১০৪ উপজেলায় প্রাথমিকের শিশুরা পেতে যাচ্ছে রান্না করা খাবার

‘জাতীয় স্কুল মিল’ নীতি অনুযায়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের পুষ্টি সরবরাহ নিশ্চিত করতে দুপুরে রান্না করা খাবার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

জয়ন্ত সাহা নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 May 2019, 07:09 PM
Updated : 14 May 2019, 08:33 PM

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফও) সহযোগিতায় জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলা, বান্দরবানের লামা উপজেলা, বরগুনার বামনা উপজেলায় ২০১৩ সালে এই প্রকল্পটি প্রাথমিকভাবে চালু করা হলেও এখন দেশের দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকার সব সরকারি প্রাক প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রকল্পটি চালু করতে চায় তারা।

আগামী জুলাই থেকে আরও ১৬টি উপজেলায় চালু হবে দুপুরে খাবার দেওয়ার এই কর্মসূচি। পরে এই কর্মসূচির আওতায় আসবে ১০৪টি উপজেলার সবগুলো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আকরাম আল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,  “১৬টি উপজেলায় প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি দেখে বাকি উপজেলাগুলোতে কীভাবে কাজ করা হবে, তার ছক কষা হবে।”

তিনি আশা করেন, আগামী বছরের মধ্যে ওই সব প্রাক প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তারা এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারবেন।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে ৬৫ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২ কোটির বেশি। এর মধ্যে দারিদ্র্যপ্রবণ ১০৪টিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩২ লাখের মতো।

১০৪ উপজেলায় স্কুল মিল নীতি বাস্তবায়ন করতে গেলে বছরে ৮ হাজার কোটি টাকা লাগবে বলে হিসাব কষেছে মন্ত্রণালয়।

সচিব আকরাম বলেন, “আমরা ৮০০০ কোটি টাকা চেয়েছি। সারা দেশে বাস্তবায়ন করতে গেলে এই টাকাটা লাগবে। তবে সরকারি সহযোগিতা ছাড়াও বেসরকারি পর্যায় থেকে কেউ সহযোগিতা করতে চাইলে তাও আমরা নেব।”

জাতীয় স্কুল মিল নীতির দায়িত্বে থাকা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব বাজেট থেকে প্রাথমিকভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। অর্থ বিভাগও এই প্রকল্পে অর্থ দেবে। 

স্কুল মিল নীতি প্রকল্পের ওপিডি নূরুন্নবী সোহাগ বলেন, ”স্কুলে দুপুরের খাবার দিতে গিয়ে  শিক্ষার্থী প্রতি ১৬ টাকা খরচ হবে।”

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে একটি সেল বা ইউনিট গঠন করা হবে। কার্যক্রমের পরিধি সম্প্রসারণে একটি পৃথক জাতীয় স্কুল মিল কর্মসূচি কর্তৃপক্ষ গঠনের চিন্তাও রয়েছে।

এছাড়া বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির কারিগরি সহায়তায় বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে পরে একটি খাদ্য ও পুষ্টি গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্রও গঠন করবে মন্ত্রণালয়।

যেভাবে শুরু

২০১১ সাল থেকে সরকার ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) যৌথভাবে স্কুল ফিডিং কর্মসূচি শুরু করে।

এ কর্মসূচির আওতায় দেশের ১০৪টিউপজেলায় ৩২ লাখ ৩১ হাজার প্রাক প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিশেষভাবে প্রস্তুত বিস্কুট সরবরাহ করা শুরু হয়।

কিন্তু শুধু বিস্কুট দিয়ে শিশুদের পুষ্টি চাহিদা নিশ্চিত করতে গিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। পুষ্টিবিদরাও স্কুলে ভারী খাবার দেওয়ার পক্ষে মতামত দেন।

এরপর রান্না করা খিচুড়ি দেওয়া পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয় বান্দরবানের লামা, বরগুনার বামনা ও জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার স্কুলগুলোতে।

মিলছে সাড়া

শিশুদের পুষ্টি নিশ্চিতের পাশাপাশি দারিদ্র্যপ্রবণ  বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া ঠেকানোও ‘স্কুল ফিডিং কর্মসূচি’র লক্ষ্য।

আর এই কর্মসূচিতে ইতিবাচক সাড়া মিলেছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষক, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা।

পার্বত্য লামা উপজেলার চেয়ারম্যান থোয়াইনু অং চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই প্রকল্প চালু হওয়ার পর স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতির হার বেড়েছে। পিছিয়ে পড়া দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিশুরা এতে উপকৃত হচ্ছে।”

সাগরকূলের বামনা উপজেলার পূর্ব সফিপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেন বলেন, “শুধু যে দরিদ্র পরিবারের শিশুরাই এতে আগ্রহী হচ্ছে, তা নয়। অবস্থাপন্ন ঘরের শিশুরাও স্কুলে মিড ডে মিল খাচ্ছে। প্রথম দিকে কয়েকজন অভিভাবক বলতেন, সরকারি  খাবার খেতে হবে না। পরে এখন তারাও আগ্রহী হয়ে উঠেছে।”

তবে সপ্তাহে ছয়দিন একই রকমভাবে খিচুড়ি রান্না করা হয় বলে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কিছুটা কমছে বলে জানান তিনি।

আনোয়ার হোসেন বলেন, “শুরুতে তো জনপ্রতি ২৫ গ্রাম পাম ওয়েল নির্ধারণ করা দেওয়া হয়েছিল। পরে খিচুড়িতে তেলের গন্ধ ভেসে আসে বলে তা কমিয়ে আনা হয়েছে ১২ গ্রামে। এখন ৯০ গ্রাম চাল, ২৫ গ্রাম ডাল আর ৭০ গ্রামের মতো সবজি মিলিয়ে একটা খিচুড়ি রান্না করে দেওয়া হচ্ছে।

“এতে শিশুদের খিদে মিটলেও এখন তারা প্রতিদিন একই খাবার খাবে না বলে দাবি জানিয়েছে। তাছাড়া এখন সবজির পরিমাণও কমছে ধীরে ধীরে। খাবারটা যেহেতু ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম দিচ্ছে, তাই ওদেরই ঠিক করতে হবে ব্যাপারটা। আমরা শিক্ষকরা উপজেলা প্রশাসন, জেলা প্রশাসনে জানিয়েছি।”

স্কুলের মিড ডে থেকে সবজির পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণ খতিয়ে দেখবেন বলে জানান বামনা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা শিউলি হরি।

তিনি বলেন, “বিস্কুটের পরিবর্তে যখন খিচুড়ি দেওয়া শুরু হল, তখন শিশুদের স্কুলে উপস্থিতির হার লক্ষ্যণীয়ভাবে বেড়ে যায়।”

স্কুলে মিড ডে মিল চালু হওয়ার পর উপস্থিতির হার ৭০ থেকে ৯৫ শতাংশে উন্নীত হওয়ার কথা জানালেন জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার দক্ষিণ সিনাটুলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল কাইয়ুম।

পুষ্টি নিশ্চিত কীভাবে

গত এপ্রিলে জাতীয় স্কুল মিল নীতি-২০১৯ এর চূড়ান্ত খসড়া উপস্থাপনের পর তা বাস্তবায়িত হলে শহর ও গ্রামের মধ্যে শিক্ষার মানের পার্থক্য দূর হবে আশা করছে মন্ত্রণালয়। 

প্রাক প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩ থেকে ১২ বয়সী ছেলে ও মেয়ে শিশুদের জন্য এই নীতি প্রযোজ্য হবে।

পুষ্টি নিয়ে এতে বলা হয়েছে,  বাংলাদেশের জাতীয় খাদ্যগ্রহণ নির্দেশিকা অনুযায়ী দৈনিক প্রয়োজনীয় শক্তির ১০ থেকে ১৫ শতাংশ প্রোটিন থেকে এবং ১৫-৩০ শতাংশ চর্বি থেকে আসা নিশ্চিত করা হবে। তবে স্যাচুরেটেড বা সম্পৃক্ত চর্বির পরিমাণ ১০ শতাংশের কম রাখতে হবে।

“ন্যূনতম খাদ্য তালিকাগত বৈচিত্র্য বিবেচনায় ১০টি খাদ্য গোষ্ঠীর মধ্যে ন্যূনতম ৪টি খাদ্য গোষ্ঠী নির্বাচন নিশ্চিত করা হবে, যেখানে কমপক্ষে একটি প্রাণিজ উৎস থেকে বিবেচনায় নেওয়া হবে।”

নীতিমালায় শিশুদের জন্য পুষ্টি পরিকল্পনায় সহযোগিতা করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পুষ্টি বিভাগ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনেক দিন ধরে স্কুলে শিশুদের পুষ্টি চাহিদা মেটানো হচ্ছিল কেবল বিস্কুট দিয়ে। ওদের প্রপার নিউট্রিশনের জন্য কেবল বিস্কুট দিয়ে কিছু হবে না। এ নিয়ে সমালোচনাও কম হয়নি।

“অনেক স্কুলে তো বিস্কুট খায়ও না শিশুরা। তাদের ব্যালেন্সড ডায়েটের জন্য দিনে হট মিল বা মিড ডে মিলের বিকল্প ছিল না। আমরা অনেক দিন ধরেই বলে আসছিলাম। সরকার প্রাথমিকভাবে অনেকগুলো উপজেলায় কাজ শুরু করতে যাচ্ছে।”

এই অধ্যাপক মনে করেন, প্রাথমিক ধাপে এই কর্মসূচির আওতায় দুর্গম ও চরাঞ্চলের স্কুলগুলোকে বেছে নেওয়া উচিৎ, যেখানে খাদ্য ঘাটতি চরম।

কর্মসূচির আওতা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে খসড়া প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে খাদ্য ঘাটতি এলাকাসহ আর্থ সামাজিক ও ভৌগোলিক কারণে অনগ্রসর (যেমন দুর্গম চর, হাওর, উপকূলীয় অঞ্চল, পার্বত্য এলাকা, চা বাগানসহ সকল পিছিয়ে পড়া) এলাকাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা।

নাজমা শাহীন বলেন, “স্কুলের হট মিল কীভাবে রান্না করা হবে, তার উপর নির্ভর করছে পুষ্টি মান। আমরা প্রকল্পটা ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। এতে শিশুদের ঝরে পড়ার হারও কমতে থাকবে। বিদ্যালয়েই যখন খাবার মিলবে, শিশুরা তখন নিশ্চিন্ত থাকবে।”

সচিব আকরাম  বলেন, এ বছর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জাতীয় স্কুল মিল নীতি চূড়ান্ত করা হবে।