রাজীবের ক্ষতিপূরণ: রুলের শুনানি শেষ, রায় ২৩ মে

এক বছর আগে দুই বাসের রেষারেষিতে কলেজছাত্র রাজীব হাসানের হাত হারানো ও পরে মৃত্যুর ঘটনায় তার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ ও এ ধরনের ঘটনা পুনরাবৃত্তি রোধে সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধন প্রশ্নে জারি করা রুলের শুনানি শেষ হয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 May 2019, 07:20 PM
Updated : 19 May 2019, 07:20 PM

হাই কোর্ট আগামী ২৩ মে এ মামলার রায় দেবে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।

রুল নিয়ে উভয় পক্ষের শুনানি শেষে রোববার বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাই কোর্ট বেঞ্চ রায়ের দিন ঠিক করে।

রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন রুহুল কুদ্দুস কাজল। রষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু।

রুহুল কুদ্দুস কাজল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাজিবের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়ে এবং সাধারণের সড়ক নিরাপত্তা প্রশ্নে আদালত যে রুল জারি করেছিল, সে রুলের উপর শুনানি শেষ হয়েছে। আগামী ২৩ মে রায়ের জন্য রেখেছে আদালত।”

শুনানিতে কী চেয়েছেন- জানতে চাইলে এ আইনজীবী বলেন, “দুটো বিষয়েই আমরা চেয়েছি। প্রথমত রাজিবের পরিবারের জন্য যথাযথ ক্ষতিপূরণ এবং জন সাধারণের জন্য সড়ক নিরাপত্তা। এছাড়াও রুল শুনানিতে প্রাসঙ্গিক অন্যান্য যেসব বিষয়ে এসেছে, সেসব বিষয়ে নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।”

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু বলেন, “আদালতের নির্দেশে দুর্ঘটনার দায় নিরূপণ করতে গঠিত স্বাধীন কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন চেয়েছি। এছাড়া চালকদের নিয়মিত ডোপ টেস্ট, ভিশন টেস্ট করানো, প্রত্যেকটা ক্রসিংয়ে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা স্থাপন করাসহ বিভিন্ন নির্দেশনা চেয়িছি।”

গত বছরের ৩ এপ্রিল রাজধানীর কারওয়ান বাজার এলাকায় দুই বাসের রেষারেষিতে হাত কাটা পড়ে ছাত্র রাজীবের। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে ১৬ এপ্রিল রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।

রাজিবের হাত হারানোর ঘটনার বছর পূর্তিতে আদালতে রুল শুনানির মৌখিক আবেদন করেন রুহুল কুদ্দুস কাজল। পরে আদালত ১০ এপ্রিল শুনানির জন্য রাখে। এরপরই ১২ কার্যদিবস রুলের উপর শুনানি হয়।

রাজীব হাত হারানোর পরদিনই হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল।

প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ৮ মে হাই কোর্ট এক আদেশে রাজীবের পরিবারকে কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি রুল জারি করে।

রাজিবের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে কোটি টাকা দিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, সাধারণ যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিদ্যমান আইন কঠোরভাবে কার্যকর করতে কেন নির্দেশনা দেওয়া হবে না এবং প্রয়োজনে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে আইন সংশোধন বা নতুন করে বিধিমালা প্রণয়নের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, রুলে তা জানতে চায় হাই কোর্ট।

এক মাসের মধ্যে দুই বাসের (বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহন) কর্তৃপক্ষকে ২৫ লাখ করে ৫০ লাখ টাকা দিতে বলা হয়।

এ আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করে বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহন। পরে গত বছরের ২২ মে আপিল বিভাগ ওই আদেশ স্থগিত করে হাই কোর্টকে দুর্ঘটনার দায় নিরূপণ করতে একটি ‘স্বাধীন কমিটি’ গঠনের নির্দেশ দেয়।

পরে হাই কোর্ট বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিচার্স ইনস্টিটিউট (এআরআই) এর পরিচালক মো. মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে দেয়। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন, বুয়েটের সিভিল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক হাদিউজ্জামান ও নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)’র চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন।

সেই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনেই উঠে আসে রাজিবের মৃত্যু ও দুর্ঘটনার দায়।

কী ছিল সে প্রতিবেদনে

কলেজছাত্র রাজীব হোসেনের মৃত্যুর জন্য স্বজন পরিবহন, বিআরটিসি ও শমরিতা হাসপাতালকে দায়ী করে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে গঠিত কমিটি।

গত বছরের ১৫ অক্টোবর আদালতে উপস্থাপন করা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীবের কোনো দায় কমিটি পায়নি। আর বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনের দুই বাসের চালকদের ভারী যানবাহন চালানোর লাইসেন্স ছিল না।

৪৯ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে প্রাথমিকভাবে এ দুর্ঘটনার জন্য স্বজন পরিবহনের চালকের বেপরোয়া চালনাকে দায়ী করে বলা হয়, “হালকা বাহন চালানোর ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকার পরও স্বজন পরিবহন ওই চালককে নিয়োগ করায় রাজীবের মৃত্যু ও দুর্ঘটনার মূল দায় মূলত স্বজন পরিবহনেরই।

“এছাড়া হালকা বাহন চালানোর লাইসেন্স থাকার পরও চালককে বিআরটিসি ডাবল ডেকার বাস চালানোর অনুমোদন দেওয়ায় এই দুর্ঘটনার দায় কিছুটা বিআরটিসিরও। বিআরটিসির বিদ্যমান লিজভিত্তিক পরিবহন ব্যবস্থায় গণপরিবহনে এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে।”

দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে চালক নিয়োগ করে গণপরিবহন চালানো এ ধরনের দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে মনে করে বলে অভিমত দেয় দায় নিরূপণ কমিটি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, “আহত রাজীবের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হওয়ার পরও শমরিতা হাসপাতাল তার চিকিৎসায় সময়ক্ষেপণ করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিওএইচও) ‘গোল্ডেন আওয়ার রুলস’ অনুযায়ী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে সঙ্কটাপন্ন রোগীর অস্ত্রোপচার করার নিয়ম রয়েছে। কারণ সঙ্কটাপন্ন রোগীর জীবন-মরণ ওই এক ঘণ্টার ওপর অনেকটা নির্ভর করে।

“শমরিতা হাসপাতাল রাজীবের আত্মীয়-স্বজনদের জন্য অপেক্ষা করে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অযথা সময় নষ্ট করেছে; সে কারণে শমরিতা হাসপাতাল রাজীবের মৃত্যুর দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।”

প্রতিবেদনে রাজধানীর গণপরিবহণ ব্যবস্থার একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলা হয়েছে, ঢাকার জনসংখা প্রায় এক কোটি ৯০ লাখ। তার বিপরীতে মোট যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। এর মধ্যে ব্যক্তিগত বাহনের সংখ্যা প্রায় ৯ লাখ; যা মোট যানবাহনের ৭৪ শতাংশ।

এছাড়া ঢাকার তিনশর মতো রুটে ৩ হাজার ৮০০ মালিকের প্রায় ৫ হাজার গণপরিবহন চলে; যা মোট যানবাহনের ০.৫ শতাংশ।

বেপরোয়া গাড়ি চালনা রোধে কমিটির সুপারিশে বলা হয়, “দৈনিক বা ট্রিপ ভিত্তিতে চালক নিয়োগ দ্রুত নিষিদ্ধ করতে হবে এবং মাসিক বেতনের ভিত্তিতে কোম্পানির অধীনে চালক নিয়োগ করতে হবে।”

চলাচলকারী গণপরিবহনের রুট পারমিটের ক্ষেত্রে ‘ফ্রাঞ্চাইজি সিস্টেম’ চালুর সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে।

সেখানে বলা হয়, “অনুমোদিত চলাচলকারী গণপরিবহনগুলোকে একটি কোম্পানির অধীনে এনে ফ্রাঞ্চাইজি সিস্টেমে রুট পারমিট দিতে হবে। প্রত্যেকটি রুটের কালার কোড থাকলে বাস কোম্পানি ও পরিবহনের চালকদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযেগিতা ঠেকানো যাবে।”

রাজধানীতে গণপরিবহনের, বিশষ করে ব্যক্তি মালিকানা বা সরকারি মালিকানাধীন বিআরটিসির বাসগুলোর অবস্থা খুবই শোচনীয় উল্লেখ করে প্রতিবেদনের বলা হয়, ফিটনেস সার্টিফিকেট থাকার পরও অনেক বাসেই ইন্ডিকেটর, ওয়াইপার, হেডলাইট, টায়ার, বাসের দরজা-জানালা এবং অবস্থা ভয়াবহ।

সুপারিশে বলা হয়েছে, কোনো বোসের ফিটনেস সার্টিফিকেট থাকলেই চলবে না, সেফটি ফিচারগুলো রঙ করা থাকতে হবে। ফিটনেস সার্টিফিকেট ছাড়া কোনো যানবাহনই চলতে দেওয়া উচিৎ না।

কমিটি বলে, বাস চলার সময় দরজা অবশ্যই বন্ধ রাখতে হবে। নির্ধারিত স্টপেজে থামার পর বাসের দরজা খুলতে হবে। বাস চলার সময় কোনো যাত্রীকে দরজার সামনে দাঁড়াতে দেওয়া উচিৎ না।

প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রত্যেক রুটের বাস স্টপেজ বা ‘বাস বে’ গুলোর পরিচিতি থাকা উচিৎ। কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই যাত্রী ছাউনি স্থাপন করতে হবে। ছেড়ে যাওয়ার সময় বা চলতি অবস্থায় যাত্রী ওঠা-নামা করা বন্ধ করতে হবে। ট্রাফিক পুলিশকে কঠোরভাবে তা পালন করতে হবে।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে দুর্ঘটনার বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা, বিশ্লেষণে প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের ওপরও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

বলা হয়, “বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা হয় না বললেই চলে। সীমিত যোগান নিয়ে এআরআই বিজ্ঞানসম্মতভাবে সড়ক দুর্ঘটনার গবেষণা, বিশ্লেষণ, তদন্তের কাজগুলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে করে যাচ্ছে। এ ধরনের কাজে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বাড়াতে সরকারের গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ।”

এছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা তদন্তে পুলিশ, বিআরটিএ, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, এআরআই, নিরাপদ সড়ক চাইয়ের মত সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানগুলোতে টেকনিকেল টিম রাখার সুপারিশ করেছে কমিটি। সেই টিমের জন্য পর্যাপ্ত তহবিলের যোগান দিতে হবে। বড় দুর্ঘটনা তদন্তে এই টিম কাজ করবে। দুর্ঘটনার পরপরই দ্রুততার সঙ্গে এই টিমকে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে হবে এবং তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।

চালকদের প্রশিক্ষণ এবং লাইসেন্স ব্যবস্থাপিনা সংক্রান্ত সুপারিশে বলা হয়েছে, ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার মানদণ্ড কী হবে তা বিআরটিএ’র ড্রাইভিং স্কুলকে নির্ধারণ করতে হবে। সে মানদণ্ড পূরণ করতে না পারলে কাউকে ড্রাইভিং পারদর্শিতা পরীক্ষায় অংশ নিতে দেওয়া উচিৎ না।

ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি পথচারী, সাইকেল আরোহী, রাস্তার চিহ্ন, রাস্তায় চলাচলের নিয়ম-কানুন ও অন্যান্য রাস্তা ব্যবহারকারী প্রতি ‘দায়বদ্ধতা’র মত তাত্ত্বিক বিষয় যুক্ত করতে হবে। বিআরটিএর উদ্যোগে বুয়েট চালকদের তাত্ত্বিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে পারে।

এছাড়া সড়ক দুর্ঘটনায় পড়া মানুষের জন্য সরকারকে একটি জরুরি ‘ট্রমা ব্যবস্থাপনা নীতি’ প্রণয়ন করার এবং তাতে চিকিৎসা ও আর্থিক ব্যয়ের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রাখার সুপারিশ করেছে দায় নিরূপণ কমিটি।