেশ দেওয়া হয়।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে এসব নির্দেশ দ্রুত বাস্তবায়ন করে আগামী ১০ দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল।

পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে

সরিষার তেল- সিটি অয়েল মিলের তীর, গ্রিন ব্লিসিং ভেজিটেবল অয়েল কোম্পানির জিবি, বাংলাদেশ এডিবল অয়েলের রূপচাঁদা, শবনম ভেজিটেবল অয়েলের পুষ্টি ব্র্যান্ডগুলো।

লবণের মধ্যে রয়েছে- এসিআই, মোল্লবো সল্ট, মধুমতি, দাদা সুপার, তিন তীর, মদিনা, স্টারশিপ, তাজ ও নূর স্পেশাল ব্র্যান্ডগুলো।

মসলার মধ্যে রয়েছে- ড্যানিশ, ফ্রেশ, বাঘাবাড়ি স্পেশাল, প্রাণ ও সান এর গুঁড়া হলুদ; এসিআই ফুডের পিওর ব্র্যান্ডের গুঁড়া ধনিয়া।

লাচ্ছা সেমাইয়ের মধ্যে রয়েছে- মিষ্টিমেলা, মধুবন, মিঠাই, ওয়েলফুড, বাঘাবাড়ি স্পেশাল, প্রাণ, জেদ্দা, কিরণ ও অমৃত ব্র্যান্ডগুলো।

নুডলসের মধ্যে রয়েছে- নিউজিল্যান্ড ডেইরির ডুডলি নুডলস। কাশেম ফুড প্রোডাক্টের ‘সান’ ব্র্যান্ডের চিপসও এই তালিকায় রয়েছে।

আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের আইনজীবী বৃহস্পতিবার হাই কোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করেন।

কিন্তু সেখানে আদালতের আদেশ বাস্তবায়নের অগ্রগতির তথ্য না থাকায় উষ্মা প্রকাশ করে হাই কোর্ট। 

আদেশ বাস্তবায়ন না করায় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহফুজুল হককে আগামী ১৬ জুন আদালতে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়। পাশাপাশি জারি করা হয় আদালত অবমাননার রুল।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদন নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বিচারক বলেন, “নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ আদালতের আদেশ অনুযায়ী দেশের কোথাও কোনো দোকান থেকে একটি প্যাকেটও সরায়নি। এ সংক্রান্ত একটি শব্দও তাদের প্রতিবেদনে নেই।”

গত ২ মে শিল্প মন্ত্রণালয় এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, বিএসটিআই রোজার আগে বাজার থেকে নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ৫২টি নিম্নমানের পণ্য চিহ্নিত করেছে।

এসব প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠানো হয়েছে এবং অচিরেই তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানিয়েছিলেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন।

এরপর এসব খাদ্যপণ্য বাজার থেকে প্রত্যাহার, জব্দ ও মান উন্নীত না হওয়া পর্যন্ত উৎপাদন বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে গত ৮ মে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনশাস কনজ্যুমার সোসাইটি (সিসিএস)’র পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিহাব উদ্দিন খান এই রিট আবেদন করেন।

আদালত ওই ৫২ পণ্য বাজার থেকে সরানোর নির্দেশ দেওয়ার নয় দিনের মাথায় ঢাকার বড় বাজারগুলো ঘুরে দেখা যায়, বেশিরভাগ পণ্য দোকান থেকে প্রায় উঠে গেছে।

দোকানিরা বলেছেন, আদালতের নির্দেশনার বাইরে গিয়ে তারা পণ্যগুলো বিক্রি করছেন না, আবার কোম্পানিগুলোও সেগুলো ‍তুলে নিয়ে যাচ্ছে।