দুধ-দইয়ে ভেজাল কারা মেশায়: হাই কোর্ট

দুধ, দই এবং পশু খাদ্যে ভেজাল মেশানোয় কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান জড়িত, তা জানতে চেয়েছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 May 2019, 02:03 PM
Updated : 8 May 2019, 02:06 PM

আগামী ১৫ মে’র মধ্যে তা প্রতিবেদন আকারে আদালতে দাখিল করতে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন দেখে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের হাই কোর্ট বেঞ্চ বুধবার এ আদেশ দেয়।

আদালতে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন ফরিদুল আলম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিনউদ্দিন মানিক। দুদকের পক্ষে ছিলেন খুরশীদ আলম খান।

এর আগে এক আদেশে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ও বাজারে প্যাকেটজাত দুধ, দই ও গোখাদ্যে ব্যাকটেরিয়া, কীটনাশক, অ্যান্টিবায়োটিক, সীসা, রাসায়নিকের মাত্রা নিরূপনে বাজার থেকে নমুনা সংগ্রহ করে জরিপ চালাতে নির্দেশ দিয়েছিল হাই কোর্ট।

ফরিদুল সাংবাদিকদের বলেন, “১৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি কর্মপরিকল্পনাও তৈরি করেছে। এর মধ্যে দুধ, দই ও পশু খাদ্যে ভেজাল মেশানোর সঙ্গে কারা জড়িত, তাদের চিহ্নিত করার বিষয়টি যোগ করতে বলেছেন।

“এছাড়া কমিটির ফাইনাল রিপোর্টে যেন জড়িতদের নাম থাকে সেটিও বলেছেন আদালত।”

আমিন উদ্দিন মানিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিএসটিআই, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও কেন্দ্রীয় নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা সমন্বয় কমিটিকে আগের নির্দেশটি বাস্তবায়ন করতে বলেছিল আদালত।

“নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী গত ১৭ ফেব্রুয়ারি একটি কমিটি গঠন করলেও দুধ, দই ও গোখাদ্যে কারা ভেজাল মেশাচ্ছে, তা চিহ্নিত না করে সরকারের জাতীয় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগার (এনএফএসএল) যে প্রতিবেদন দিয়েছিল, সেটিকে সমর্থন করে হলফনামা আকারে দাখিল করেছে। পাশাপাশি কমিটি যে কর্মপরিকল্পনা নিয়েছে, সেটাকেও তারা তাদের প্রতিবেদনে বলেছে।

“নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের এ প্রতিবেদনে উষ্মা প্রকাশ করে আদালত বলেছেন দুধ, দই এবং পশু খাদ্যে ভেজাল মেশানোয় কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান জড়িত, তার তালিকা করে আগামী ১৫ মের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে।”

এছাড়া বিএসটিআই’র একজন আইনজীবী মহাপরিচালকের পক্ষে বুধবার ওকালতনামা দাখিল করেছিলেন। কিন্তু তাতে বিএসটিআইর মহাপরিচালকের স্বাক্ষর না থাকায় আদালত তা গ্রহণ করেনি।

মানিক বলেন, “এ মামলায় দুদকেরও প্রতিবেদন দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এ মামলায় দুদকের মূল আইনজীবী সৈয়দ মামুন মাহবুব অসুস্থতার কারণে ছিলেন না। তার পক্ষে দুদকের অন্য আইনজীবী খুরশীদ আলম খান এক সপ্তাহের সময় নেন প্রতবেদন দাখিলের জন্য। সব মিলিয়ে আদালত ১৫ মে পর্যন্ত সময় দিয়েছেন।”

এদিকে হাই কোর্টের নির্দেশের পর গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. মাহবুব কবিরকে আহ্বায়ক করে এ কমিটি গঠন করা হয়েছে।

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় জানিয়ে গৃহিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কমিটির কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরা হয় আদালতে দেওয়া প্রতিবেদনে।

কর্ম পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে- ১. কাঁচা তরল ও পাস্তুরিত দুধের নমুনা সংগ্রহ, গবেষণাগারে পরীক্ষা ও কমিটি কর্তৃক ফলাফল পর্যালোচনা; ২. পশু খাদ্যের নমুনা সংগ্রহ এবং গবেষণাগারে পরীক্ষা ও কমিটি কর্তৃক ফলাফল পর্যালোচনা এবং (৩) প্রাথমিক উৎপাদন ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ, ফলাফলসমূহের তুলনামূলক বিশ্লেষণ এবং কমিটি কর্তৃক যথাযথ সুপারিশ প্রণয়ন।

সরকারের জাতীয় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগারের (এনএফএসএল) এক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবর দেখে গত ১১ ফেব্রুয়ারি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ দুধ, দই ও গোখাদ্য পরীক্ষার এ আদেশ দিয়েছিল আদালত।

দুধ, দই ও গোখাদ্যে ভেজাল মেশানো এবং ব্যাকটেরিয়া, কীটনাশক, অ্যান্টিবায়োটিক, সীসা, রাসায়নিকের উপস্থিতি পাওয়ার ঘটনায় কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান জড়িত কিনা, তা অনুসন্ধান করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে দুদক চেয়ারম্যানকেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) আর্থিক সহায়তায় গো খাদ্য, দুধ, দই ও বাজারে থাকা প্যাকেটের পাস্তুরিত দুধ নিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগার (এনএফএসএল) জরিপ চালায়।

এনএফএসএল জরিপের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গাভির দুধের ৯৬টি নমুনা সংগ্রহ করে। ঢাকাসহ তিন জেলার ছয়টি উপজেলাসহ ১৮টি স্থান থেকে দুধের পাশাপাশি অন্যান্য নমুনাও সংগ্রহ করা হয়। গাভির দুধ ও গোখাদ্য সরাসরি খামার থেকে সংগ্রহ করা হয়।

ঢাকা শহরের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দোকান ও আশপাশের উপজেলার দোকান থেকে দই সংগ্রহ করে এনএফএসএল। বিভিন্ন সুপার স্টোর থেকে সংগ্রহ করা হয় বাজারে প্রচলিত প্রায় সব ব্র্যান্ডের প্যাকেটজাত তরল দুধ এবং আমদানি করা প্যাকেট দুধ।

গোখাদ্যের ৩০টি নমুনা পরীক্ষা করে কীটনাশক (২ নমুনায়), ক্রোমিয়াম (১৬টি নমুনায়), টেট্রাসাইক্লিন (২২টি নমুনায়), এনরোফ্লোক্সাসিন (২৬টি নমুনায়), সিপ্রোসিন (৩০টি নমুনায়) এবং আফলাটক্সিন (৪টি নমুনায়) গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রা পাওয়ার কথা জানায় এনএফএসএল।

গাভির দুধের ৯৬টি নমুনার মধ্যে ৯ শতাংশ দুধে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি কীটনাশক, ১৩ শতাংশে টেট্রাসাইক্লিন, ১৫ শতাংশে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রায় সীসা পেয়েছে তারা। ৯৬ শতাংশ দুধে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়াও পাওয়া গেছে।

প্যাকেটের দুধের ৩১টি নমুনায় ৩০ শতাংশে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি হারে টেট্রাসাইক্লিন পাওয়ার কথাও জানিয়েছে এনএফএসএল। একটি নমুনায় সীসা মিলেছে। একই সঙ্গে ৬৬ থেকে ৮০ শতাংশ দুধের নমুনায় বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া পাওয়ার কথা জানিয়েছে তারা।

দইয়ের ৩৩টি নমুনা পরীক্ষা করে একটিতে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি সীসা পাওয়ার কথা জানিয়েছে এনএফএসএল। ৫১ শতাংশ নমুনায় মিলেছে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া।