বিএসটিআইয়ের ভূমিকা নিয়েই হাই কোর্টের প্রশ্ন

দুধ, দই, গো-খাদ্য নিয়ে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের জাতীয় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগারের (এনএফএসএল) পরীক্ষার প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তোলায় উল্টো বিএসটিআইয়ের ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 May 2019, 02:01 PM
Updated : 23 June 2019, 08:59 AM

বিএসটিআইয়ের আইনজীবী সরকার এম আর হাসানকে আদালত বলেছে, “অন্যের পরীক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন আপনারা। নিজেরা কেন পরীক্ষা করেন না? আপনারা কেন এত দিনেও পরীক্ষা করে রিপোর্ট দিতে পারলেন না!”

নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগারের (এনএফএসএল) প্রধান শাহনীলা ফেরদৌসীর বক্তব্য শোনার পর মঙ্গলবার বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের হাই কোর্ট বেঞ্চ থেকে বিএসটিআইয়ের কাজ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করা হয়।

বিএসটিআইয়ের আইনজীবীকে বিচারক বলেন, “আপনারা কাজ করার দায়িত্ব নিয়েছেন কিন্তু দায়িত্ব পালন করছেন না। আপনাদের পরীক্ষায় সত্য উদঘাটন হচ্ছে না কেন? শুধু এসি রুমে বসে থাকবেন, তা হবে না। আন্তর্জাতিক পরীক্ষায় পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু আপনারা পারছেন না কেন?”

বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পক্ষে এদিন আদালতে ছিলেন আইনজীবী মোহাম্মদ ফরিদুল ইসলাম। আর বিএসটিআইয়ের পক্ষে ছিলেন সরকার এম আর হাসান (মামুন)।

রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল হেলেনা বেগম চায়না। দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী সৈয়দ মামুন মাহবুব।

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন মানিক পরে সাংবাদিকদের বলেন, জাতীয় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগারের প্রধান অধ্যাপক শাহনীলা ফেরদৌসী এদিনে আদালতের তলবে হাজির হয়েছিলেন। তিনি তদের পরীক্ষার প্রতিবেদন হলফনামা আকারে আদালতে দাখিল করেছেন এবং নিজের বক্তব্য তুলে ধরেছেন।

“তাদের জরিপ ও পরীক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় বিএসটিআইয়ের ভূমিকা নিয়েই আদালত অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি আদালত বিএসটিআই ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে আগামী ২৩ জুনের মধ্যে সারাদেশ থেকে দুধ, দুগ্ধজাত খাদ্যপণ্য ও পশুখাদ্যের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছে।”

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) আর্থিক সহায়তায় গো খাদ্য, দুধ, দই ও বাজারে থাকা প্যাকেটের পাস্তুরিত দুধ নিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগার (এনএফএসএল) একটি জরিপ চালায়।

ওই জরিপের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গরুর দুধের ৯৬টি নমুনা সংগ্রহ করে এনএফএসএল। ঢাকাসহ তিন জেলার ছয়টি উপজেলাসহ ১৮টি স্থান থেকে দুধের পাশাপাশি অন্যান্য নমুনাও সংগ্রহ করা হয়। গরুর দুধ ও গোখাদ্য সরাসরি খামার থেকে সংগ্রহ করা হয়।

এনএফএসএল ঢাকা শহরের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দোকান ও আশপাশের উপজেলার দোকান থেকে দই সংগ্রহ করে। বিভিন্ন সুপার স্টোর থেকে সংগ্রহ করা হয় বাজারে প্রচলিত প্রায় সব ব্র্যান্ডের প্যাকেটজাত তরল দুধ এবং আমদানি করা প্যাকেট দুধ।

গোখাদ্যের ৩০টি নমুনা পরীক্ষা করে কীটনাশক (দুটি নমুনায়), ক্রোমিয়াম (১৬টি নমুনায়), টেট্রাসাইক্লিন (২২টি নমুনায়), এনরোফ্লোক্সাসিন (২৬টি নমুনায়), সিপ্রোসিন (৩০টি নমুনায়) এবং আফলাটক্সিন (চারটি নমুনায়) গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে পাওয়ার কথা জানায় এনএফএসএল।

গরুর দুধের ৯৬টি নমুনার মধ্যে ৯ শতাংশ দুধে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি কীটনাশক, ১৩ শতাংশে টেট্রাসাইক্লিন, ১৫ শতাংশে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি সীসা পাওয়া যায় ওই গবেষণায়। সেই সঙ্গে ৯৬ শতাংশ দুধে পাওয়া যায় বিভিন্ন ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া।

প্যাকেটের দুধের ৩১টি নমুনা পরীক্ষা করে ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি হারে টেট্রাসাইক্লিন পাওয়ার কথা জানায় এনএফএসএল। সেই সঙ্গে ৬৬ থেকে ৮০ শতাংশ দুধের নমুনায় বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া পাওয়ার কথা বলা হয় প্রতিবেদনে।

দইয়ের ৩৩টি নমুনা পরীক্ষা করে একটিতে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি সীসা পাওয়ার কথা জানায় এনএফএসএল। ৫১ শতাংশ নমুনায় পাওয়া যায় বিভিন্ন ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া।

শাহনীলা ফেরদৌসী তাদের এই প্রতিবেদন উপস্থাপনের পর বিএসটিআইয়ের আইনজীবী বলেন, এই প্রতিবেদন যে সত্য- তা প্রমাণ করার সুযোগ কোথায়।

“তারা তো অন্য কোনো ল্যাবে যাচাই করেনি। তারা নমুনা সংগ্রহ করেছে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও সাভার থেকে। কিন্তু পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও যশোরেই সবচেয়ে বেশি দুধ উৎপাদিত হয়। সেখান থেকে তারা কোনো নমুনা সংগহ না করে ঢালাওভাবে বলে দিল দুধে এইসব রয়েছে।”

আদালত তখন বলে, অধ্যাপক শাহনীলা ফেরদৌসী অভিযুক্ত নন, তাকে আদালতে ডাকা হয়েছে সহযোগিতার জন্য।

এনএফএল এর জরিপ ও পরীক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় বিএসটিআইএয়ের ভূমিকা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক বলেন, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ল্যাব আন্তর্জাতিক চুক্তির আওতায় প্রতিষ্ঠিত। এ প্রতিষ্ঠান তার পদ্ধতিতে এবং আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য পণ্য ও পশুখাদ্য পরীক্ষা করেছে।

এরপর আদালত শাহনীলা ফেরদৌসীর বক্তব্য শুনতে চাইলে তিনি বলেন, ২০১৫ সাল থেকে তারা এই গবেষণা করে আসছেন। এসব গবেষণার ফলাফল ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার অরগানাইজেশান আন্তর্জাতিকভাবে প্রকাশ করে।

“আমাদের ল্যাবের মান অনেক দেশের চেয়েই উন্নত। আমাদের পরীক্ষার ফলাফল ঠিক আছে কি না তা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যাচাই করা হয়। পরীক্ষার প্রতিবেদন পাওয়ার পরই তা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রকাশ করা হয়। এই পরীক্ষার ক্ষেত্রেও সেটা করা হয়েছে।

“এখানে শুধুই তিনটি জেলা নয়, বড় বড় প্রতিষ্ঠানের পণ্য রয়েছে। যেমন মিল্কভিটা, প্রাণ, আড়ং, ফার্ম ফ্রেশ, স্বপ্ন অর্গানিক, আফতাব ডেইরি মিল্ক, ঈগলু ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান রয়েছে যাদের পণ্য সারাদেশেই পাওয়া যায়। সুতরাং বিএসটিআইয়ের দাবি যথাযথ নয়।”

শাহনীলা ফেরদৌসী বলেন, খাদ্যে রাসায়নিক, অ্যান্টিবায়োটিক, সীসার উপস্থিতি নিয়ে আইসিডিডিআরবি ও সায়েন্স ল্যাবরেটরির প্রতিবেদন ২০১৭ সালেও প্রকাশিত হয়েছে। তা ইন্টারনেটেই রয়েছে। তাই শুধু জাতীয় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগারের প্রতিবেদনে ওইসব ক্ষতিকর উপাদানের উপস্থিতি পাওয়া গেছে- এটা ঠিক নয়।

আদালত তখন শাহনীলা ফেরদৌসীকে নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগারের (এনএফএসএল) প্রতিবেদন ও তার বক্তব্য হলফনামা আকারে এক মাসের মধ্যে জমা দিতে বলে।

এ পর্যায়ে বিএসটিআইয়ের আইনজীবী যৌথ টিম গঠন করে বাজার থেকে নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষার নির্দেশনা চান।

আদালত তখন ঢাকাসহ সারা দেশের বাজারে কোন কোন কোম্পানির দুধ ও দুধজাত খাদ্যপণ্যে কী পরিমাণ ব্যাকটেরিয়া, কীটনাশক ও সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি সীসা পাওয়া গেছে, তা জরিপ ও নিরূপণ করে একটি তালিকা এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে কী আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সে প্রতিবেদন দাখিল করেতে নির্দেশ দেয়।

জাতীয় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগারের (এনএফএসএল)’র ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবর দেখে গত ১১ ফেব্রুয়ারি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ আদেশ দিয়েছিল হাই কোর্টের এই বেঞ্চ।

আদালত আদেশে বলেছিল, আদেশ পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে জরিপ চালিয়ে বিএসটিআই, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও কেন্দ্রীয় নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা সমন্বয় কমিটিকে হলফনামা আকারে প্রতিবেদন দিতে হবে।

এছাড়া দুধ, দই ও গোখাদ্যে ভেজাল মেশানোর সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে ব্যাকটেরিয়া, কীটনাশক, অ্যান্টিবায়োটিক, সীসা, রাসায়নিকের মাত্রা নিরূপণ ও ভেজাল মেশানোর কাজে জড়িতদের চিহ্নিত করতেও তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছিল হাই কোর্ট।

সেই কমিটিকে দুধ, দই ও গোখাদ্যে ভেজাল মেশানোর কাজে জড়িতদের চিহ্নিত করে তিন মাসের মধ্যে এবং দুধ, দই ও গোখাদ্যে ব্যাকটেরিয়া, কীটনাশক, অ্যান্টিবায়োটিক, সীসা, রাসায়নিকের উপস্থিতি আছে কিনা তা পরীক্ষা করে ছয় মাস পরপর আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল।