ওরা ছাড় পাবে না: প্রধানমন্ত্রী

যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ করায় গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির ঘাতকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 April 2019, 03:43 PM
Updated : 12 April 2019, 04:29 PM

তিনি বলেছেন, এই ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে সেজন্য এই অপরাধীদের ছাড় দেওয়া হবে না, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে।

ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রসার অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের মামলা প্রত্যাহার না করায় গত ৬ এপ্রিল আলিম পরীক্ষার হল থেকে ডেকে নিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

পাঁচ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ১০ এপ্রিল রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যান নুসরাত। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে সিঙ্গাপুর পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু নুসরাতের শারীরিক অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তা সম্ভব হচ্ছিল না।

এই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে সারা দেশ। হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ-মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালিত হচ্ছে।

এর মধ্যে শুক্রবার বিকেলে গণভবনে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সভার শুরুতে বক্তব্যে নুসরাতের প্রসঙ্গ তোলেন প্রধানমন্ত্রী।

ঢাকা মেডিকেলে নুসরাত জাহান রাফি, পাঁচ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে হার মানেন তিনি

তিনি বলেন, “আমরা দেখেছি মাদ্রাসার এক ছাত্রী মাদ্রাসার অধ্যক্ষ দ্বারা নিপীড়িত হয়। তাকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই যে মানুষকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা এর নিন্দা জানানোর ভাষা আমার নেই।

“আমি চেয়েছিলাম মেয়েটাকে বাঁচাতে পারি কি না। তার ব্যাপারে সিঙ্গাপুরে ডাক্তারদের সাথে কথা বলা, তাদের মতামত নেওয়া। তারা যদি একটু আশ্বাস দিত, আমি পাঠাতে প্রস্তুত ছিলাম। সেটা আর হল না।

“সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। এই যে তাকে বিনা কারণে নির্মমভাবে হত্যা করা হল।  আমরা গ্রেপ্তার করেছি যে অপরাধী, আর বোরকা পরে মুখ, চোখ, নাক ঢেকে, হাতমোজা পরে তার গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকজন ধরা পড়েছে। আরও ধরা পড়বে।”

এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত সবার শাস্তি নিশ্চিতের প্রত্যয় জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এরা ছাড়া পাবে না। আমরা ওদের ছাড়ব না এবং আমি মনে করি, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি তাদের পেতে হবে। কারণ এই ধরনের ঘটনা যেন আর না ঘটে।”

নুসরাতের হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে দেশজুড়ে চলছে নানা কর্মসূচি

মানুষকে এভাবে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার পথ বিএনপি-জামায়াতের দেখানো বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা।  

তিনি বলেন, “এই দেশে এই ধরনের বীভৎস ঘটনা সেই পাকিস্তান আমলে আমরা দেখেছি। যখন ’৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করে তখন তারা বস্তিতে আগুন দিত। মানুষ যখন সাথে সাথে চিৎকার করে বের হয়ে আসত, তখন তাদের গুলি করে হত্যা করত। এভাবে তারা বহু মানুষ হত্যা করেছে।

“আর বিএনপির আমলে দেখলাম জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে একটা রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক একটা জোট বানিয়েছে তারা ২০ দল। তার মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী দল হচ্ছে জামাত। বিএনপি-জামাত মিলে জীবন্ত মানুষের গায়ে পেট্রোল ঢেলে, কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে পোড়ানো, বাসের মধ্যে, লঞ্চের মধ্যে আগুন দেওয়া, ট্রেনে আগুন দেওয়া, সিএনজিতে আগুন দেওয়া, প্রাইভেটকারে আগুন দেওয়া, ড্রাইভারকে বের করে দিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া এই পথটা তো বিএনপি দেখিয়ে দিয়েছে।”

এ থেকে বেরিয়ে আসতে সামাজিক সচেতনতার দরকার বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।

বক্তব্যে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন জায়গায় সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়েও কথা বলেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, “এখানে আমি বলব, যারা এই বাড়ি ঘরগুলো বা অফিস-আদালতগুলো ব্যবহার করে তাদের নিজস্ব একটা দায়িত্ব আছে। কারণ তারা যখন ব্যবহার করে তখন অগ্নিকাণ্ড ঘটলে কীভাবে তারা বের হবে বা এটা নির্বাপনে তারা কী করবে- এটা তো তাদের স্ব স্ব দায়িত্ব।

“আমাদের দেশে অবশ্য একটা ইয়ে আছে... কোনো কিছু হলে সেটা সরকার করবে। এখানে সরকার করছে। আমরা নির্দেশ দিচ্ছি। আমাদের যারা আর্কিটেক্ট, যারা প্ল্যান করে, ডিজাইন করে, আমাদের যারা ইঞ্জিনিয়ার, যারা অনুমোদন দেয় তাদের সচেতন হওয়া উচিত।”

বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুনে ২৬ জনের প্রাণহানির জন্য ভবন নির্মাণে ত্রুটির কথা বলেছেন প্রকৌশলীরা, প্রধানমন্ত্রীর কথায়ই তা উঠে এল।

তিনি বলেন, “ক্রেনে এত উপরে উঠার পর যে উদ্ধার করবে, তারও তো একটা জায়গা লাগবে। যেখানে পা রেখে উদ্ধার করবে, কোনো ব্যালকনি নাই, কোনো বারান্দা নাই, কোনো জায়গা নাই। ওখানে ঝুঁকি নিয়ে উদ্ধার করতে গিয়ে ফায়ারম্যান সোহেল মারা গেল।

“আমাদের দেশে আবহাওয়া, জলবায়ু সবকিছুর সাথে সামঞ্জস্য রেখেই ডিজাইন করা উচিত, প্ল্যান করা উচিত। আর এক ইঞ্চি জায়গাও ছাড়ব না-এটা কেমন ধরনের কথা?”

এফআর টাওয়ারের ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সেখানে একটা সিঁড়ি ছিল, যেটা ফায়ার এক্সিট। ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনের কারণে সেই ফায়ার এক্সিট নাই। আর অনেক সময় এটাকে একটি স্টোর হিসেবে কাজ করা হয়েছে। আমি জানি না যারা এসব ব্যবহার করছে তারাও তো শিক্ষিত মানুষ। তাদের তো সচেতনতা থাকা উচিত। কতগুলো মানুষের জীবন চলে গেল। ভবিষ্যতে এই বিষয়গুলো থেকে…।”

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর গত দশ বছরে ফায়ার সার্ভিসের উন্নয়নে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সভায় শেখ হাসিনা

তিনি বলেন, “আমরা যখন সরকার গঠন করি তখন ফায়ার সার্ভিসের কিছুই ছিল না, একটা ল্যাডারও ছিল না। ক্রেন ছিল না। ছয়তলা পর্যন্ত উঠতে পারত না।

“প্রথম যখন সরকার গঠন করি তখনও ফায়ার সার্ভিসের জন্য জিনিসপত্র কিনে দিয়েছিলাম। পরের বার যখন আসলাম তখনও। এখন সমস্ত উপজেলায় ফায়ার সার্ভিস স্টেশন করে দিচ্ছি, কাজ কিন্তু শুরু হয়ে গেছে। আগে কিন্তু ছিল না।”

কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সেখানে উৎসুক জনতার ভিড় করারও সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী।

“কোনো কিছু হলে লোকে গিয়ে জমা হয়ে যায়। আর আমাদের মিডিয়াগুলো তো… যত বেশি নিউজ। কেউ কেউ আবার সেলফিও তোলে। যত লোক ওখানে গিয়েছিল সবাই যদি এক বালতি করে পানি নিয়েও যেত। যে না আমি পানি দেই, সাহায্য করি। বালি দেই, বালি ছিটাই।

“এই ভলেন্টিয়ার সার্ভিসটাও যদি দিত তাহলেও আমরা বুঝতাম তারা একটা কাজ করতে গেছে। সেলফি তুলতে যাওয়ার মতো এত রোমাঞ্চকর ঘটনা তো সেখানে ঘটছে না। সেখানে মানুষ মারা যাচ্ছে। এটাই হচ্ছে আমাদের দুর্ভাগ্য।”

সভায় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, অর্থ উপদেষ্টা মশিউর রহমান, আওয়ালী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল-আলম হানিফসহ দলটির জ্যেষ্ঠ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।