‘প্রতিবাদে অবিচল’ হওয়ার ডাক রমনা বটমূলে

দিনপঞ্জিকার পাতা উল্টে যে নতুন দিনের মুখোমুখি হয়েছে এই বঙ্গ; তাতে আত্ম-অন্বেষণে বিশুদ্ধ মানব হওয়ার অভিলাষের সঙ্গে অত্যাচার-অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অবিচল থাকার ডাক এসেছে রমনার বটমূলের বৈশাখী বার্তায়।

জয়ন্ত সাহাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 April 2019, 03:42 AM
Updated : 14 April 2019, 05:45 AM

ছায়ানট সভাপতি সনজীদা খাতুন বলেছেন, “অন্তরে ইচ্ছা জাগুক… ‘ওরা অপরাধ করে’- কেবল এ কথা না বলে প্রত্যেকে নিজেকে বিশুদ্ধ করবার চেষ্টা করি। আর আমরা যেন নীতিবিহীন অন্যায় অত্যাচারের নীরব দর্শকমাত্র হয়ে না থাকি।

“প্রতিবাদে প্রতিকার সন্ধানে হতে পারি অবিচল- নববর্ষ এমন বার্তাই সঞ্চার করুক আমাদের অন্তরে। শুভ হোক নববর্ষ।”

যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আগুনে ঝলসে প্রাণ হারানো নুসরাতের জন্য যখন ক্ষোভে ফুঁসছে দেশ, সেই সময় বর্ষবরণের কর্মসূচিতে সব সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে শুভবোধের জাগরণের এই আহ্বান এল।    

চিরনতুনের ডাক দিয়ে আসা পহেলা বৈশাখ রঙ ছড়িয়েছে বাঙালির মনে। নারী-পুরুষের রঙিন সাজে, শিশুর মুখের হাসি আর বর্ণিল পোশাকে তারই প্রকাশ।

রোববার নানা আয়োজনে, নানা আঙ্গিকে সারা দেশে চলছে বর্ষবরণ। সংগীতায়ন ছায়ানট রাজধানীর রমনা বটমূলে ১৪২৬ বঙ্গাব্দকে বরণ করেছে সম্মেলক কণ্ঠের সংগীতে। সেই সঙ্গে এক মিনিট নীরবতায় শপথ নিয়েছে সবাই, সব অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে তারা।

আর্থ-সামাজিক নানা সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি হলেও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, সামাজিক বৈষম্য-অনাচার পিছু ছাড়ছে না। গেল সপ্তাহেই খুন হয়েছেন ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি, নিজের প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ করায় তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

ওই ঘটনায় দেশজুড়ে চলছে প্রতিবাদ। কিন্তু তার মধ্যেই প্রতিদিন আসছে ধর্ষণ-নিপীড়নের খবর। সেই বাস্তবতা ছায়ানট সভাপতি সনজীদা খাতুনের কথায় এল প্রশ্নের আকার নিয়ে।

“চোখ মেললে কিংবা কান পাতলে নিত্যই শিশু, নারী, বল-ভরসাহীন মানুষ তথা সমগ্র মানবতার ওপর নির্মম আচরণের সংবাদ, নিয়ত মার খাচ্ছে সমাজের ধারণা। কোথায় যাচ্ছি?”

রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণের কথন পর্বে তিনি বলেন, “নিষ্কলুষ শিশু সন্তান কোনো সমাজবাসীর অত্যাচারের শিকার হয় কী করে? সমাজ কি পিতামাতা, ভাই বোন, সন্তানসন্ততির গৃহ আর প্রতিবেশী নিয়ে গঠিত শান্তি নিবাস নয়?

“স্বার্থান্বেষী অমানুষদের আত্মসুখ সন্ধানের ফলে নির্যাতনের হাত থেকে পরিত্রাণ পায় না পরিবার। সমাজের কঁচিকাঁচা থেকে শুরু করে কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, সমাজের কোনো মানুষ। কিছু মানুষ কি পাষণ্ড হযে উঠল!”

“নববর্ষ যদি ভ্রাতৃত্ববোধ-মানবতাবোধের উন্মেষ না ঘটাতে পারে, তবে নতুন দিন কী বার্তা নিয়ে আসে?”

এ অন্যায়ের প্রতিবাদে এবার একাট্টা হওয়ার আহ্বান জানান সনজীদা খাতুন। সবাইকে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতায় শামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “আমরা সবাই উঠে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করব, আমাদের ক্ষোভ জানাব, প্রতিবাদ জানাব, দেশে অনাচারের বিরুদ্ধে।

“নুসরাত জাহান, তনু, সাগর-রুনি, মিতু… যে সমস্ত বিষয়ে আমরা আজ পর্যন্ত কোনো খবর পেলাম না বিচারের, সেসব বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে এবং বিগত প্রাণগুলোর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা এক মিনিট নীরবে দাঁড়িয়ে থাকব।”

এই নীরব প্রতিবাদের শেষে ছায়ানট সভাপতি বলেন, “অত্যাচার অনাচার নিপাত যাক, জয় হোক সত্যের সুন্দরের।

বর্ষবরণের এই প্রভাতী আয়োজনের আগে রাতের প্রকৃতি হয়ে উঠেছিল বিরূপ। কালবৈশাখী ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে অনেক আয়োজন। তবে ঝঞ্ঝার রাত শেষে ভোরের আলো ফুটতে যথাসময়েই শুরু হয় ছায়ানটের আয়োজন।

অসিত কুমার দে রাগালাপে নগরে স্বাগত জানান বৈশাখকে। তিনি পরিবেশন করেন রাগ ললিত। এরপর ছিল সম্মেলক কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশনা। ছায়ানটের সম্মেলক দল শোনায় ‘মোরে ডাকি লয়ে যাও’।

এবারের প্রভাতী আয়োজনের গানগুলো নির্বাচন করা হয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম, অতুলপ্রসাদ সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, লালন শাহ, মুকুন্দ দাস, অজয় ভট্টাচার্য, শাহ আবদুল করিম, কুটি মনসুর, সলিল চৌধুরী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা থেকে।

সংগীত পরিবেশনা পর্বে ছায়ানটের বড়দের দল সম্মেলক কণ্ঠে পরিবেশন করে ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী’, রবীন্দ্রসংগীত ‘সকল কলুষ তামস হর, জয় হোক তব জয়’, ‘আনো আনো অমৃত বারি’, ‘নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়’, ‘কোন মেস্তরি নাও বানাইল’, ‘ও মোদের দেশবাসীরে আয়রে’।

ছোটদের দল সম্মেলন কণ্ঠে পরিবেশন করে ‘আপনি অবশ হলি’, ‘ভাইয়ের দোরে ভাই কেঁদে যায়’, ‘তুমি বাহির থেকে’, ‘এমন মানব জনম আর কি হবে’। পরে ছোট ও বড়দের দল মিলে পরিবেশন করে ‘সংঘ শরণ তীর্থযাত্রা’, ‘আয়রে বাঙ্গালি আয় সেজে আয়’।

একক পরিবেশনা পর্বে খায়রুল আনাম শাকিল শোনান ‘প্রথম আলোয় লহ প্রণিপাত’, ফারজানা আক্তার পপি শোনান ‘আপনারে দিয়ে রচিলি রে কি এ’। লাইসা আহমেদ লিসা শোনান ‘হেরি অহরহ তোমারি বিরহ’, মহিউজ্জামান চৌধুরী শোনান ‘সর্ব খর্বতারে দহে তব ক্রোধদাহ’।

তানিয়া মান্নান শোনান ‘এখনো গেল না আঁধার’, মোস্তাফিজুর রহমান তূর্য শোনান ‘এক দিন যারা মেরেছিল’, সুমন মজুমদার শোনান ‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার হতে’, নাহিয়ান দূরদানা শুচি শোনান ‘স্বদেশ আমার, জানি না তোমার..’, সঞ্জয় কবিরাজ শোনান ‘গঙ্গা সিন্ধু নর্মদা’, বিজন চন্দ্র মিস্ত্রী ‘আমায় রাখতে যদি আপন ঘরে’, প্রমীলা ভট্টাচার্য শোনান ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’, শারমিন সাথী ইসলাম শোনান ‘আজ কিসের ডঙ্কা বাজাও ‘, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস শোনান ‘হিংসা আর নিন্দা ছাড়ো’।

আবৃত্তি পর্বে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের‘ প্রশ্ন’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন ত্রপা মজুমদার, জহিরুল হক খান আবৃত্তি করেন বিশ্বকবির ‘এবার ফিরাও মোরে’।

ছায়ানট সভাপতি সনজীদা খাতুনের কথন পর্বের পর রীতি অনুযায়ী জাতীয় সংগীত পরিবেশনায় শেষ হয় ছায়ানটের বর্ষবরণ আয়োজন।