কারা হেফাজতে দগ্ধ আইনজীবীর মৃত্যু, বিচারিক তদন্তের নির্দেশ

পঞ্চগড়ে কারা হেফাজতে থাকা অবস্থায় আইনজীবী পলাশ কুমার রায়ের অগ্নিদগ্ধ হওয়া এবং পরে হাসপাতালে তার মৃত্যুর ঘটনায় বিচারিক তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 May 2019, 07:06 AM
Updated : 8 May 2019, 02:51 PM

জনস্বার্থে আইনজীবী সৈয়দ সাইয়েদুল হক সুমনের করা এক রিট আবেদনের শুনানি করে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাই কোর্ট বেঞ্চ বুধবার রুলসহ এই আদেশ দেয়।

আদেশে বলা হয়, পঞ্চগড়ের মুখ্য বিচারিক হাকিমের তত্ত্বাবধায়নে একটি ম্যাজিস্ট্রেট টিম দিয়ে ওই ঘটনার বিচারিক তদন্ত করতে হবে। এই আদেশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।

পাশাপাশি এ অনুসন্ধান কাজে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিতে পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক, জেলা কারাগারের প্রধান এবং জেলার পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত।

কারাগারে কারাবন্দিকে যথাযথ নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে।

স্বরাষ্ট্র সচিব, কারা মহাপরিদর্শক, রংপুর বিভাগের কারা উপ মহাপরিদর্শক এবং পঞ্চগড়ের পুলিশ সুপারকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

আইনজীবী সৈয়দ সাইয়েদুল হক সুমন নিজেই তার রিটের পক্ষে শুনানি করেন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মোখলেছুর রহমান।

আগামী ২৩ জুন এ মামলা পরবর্তী আদেশের জন্য আবার আদালতে উঠবে বলে জানিয়েছেন সুমন।

আদেশের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “পঞ্চগড়ের সন্তান পলাশ ঢাকা বারের একজন অ্যাডভোকেট। উনি মানহানির মামলায় পঞ্চগড় জেলা কারাগারে ছিলেন। কারাগারে থাকাকালে গত ২৬ এপ্রিল কে বা কারা তার শরীরে পেট্রোল বা কেরোসিন জাতীয় পদার্থ ঢেলে আগুন দেয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।”

ওই ঘটনার বিচারিক অনুসন্ধান চেয়ে এই রিট আবেদন করেছিলেন জানিয়ে সুমন বলেন, “আদালত শুনানিতে বলেছেন, ছেলেটাকে যদি হত্যা করা নাও হয়ে থাকে, সে যদি আত্মহত্যাও করে থাকে, তাহলেও এটা বের হয়ে আসা দরকার- কারা অভ্যন্তরে সে কেরোসিন অথবা দাহ্য পদার্থ কোথায় পেল, কীভাবে আগুন দিল? এ ব্যাপারটা সামনে আসা জরুরি।

“কারণ জেল-কারাগারকে মনে করা হয় সবচাইতে নিরাপদ জায়গা। আমাদের ইতিহাসের ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। এইটার বদলা কিন্তু আমরা এখনও শেষ করতে পারতেছি না। এমন একটি নিরাপদ জায়গায় হত্যা করা হলে, যদি অভিযোগটা সত্য হয়, আমরা বিশ্বাস করি তদন্তের মাধ্যমে এটা পুরোপুরি বের হয়ে আসবে এবং আসা উচিৎ।’

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোখলেছুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আইনজীবী পলাশের দগ্ধ হওয়ার দিনই পঞ্চগড়ের ডিসি তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন কর দেন। তিন দিনের মধ্যে ওই কমিটির প্রতিবেদন দেওয়ার কথা ছিল।

এরপর ৩০ এপ্রিল আরও দুটো কমিটি গঠন করা হয়। একটি তদন্ত কমিটি করেছেন রংপুর বিভাগের কারা উপ মহাপরিদর্শক; অন্যটি রাজশাহী বিভাগের কারা উপ মহাপরিদর্শক।

“তারা পঞ্চগড় জেল সুপারকে চিঠি দিয়ে তদন্ত করতে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন। ওই কাগজগুলো আদালতকে আমরা দেখিয়েছি। এছাড়া ৩০ এপ্রিল প্রশাসন বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করেছে। এটাও আমরা আদালতকে বলেছি।”

কোহিনূর কেমিকেলসের আইন বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা পলাশ কুমার রায় (৩৬) ঢাকা বারের একজন সদস্য ছিলেন। কোম্পানির ৩১ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০১৬ সালে তার বিরুদ্ধে ঢাকায় একটি মামলা দায়ের হয়।

ওই মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে গত ২৫ মার্চ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে অনশনে বসেন পলাশ। পরে জেলা শহরের শের-ই-বাংলা পার্ক সংলগ্ন মহাসড়কে মানববন্ধন করেন।

সেখানে হ্যান্ডমাইকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রশাসন ও পুলিশকে নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগে পলাশকে আটক করে সদর থানার পুলিশ। পরে রাজীব রানা নামে একজন প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে পলাশের বিরুদ্ধে মামলা করেন৷

কোহিনুরের মামলার শুনানির জন্য গত ২৬ এপ্রিল পলাশকে পঞ্চগড় থেকে ঢাকায় পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু সেদিন সকালে তাকে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরদিন পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে।

ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩০ এপ্রিল দুপুরে মারা যান পুলিশ। তার শরীরের ৪৭ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল বলে চিকিৎসকরা জানান।

পলাশের মা পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মীরা রানি রায় এরপর অভিযোগ করেন, তার ছেলেকে কারা হেফাজতে থাকা অবস্থায় পরিকল্পিতভাবে  পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। দুইজন তার গায়ে তরল কিছু ঢেলে আগুন দিয়েছে বলে মৃত্যুর আগে বলে গেছে পলাশ।

অন্যদিকে পঞ্চগড় জেলা কারা কর্তৃপক্ষের দাবি, অসুস্থ পলাশকে সেদিন কারা হাসপাতালে রাখা হয়েছিল। ওই হাসপাতালের বাথরুমে গিয়ে পলাশ নিজের শরীরে আগুন দেন। পরে কারাগারের লোকজন আগুন নিভিয়ে তাকে হাসপাতালে পাঠায়। 

ওই ঘটনার বিচারিক তদন্ত চেয়ে আইনজীবী সৈয়দ সাইয়েদুল হক সুমন গত সোমবার হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন।

মঙ্গলবার মামলাটি শুনানির জন্য উঠলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মোখলেছুর রহমান আইনজীবী সুমনের রিট করার এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর হিসেবে সুমন সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন কিনা- সেই প্রশ্ন তোলেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী।

তখন আদালত প্রসিকিউটর হিসেবে সুমনের নিয়োগপত্র দেখতে চেয়ে বুধবার বিষয়টি শুনানির জন্য রাখে।

বুধবার সুমন তার নিয়োগপত্র উপস্থাপন করে বলেন, এ মামলা করার এখতিয়ার তার রয়েছে। পরে আদালত এ বিষয়ে কোনো আদেশ না দিয়ে রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে রুলসহ আদেশ দেয়।

আদেশের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নে সুমন বলেন, “আন্তর্জাতিক অপরধ ট্রাইব্যুনালের একজন প্রসিকিউটর হিসেবে আমি এই মামলায় বাদী হতে পারি কিনা, সেই প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, যেহেতু সরকারের কয়েকটি অর্গান এর মধ্যে জড়িত। তো আমি আমার নিয়োগপত্র দেখিয়েছি। নিয়োগপত্রের কোথাও বিধিনিষেধ নাই। নিয়োগপত্রে বলা আছে, আমি যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে মামলা লড়তে পারব না। কিন্তু যুদ্ধাপরাধী ছাড়া অন্য কারো পক্ষে আমি মামলা করতে পারব না- এরকম কোনো বিধিনিষেধ নাই।”