সব এখানে কেন: হাই কোর্ট

নির্বাহী বিভাগের হাতে যেসব কাজের দায়িত্ব, সে সব বিষয়ে বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপ করতে হওয়ায় উষ্মা প্রকাশ করেছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 May 2019, 03:19 PM
Updated : 12 May 2019, 07:09 AM

“আমরা কি দেশ চালাই নাকি, দেশ চালায় সরকার। কোথায় ভেজাল হচ্ছে, কোথায় জেলখানায় মানুষ পুড়ে যাচ্ছে, এসব কেন আমাদের কাছে আসবে? এসব দেখার দায়িত্ব তো সরকারের। সরকার কী করছে?”

ভেজাল ও নিম্নমানের খাদ্য ও ভোগ্যপণ্য রোধে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে বৃহস্পতিবার একটি রিট আবেদনের শুনানিতে বিচারকের এই মন্তব্য আসে।

গত ২ মে শিল্প মন্ত্রণালয় এক সংবাদ সম্মেলনে ৫২টি ভেজাল ও নিম্নমানের খাদ্যপণ্যের তালিকা তুলে ধরে জানিয়েছিল, এসব প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠানো হয়েছে।

এই ৫২টি খাদ্যপণ্য বাজার থেকে প্রত্যাহার, জব্দ ও মান উন্নীত না হওয়া পর্যন্ত উৎপাদন বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে বুধবার ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনশাস কনজ্যুমার সোসাইটি (সিসিএস)’র পক্ষে রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিহাব উদ্দিন খান। 

বৃহস্পতিবার বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের বেঞ্চে আবেদনটি শুনানির জন্য ওঠে।

শিহাব উদ্দিন নিজেই শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মোখলেছুর রহমান।

শিহাব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আদালত আজ কোনো আদেশ দেয়নি। তবে মৌখিক আদেশে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলকে বলেছেন বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ থেকে উপ-পরিচালকের নিচে নয় এমন পদমর্যাদার দুজন কর্মকর্তাকে আসতে বলার জন্য।

“ভেজাল বা নিম্নমানের খাদ্যপণ্যের বিষয়ে তাদের কাজ-করণীয়, পদক্ষেপের কথা শুনে আদালত রোববার আদেশ দেবেন।”

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোখলেছুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সারাদেশে সবসময়ই ভেজালের কথা উঠছে। এগুলো নিয়ে তারা আসলে কী করছে, এসব বিষয়ে মূলত জানতেই বিএসটিআই ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ থেকে উপ-পরিচালক মর্যাদার দুজন কর্মকর্তাকে আসতে বলা হয়েছে।”

তার আগে শুনানিতে আইনজীবী শিহাব মানের পরীক্ষায় ৫২টি পণ্যের অকৃতকার্য হওয়ার কথা তুলে ধরে বলেন, এক্ষেত্রে বিএসটিআই শুধু কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়েছে। আর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ তখন রিট আবেদনকারীর আইনজীবীকে বলেন, “এ নিয়ে আপনার চিন্তার কারণ কী?”

ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ধরা পড়ছে মানহীন খাদ্যপণ্য

জবাবে আইনজীবী শিহাব বলেন, “আমাদের চিন্তার কারণ হচ্ছে এই পণ্যগুলো নিত্য ব্যবহার্য। একজন ভোক্তা নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ব্যবহার না করে বা না খেয়ে তো থাকবেন না। সুতরাং এটা পাবলিক ইস্যু।”

ভেজাল রোধে তিনি আদালতের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

তখন বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ বলেন, এগুলো কোর্ট দিয়ে করা যায় না। এ কাজগুলো হল সরকারের।

আইনজীবী বলেন, “আমরা তো নিরূপায়। আপনারা নির্দেশনা দিলে কিছু কাজ হয়।”

বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ তখন উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, “আমরা মানুষের মামলা করব, না এগুলো করব? এগুলো সরকারের কাজ। প্রতি সপ্তাহেই এ বিষয়গুলো আসছে। আবার এগুলো ফেলে দেওয়ার মতোও না।”

উপস্থিত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিচারক বলেন, “কী করব আমরা বুঝতেই পারছি না। প্রতি সপ্তাহে একটা না একটা ম্যাটার আসছেই। এটাতে ভেজাল, ওটতে ভেজাল। বিশেষ ক্ষমতা আইনে খাদ্যে ভেজালের বিষয়ে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান আছে। তারপরও ফরমালিন দিয়ে হরহামেশা এটা-সেটা বিক্রি হচ্ছে।”

রিট আবেদনকারীর দাখিল করা ৫২টি খাদ্যপণ্যের তালিকা দেখিয়ে বিচারপতি বলেন, “কোনো কোম্পানিই তো বাদ নাই।”

বিএসটিআইর এই প্রতিবেদন সম্প্রতি দেওয়া হয়েছে জানার পর বিচারক বলেন, “আমি বুঝতে পারছি না, রোজা আসলেই কেন টেস্ট করতে হবে? রোজার সাথে ভেজালের কী সম্পর্ক?”

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোখলেছুর তখন বলেন, “কোনো সম্পর্ক নাই। উনারা যদি পেয়েই থাকেন যে ৫২টা পণ্য নিম্নমানের, উনারা টেস্ট করেই কেন বসে থাকবেন।”

ওই কোম্পানিগুলোকে ‘শোকজ’ নোটিস পাঠানো হয়েছে জানার পর বিচারক তখন বলেন, “শোকজ করেছে, এখন আমাদের জানা দরকার এর ফলোআপটা কী হয়েছে।

“বিএসটিআই যদি মনে করে এগুলো সাবস্ট্যান্ডার্ড (নিম্নমনের), তাহলে শোকজ করার সাথে সাথে কাজ হল এই পণ্যগুলো বাজার থেকে তুলে নেওয়া এবং রেগুলার সেটার ফলোআপ করা।”

তখন রিট আবেদনকারী আইনজীবী বলেন, “এই পণ্যগুলো বাজারে থাকার কথা না, তারপরও থাকছে।”

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তখন বলেন, “মোবাইল কোর্টগুলোর যে শিডিউল থাকে, সেখানে বিএসটিআইর কোনো সিডিউল নাই। তারা সরকারের অথরিটির কাছে আবেদন করেছে বিএসটিআই’র নতুন আইনটা সংশোধন করে মোবাইল কোর্টের সিডিউলে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য।

“ফলে বিএসটিআই শোকজ, লাইসেন্স সিজ ইত্যাদি করতে পারে। লাইসেন্স বাতিল করলেই কিন্তু হয়ে যায়। এই কারণেই হয়ত শোকজ করেছে। আগে মোবাইল কোর্টে বিএসটিআইর শিডিউল ছিল। এখন নাই।”

বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ তখন বলেন, “ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষ কী করে? একটা স্পেশালাইজইড অর্গানাইজেশন। একটা সংগঠন ঠিকমত কাজ করলেই হয়ে যায়।

“আমরা কি দেশ চলাই নাকি, দেশ চালায় সরকার। বিএসটিআই একটি বিশেষ সরকারি প্রতিষ্ঠান। কোথায় ভেজাল হচ্ছে, কোথায় জেলখানায় মানুষ পুড়ে যাচ্ছে, এসব কেন আমাদের কাছে আসবে। এসব দেখার দায়িত্ব তো সরকারের। সরকার কী করছে?

“এগুলো আমরা করি, আবার আমাদের সমালোচনাও করে। এগুলো তো আমরা ফেলে দিতে পারি না। হাফস্ট্যান্ডার্ড জিনিস বাজারে থাকবে, মানুষ এগুলো ব্যবহার করবে।”

তখন বিচারক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলকে বলেন, ‘আপনি দুটি কোম্পানিকে ডাকেন। আমরা আদেশ দিয়ে ডাকছি না। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের একজন সিনিয়র অফিসারকে ডাকেন, আর বিএসটিআইর একজনকে।

“আপনি রেসপনসিবলদের কাছে জানতে চান, সরকার দায়িত্ব দিয়েছে এই কাজগুলো করার, বসে আছেন কেন? কোর্ট কেন এগুলো করবে?”