বুড়িগঙ্গা দূষণ রোধে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে: হাই কোর্ট

প্রায় আট বছর আগে হাই কোর্টের দেওয়া একটি রায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী বুড়িগঙ্গার পানি দূষণ রোধে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, আদৌ নেওয়া হয়েছে কি না এবং নিয়ে থাকলে কী কী উন্নয়ন ঘটেছে, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের প্রতিবেদন দিতে বলেছে আদালত।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 May 2019, 11:25 AM
Updated : 2 May 2019, 11:29 AM

আদালতের নির্দেশনা পুরোপুরি বা নিয়মিতভাবে প্রতিপালন না করায় বুড়িগঙ্গার পানির ‘দূষণ থামছে না’। তাই ২০১১ সালের রায়ে যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল সেসব নির্দেশনা আবার দেওয়ার আরজি জানিয়ে সম্পূরক আবেদন করে রিটকারী পরিবেশ ও মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)।

ওই আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুর ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহর হাই কোর্ট বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এ আদেশ দেয়।

আদেশে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বিআইডব্লিটিএর চেয়ারম্যান, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (পোর্ট অ্যান্ড ট্রাফিক), ঢাকার জেলা প্রশাসক, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ, ডেমরা ও কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে আদেশ পাওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছে আদালত।

দূষিত বুড়িগঙ্গার বুক চিরে চলছে নৌযান। পোস্তগোলার বাংলাদেশ চীন মৈত্রী সেতু থেকে তোলা ছবি। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

আদালতে আবেদনের পক্ষে শুননি করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ এস এম নাজমুল হক।

মনজিল মোরসেদ পরে সাংবাদিকদের বলেন, “এইচআরপিবির জনস্বার্থে করা এক রিট মামলায় ২০১১ সালে বুড়িগঙ্গার পানি দূষণ রোধে আদালত রায়ে অনেকগুলো নির্দেশনা দিয়েছিল।

“বুড়িগঙ্গার ভেতরে যে সমস্ত স্যুয়ারেজ লাইন আছে, ইন্ডাস্ট্রিয়াল লাইন আছে সেগুলো ছয় মাসের মধ্যে বন্ধ করার নির্দেশের পাশাপাশি বুড়িগঙ্গার তীরে যাতে ময়লা আবর্জনা ফেলতে না পারে সেজন্য সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম করার জন্য বলা হয়েছিল রায়ে।  

“কিন্তু সংশ্লিষ্টরা এই নির্দেশনাগুলো পুরোপুরি পালন না করায় বুড়িগঙ্গার পানির দূষণ ঘটেই চলেছে। তাই এ ব্যাপারে এইচআরপিবির পক্ষে আজ  একটি সম্পূরক আবেদন করেছিলাম যে, রায়ের নির্দেশনাগুলো পুনরায় দেওয়া হোক।”

শুনানি শেষে আদালত রায়ে যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, তা প্রতিপালনে সংশ্লিষ্টরা কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে সে বিষয়ে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে একটি অগ্রগতি প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করতে বলেছে বলে জানান তিনি।

আগামী ২০ মে এই বিষয়ে পরবর্তী আদেশের জন্য দিন রাখা হয়েছে বলেও জানান এই আইনজীবী।

কুচকুচে কালো বুড়িগঙ্গার পানি, তার উপরে কালো ধোয়া ছেড়ে চলছে ‘ওয়াটার বাস’। কামারাঙ্গীরচর এলাকা থেকে তোলা ছবি। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

কী কারণে মনে হয়েছে আদালতের নির্দেশনা পুরোপুরি মানা হয়নি বা বুড়িগঙ্গার পানি দূষণ ঘটছে, জানতে চাইলে মনজিল মোরসেদ বলেন, এ মামলাটি একটি চলমান মামলা।

“আমরা বুড়িগঙ্গা ভিজিট করতে গিয়ে দেখলাম যে, বুড়িগঙ্গার পানির অবস্থা একই রকম। স্যুয়ারেজ লাইন বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়েছে। শ্যামপুর ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ার লাইনগুলোও বুড়িগঙ্গায় এসে পড়ছে, ময়লাও ফেলা হচ্ছে। পরিদর্শনের এই অভিজ্ঞতা থেকেই আবেদনটি করা হয়েছে।”

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের নোটিশ দেওয়া হয়েছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুই-তিন বছর আগে একবার দিয়েছিলেন।

তাহলে বিবাদীদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ কেন আনা হল না- প্রশ্নে তিনি বলেন, “নির্দেশনাগুলো ছিল ওয়াসা, বিআইডব্লিটিএ, পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসক ও সংশ্লিষ্ট থানার ওসিদের প্রতি। গত সাত-আট বছরে এসবে প্রশাসনের পরিবর্তন হয়েছে। নতুন যারা তারা হয়ত জানেও না। যে কারণে আদালত অবিমাননার অভিযোগের আবেদন না করে রায়ের নির্দেশনাগুলোই আবার চেয়েছিলাম।”

বুড়িগঙ্গার পানি দূষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা চেয়ে ২০১০ সালে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে একজন আইনজীবী হাই কোর্টে রিট আবেদন করেছিলেন।

সে রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১১ সালের ১ জুন বুড়িগঙ্গায় বর্জ্য ফেলা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে তিন দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেয় হাই কোর্ট।

বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যানকে প্রতি মাসে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়।

বুড়িগঙ্গার দূষিত এই পানিতেই কাপড় ধোয় ঢাকার অনেক লন্ড্রি। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

আদালত রায়ে বলেছিল, “এ ব্যাপারে গাফিলতি হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বুড়িগঙ্গার পানি এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, একে এখন আর পানি বলা যায় না। এই পানি দূষিত হয়েছে বিষাক্ত বর্জ্যের ফলে। এতে শুধু রাজধানী ঢাকার নয়, গণমানুষের স্বাস্থ্য মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। আশু ব্যবস্থা না নিলে আরও ক্ষতি হয়ে যাবে।”

রায়ের নির্দেশনা

# বুড়িগঙ্গায় সংযুক্ত সব পয়ঃপ্রণালীর লাইন (স্যুয়ারেজ) ও শিল্পকারখানার বর্জ্য নিঃসরণের লাইন এক বছরের মধ্যে বন্ধ করতে ওয়াসার চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

# প্রতি মাসে নদীতে বর্জ্য ফেলা রোধে নদীর দুই পারে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান করতে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

# বিশেষ দলের মাধ্যমে নদীতীরের বর্জ্য অপসারণের নির্দেশ দিয়ে বলা হয়, নদী তীরে সিটি করপোরেশনের কোনো ভ্যান বা গাড়ি ময়লা ফেলতে পারবে না। একই সঙ্গে নদী তীরবর্তী এলাকায় সাইনবোর্ড ও প্ল্যাকার্ড স্থাপন করতে হবে, যাতে আদালতের রায় সম্পর্কে জনগণ জানতে পারে।

রায়ে আদালতের বক্তব্য

বিআইডব্লিউটিএর কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করে আদালত রায়ে বলে, “অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব কারোরই নয়। এই প্রতিষ্ঠানটি দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকছে বলেই আজ এ অবস্থা। জনগণের অর্থে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানটি তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করছে না। অথচ প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব হচ্ছে নদী দূষণমুক্ত রাখা ও ভূমিদস্যুদের হাত থেকে রক্ষা করা।

“এ অবস্থা কোনোভাবেই চলতে দেওয়া যায় না। অর্পিত দায়িত্ব তারা কতটুকু পালন করেছে, তা সবার কাছে প্রশ্ন। এমনকি গত কয়েক দিনে পত্রিকায় প্রকাশিত ছবিতে বুড়িগঙ্গার অসহায়ত্ব প্রকাশ পেয়েছে।”