অযত্ন-অবহেলায় ‘ধুঁকছে’ মুজিবনগরের আম্রকানন

বাংলাদেশের জন্মলগ্নের স্মৃতিবিজড়িত মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আমবাগান অযত্ন আর অবহেলায় মরতে বসেছে বলে জানিয়েছেন একজন উদ্ভিদ প্রযুক্তিবিদ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 April 2019, 10:50 AM
Updated : 17 April 2019, 11:12 AM

সম্প্রতি দুই দফা মুজিবনগর ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা জানিয়ে বাংলাদেশের ডেভেলপমেন্ট অফ বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল কনজারভেশন সেন্টারের (ডেবটেক) এর নির্বাহী পরিচালক ড. ফেরদৌসী বেগম এক নিবন্ধে লিখেছেন, মৃতপ্রায় আমগাছগুলোর অবস্থা দেখে তিনি চোখের জল ধরে রাখতে পারছিলেন না।

“আমার মতে এক একটি আম গাছ এক একটি মুক্তিযোদ্ধা। এখানে যে ১১০৭টি আমগাছ আছে তা এক একটি স্মৃতিফলক। তবে এ স্মৃতিফলকগুলি প্রাণহীন নয়। এদের বাঁচিয়ে রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।”

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল ওই আমবাগানে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করে, যার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও সরকার পরিচালনা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়।

সেই সরকারের নেতৃত্বে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ।

ফেরদৌসী বেগম জানান, পানির ব্যবস্থা না থাকায় বাগানের মাটি হয়ে গেছে জমাট বাঁধা সিমেন্টের মত। গাছগুলো আক্রান্ত হয়েছে বিভিন্ন রোগে। পরজীবী শুষে নিচ্ছে গাছগুলোর জীবনী শক্তি।

গতবছর নভেম্বর মাসে মুজিবনগরে গিয়ে আম বাগানের ওই পরিস্থিতি দেখার কথা জানিয়ে তিনি লিখেছেন, “সেই অনুভূতির কথা আমি কাউকে বুঝাতে পারব না। … যুদ্ধে চাচাকে হারানোর ব্যথা নিয়ে যখন আমগাছগুলোর দিকে তাকাই, তখন মনে হচ্ছিল এই আমগাছগুলো শহীদ হয়ে যাচ্ছিল।”

বাংলা একেডেমি পুরস্কারজয়ী বিজ্ঞান লেখক ফেরদৌসী লিখেছেন, আম গাছগুলো মৃতপ্রায় অবস্থার কথা গত জানুয়ারিতে তিনি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হককে জানান।

মুজিবনগর নতুন করে ঢেলে সাজানোর জন্য সরকার এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী তখন আমগাছগুলো রক্ষার জন্য করণীয় নির্ধারণে একটি বিশদ বিবরণ দিতে ফেরদৌসীকে অনুরোধ করেন।

এরপর গত ১৬ থেকে ১৮ মার্চ তিনজন বিশেষজ্ঞকে সঙ্গে নিয়ে মুজিবনগরের ওই আমবাগানের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন ফেরদৌসী।   

“প্রথমেই দেখতে পাই যে, প্রচুর দোকানপাট, আবর্জনা, ময়লা পলিথিন ও পিকনিক পার্টির ওয়ান টাইম থাল-বাসন, পানির বোতল ছড়িয়ে ছিটিয়ে এক বিশ্রি পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে। প্রচণ্ড কোলাহলে স্মৃতিসৌধের ভাবগাম্ভীর্য ব্যাহত হচ্ছে।”

ফেরদৌসী জানান, ওই সফরে তারা ২০ একর আয়তনের ওই আম্রকাননের প্রতিটি আমগাছের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন এবং কোন গাছের জন্য কী করনীয় তা লিপিবদ্ধ করেন।

“ওই এলাকার বয়জ্যেষ্ঠদের সাথে আলাপ করে জানতে পারি, গত ৪৭ বছর এই আমগাছগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।”

 

ফেরদৌসীর পর্যবেক্ষণ

১. যত্রতত্র দোকানপাট, ময়লা আবর্জনা এবং অবাধে মোটরসাইকেল ও ভ্যান চলাচলের কারণে আমগাছের ক্ষতি হচ্ছে।

২. বৃষ্টি ছাড়া সেখানে পানির কোনো ব্যবস্থা নেই। ভূগর্ভের পানির স্তর নেমেছে গেছে ১৭০ ফুট গভীরে।  ফলে বাগানের মাটি সিমেন্টের মত শক্ত হয়ে গেছে।

৩. প্রতিটি গাছের গুঁড়ি ও ডালপালায় ছত্রাক ও ব্যাক্টেরিয়াজনিত বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, গাছগুলোতে কখনোই কীটনাশক, ছত্রাকনাশক বা পানি দেওয়া হয় না। কয়েক বছর পর পর দুয়েকটি গাছে মুকুল দেখা গেলেও তা আমে পরিণত হয় না।

৪. বাগানের ৯০ শতাংশ আম গাছে Gall disease ev undefined cell division, calluses, Cancer- এর মত তৈরি হয়েছে। দীর্ঘদিন ওষুধ না দেওয়ায় সেগুলো বড় বড় মৌচাকের আকার নিয়েছে।

৫. প্রতিটি গাছের ডালে প্রচুর ফার্ন, অর্কিড আর আগাছা জন্মেছে। এসব আগাছা শুষে নিচ্ছে গাছের তৈরি করা খাদ্য।

৬. দীর্ঘদিন গাছের ডাল-পালা না ছাটায় নতুন পাতা গজানোর হার কমে গেছে। ফলে পুরানো পাতাগুলোর খাদ্য তৈরির সক্ষমতা নেমে এসেছে ২০ শতাংশে। পানির অভাব পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে।

বায়োটেকনোলজিস্ট ফেরদৌসী বেগম

এক সময় এই আমবাগানের মালিক ছিলেন মেহেরপুরের ভবের পাড়ার জমিদার বৈদ্যনাথ বাবু। তার নামেই এ জায়গার নাম হয়েছিল বৈদ্যনাথ তলা।

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম সরকারের মন্ত্রিসভা ওই আমবাগানে শপথ নেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে তার অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি করা হয়।

শপথগ্রহণ এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠের পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ সেদিন একটি বিবৃতি পাঠ করেন, সেখানে বৈদ্যনাথতলার নাম রাখা হয় মুজিবনগর। সেই সঙ্গে মুজিবনগরকে অস্থায়ীভাবে বাংলাদেশের রাজধানী ঘোষণা করা হয়।

স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবসে সেখানে মুজিবনগর স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময় সেখানে গড়ে তোলা হয় ২৩ স্তম্ভ বিশিষ্ট স্মৃতিসৌধ।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ৮০ একর জমি অধিগ্রহণ করে মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কেন্দ্রের কাজ শুরু করে। আম্রকানন ঘিরে গড়ে ওঠে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ, স্মৃতি কমপ্লেক্স, প্রশাসনিক ভবন, অডিটরিয়াম ও প্লাজা, ছয় স্তর বিশিষ্ট গোলাপ বাগান, পর্যটন মোটেল, শিশু পরিবার, মসজিদ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্মৃতি ভাস্কর্য।

আমবাগানের অনেক গাছ যেমন পরিচর্চার অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে, স্মৃতি কমপ্লেক্সের অনেক ভাস্কর্যেও ফাটল ধরেছে।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে গতবছর মেহেরপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলা হয়েছিল, নতুন করে সবকিছু করা হবে। তাই বর্তমান নির্মাণগুলোতে নজর কম। তাছাড়া সরকারের একাধিক মন্ত্রণালয় মুজিবনগরের দেখভাল করে বলে সম্বন্বয়হীনতা রয়েছে।