মশা নিধন: দুই করপোরেশনকে সতর্ক করল আদালত

আসছে বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ায় প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কা করে মশা নিধনের বিষয়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশেনের দুই প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে সতর্ক করেছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 May 2019, 07:12 PM
Updated : 22 May 2019, 05:46 PM

আদালত বলেছে, এখনই পদক্ষেপ না নিলে আসছে বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব আরও বাড়তে পারে।

তলবে হাজির হলে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে বুধবার নিজেদের আশঙ্কার কথা জানিয়ে এভাবে সতর্ক করেন বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাই কোর্ট বেঞ্চ।

ফাইল ছবি

রাজধানীর ‘ধুলোবালি প্রবণ’ এলাকাগুলোতে দিনে দুইবার পানি ছিটাতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কী ব্যবস্থা নিয়েছে, আদৌ পানি ছিটানো হয় কি না, সে বিষয়ে জানতে গত ৫ মে ঢাকা সিটি করপোরেশনের দুই প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে তলব করেছিল হাই কোর্ট।

দুই কর্মকতা হাজির হলে আদালত রাজধানী ঢাকার, রাস্তাঘাট, ফুটপাত, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জলাবদ্ধাতা, ধুলোবালি, উন্নয়নকাজ, মশা নিধনসহ সার্বিক পরিবেশ নিয়ে নানা মন্তব্য করেন।

পানি ছিটানোর বিষয়ে আইনজীবী নুরুন্নাহার নূপূর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষে প্রতিবেদন দাখিল করলে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান জানতে চান, এর মধ্যে কখন, কোথায় পানি ছিটানো হয়েছে তার ডিটেইল আছে? ছবি দেখ তো কিছু বোঝা যায় না।

আইনজীবী বলেন, সুনির্দিষ্টভাবে বলা আছে কে কখন কোথায় পানি ছিটিয়েছে। ৫ মে থেকে ১২ মে পর্যন্ত নিয়মিত পানি ছিটানো হয়েছে।

বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের তখন জানতে চান, কয়টা থেকে কয়টা পর্যন্ত পনি ছিটানো হয়েছে?

আইনজীবী নূপুর উত্তরে বলেন, “আমাদের দিতে হয় খুব সকালে। সূর‌্য ওঠার অগেই আমাদের দিয়ে শেষ করতে হয়।” 

প্রতিবেদন দেখে বিচারক বলেন, “এই যে সকালে লিখলেন, বিকেলে লিখলেন, এটা একটা গোঁজামিল দিলেন আর কি। গোঁজামিল বোঝেন তো?”

আইজীবী বলেন, “আমাদের জিপিএস আছে। মনিটরিংটা করে মূলত জিপিএস’র মাধ্যমে। একটা সেন্ট্রাল জিপিএস আছে। সে জিপিএস’র মাধ্যমে টপ টু বটম এটা কন্ট্রোল করা হয়।”

জ্যেষ্ঠ বিচারক তখন বলেন, “কোনো টাইম-টেবল নাই, কখন পানিভর্তি গাড়ি গেল, কখন পানি ছিটাল কোনো স্টেটমেন্ট নাই।”

এসময় রিট আবেদনকারী পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, “এখানে যে দুইটা এফিডেবিট, তার মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের, আরেকটা দক্ষিণের। উত্তরেরটাতে মহা ব্যবস্থাপক অনুমোদন করেছেন এই কর্মকর্তাকে হলফনামা করার জন্য। কীভাবে সম্ভব এটা? তারা কীভাবে এটা করে?

“আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ও তার নির্বাহী কর্মকর্তার পক্ষে আব্দুস সাত্তার নামের একজন কর্মকর্তা অনুমোদন করেছেন। কী ডিজগাস্টিং বিষয়!”

মনজিল বলেন, “গত তারিখে তারা একটা হলফনামা দিয়েছে। সেই হলফনামা তো আপনারা গ্রহণ না করে বলেছিলেন ডকুমেন্টসহ হলফনামা দিতে। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি অনুমোদন দিয়ে তো তিনি আজকের হলফনামা করতে পারেন না।”

মনজিল বলেন, “আজ যারা আদালতে হাজির হলেন, উনাদের কি একটা রেসপন্সসিবিলিটি নাই? চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার এই রিট পিটিশনের বাদী। উনারা তো সিগনেচার করেন নাই। উনাদের তো কোনো লায়বেলেটিস নাই কোথাও।

“এই হলফনামা যদি ফলস থাকে, কাউকে তো ধরতে পারব না আমরা। চিফ এক্সিকিউটভকে তো ধরতে পারব না আমরা। এই ডকুমেন্টগুলো (পানি ছিটানোর প্রতিবেদন) আজকে দেওয়া হয়েছে আমাদের।

“আমরা এগুলো পর্যালোচনা করব। কীভাবে পানি ছিটাচ্ছে? যদি দেখি যে হলফনামা ফলস, তাহলে কাকে ধরব। এটা তো আদালত গ্রহণ করতে পারে না।”

সিটি করপোরেশনের আইনজীবী নুরুন্নাহার নূপুর তখন বলেন, “সিটি করপোরেশনের নীতিমালা আছে যে, ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র ও যেকোনো কর্মকর্তা, কর্মচারীর পক্ষে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এফিডেভিট করতে পারেন।”

বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের তখন বলেন, “আপনার নীতিমালা দিয়ে তো কোর্ট চলবে না। এখানে যদি আপনি কারচুপি করেন, তাহলে শাস্তির ব্যবস্থা আছে। আপনি যে এভাবে হলফনামা করলেন, এখন মেয়র কিংবা নির্বাহী কর্মকর্তা যদি অস্বীকার করেন, তাহলে তো আপনি বিপদে পড়বেন। উনাদের অনুমোদন নিতে হবে।”

‘প্রোপারলি পানি ছিটানো হচ্ছে না’

শুনানির এক পর্যায়ে  বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক এফ আর এম নাজমুল আহাসান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমানকে ডায়াসে ডাকেন।  

বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের তখন বলেন, “আমরা অনেক কিছু বলতাম। যেহেতু হলফনামাটা প্রোপারলি হয়নি, তাই অনেক কিছুই বললাম না। কিন্তু আমাদের কাছে মনে হচ্ছে প্রোপারলি পানি ছিটানো হচ্ছে না।”

বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান বলেন, “আপনি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, শোনেন আপনাদের কনশাস থাকতে হবে। যেহেতু আপনাদের পার্টি করা হয়েছে, যদি এ ব্যপারে প্রোপার কোনো নির্দেশনা না থাকে তাহলে একটা আদেশ হলে তখন কিন্তু সমস্যা হবে। আপনারা হলফনামা করে আদেশ বাস্তবায়ন করেন।

“দুই নম্বর কথা হল রুলের তো দুইটা পার্ট আছে, একটা হল -পরিবেশ অধিদপ্তর, আরেকটা হল সিটি করপোরেশন। আপনাদের যেহেতু পানি ছিটানোর কাজ তাই এই কাজটা প্রোপারলি হচ্ছে কিনা সেটা আপনাদেরই মনিটর করতে হবে। কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী দিনে দুইবার কোথায়, কোন জায়গায় পানি ছিটাতে হবে, সেটা আপনাদের দেখতে হবে। এবং এ বিষয়ে ডিটেইলস আপনাদের দিতে হবে।”

বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ এ বিচারপতি বলেন, “দেখেন, আপনারা প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা। আপনাদের আইন মানতে হবে। কোর্টের আদেশ আপনাদের মানতে হবে। আপনার-আমার সকলেরই বেতন-ভাতা, বাড়ি-গাড়ি, সুযোগ-সুবিধা, সবই হয় জনগণের টাকায়।

“দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন না করলে আপনাদের জবাবদিহি করতে হবে। আইনের উর্ধ্বে কেউ না এবং জনগণ সেটা মানবেও না। তাই এক মাস সময় দিয়ে দিচ্ছি, এই এক মাসের মধ্যে প্রোপারলি সবকিছু দেবেন।”

ক্ষতিপূরণ দিতে বললে উন্নয়নের বাজেট থাকবে না

কনিষ্ঠ বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের বলেন, “এখনে পরিবেশের বিষয়টিও যুক্ত। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি দেখবেন প্রায় সমই রাস্তা খোঁড়াখুড়ি হচ্ছে। ওভারব্রিজ এমনভাবে করেছেন যে, ওভারব্রিজের কারণে ফুটপাত বন্ধ হয়ে গেছে।

“এই যে বিষয়গুলো, খুব সাধারণ বিষয় কিন্তু। বাইরের দেশে এগুলো নিয়ে কিন্তু মামলা হয়, অবহেলার জন্য আমলাদের ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়। আপনাদের ক্ষতিপূরণ দিতে বললে উন্নয়নের বাজেট থাকবে না। এগুলো আপনাদের দেখা উচিৎ, যেহেতু আপনারা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।”

এ বিচারপতি আরও বলেন, “আপনাদের ম্যানহোল থাকে না। একটু বৃষ্টি হলেই ঢাকা শহরে অনেক জায়গায় পানি হাঁটুর উপরে চলে যায়। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও....ঢাকা সিটি পুরনো একটা সিটি। তারপরও যদি আপনারা এসবের ব্যবস্থা না করতে পারেন, এগুলো সবই কিন্তু পরিবেশের সাথে সম্পৃক্ত। জলাবদ্ধতা থেকে আরম্ভ করে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পানি ছিটানো সবই।”

এই বিচারক বলেন, “তখন পানি ছটানোর উপর আমাদের রুলটা ছিল, কারণ খুব বেশি বাজে অবস্থা ছিল। এজন্য আমরা স্পেসিফিকিলি এটা নিয়ে রুলটা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরিবেশের সাথে তো সবগুলো বিষয়ই জড়িত। এগুলোর বিষয়ে আপনাদের দায়িত্ব আছে।

“আমাদের মনে হচ্ছে, এর মধ্যে আপনাদের অনেক নেগল্যানেন্সি আছে। কিছুদিন আগে দেখলাম ফুটপাতের মধ্যে দুই তিন ফিট পর পর ব্যারিয়ার করেছেন মোটরসইকেলের জন্য। মোটরসাইকেলের জন্য ব্যারিয়ার করেছেন ভাল কথা, কিন্তু এতে পথচারীও তো আহত হচ্ছে। এগুলো নিয়া যদি মামলা হত তাহলে আপনাদের উন্নয়ন বাজেট থাকত না। আপনারা কিন্তু মানুষের কাছ থেকে ট্যাক্স কম নেন না। ট্যাক্স নিচ্ছেন ঠিকই, বিনিময়ে কিন্তু আপনারা কিছু দিচ্ছেন না।”

‘২০ তলার উপরেও মশা’

এ পর্যায়ে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান বলেন, “শোনেন আরেকটা বিষয়, যদিও রুলের টার্মে এটা নেই, তারপরও বলছি পাবলিক ইন্টারেস্টের বিষয়। এই যে বর্ষার সিজন আসছে, আপনারা যদি এখনই স্টেপ না নেন তাহলে কিন্তু ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ায় মানুষ আক্রান্ত হবে।

“আমরাও কিন্তু ভুক্তভোগী। এই বিষয়গুলো আপনারা ভালোভাবে দেখবেন। আগে থেকেই পদক্ষেপ নেবেন। ২০ তলার উপরেও মশা। এখন থেকেই যদি শুরু না করেন, এই সিজনে আরও বাড়বে কিন্তু।”

তখন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি বলেন, এগুলো দেখবন কারণ, এখানে বিদেশি দূতাবাস আছে। মশার বিষয়টি দেখবেন। আর

ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ে গণমাধ্যমে ২১ জানুয়ারি প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে একটি রিট আবেদন করা হয়।

ওই রিটের শুনানি নিয়ে ২৮ জানুয়ারি আদালত রুলসহ আদেশ দেয়।

ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ রোধে প্রশাসনের ‘নিষ্ক্রিয়তা’ কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না এবং ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ বন্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না- তা জানতে চাওয়া হয় রুলে।

বন ও পরিবেশ সচিব, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, পরিচালক, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র, নির্বাহী কর্মকর্তা, ডিএমপি কমিশনার, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ -রাজউক’র চেয়ারম্যানসহ ১১ বিবাদিকে দুই সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।