৫ লাখ টাকা দিয়ে এক মাস সময় পেল গ্রিন লাইন

বাসের চাপায় পা হারানো রাসেল সরকারকে ৫০ লাখ টাকা দেওয়ার যে নির্দেশ হাই কোর্ট দিয়েছিল, তার মধ্যে ৫ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে গ্রিন লাইন পরিবহন কর্তৃপক্ষ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 April 2019, 10:22 AM
Updated : 10 April 2019, 02:33 PM

বাকি ৪৫ লাখ টাকা এক মাসের মধ্যে রাসেলকে বুঝিয়ে দিতে গ্রিন লাইনের মালিককে নির্দেশ দিয়েছে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাই কোর্ট বেঞ্চ।

পা হারানো রাসেল ও গ্রিন লাইন পরিবহনের মালিক হাজী মো. আলাউদ্দিনের উপস্থিতিতে আদালত বুধবার এই আদেশ দেয়।

রাসেল সরকার এক সময় ছিলেন প্রাইভেট কারের চালক। গত বছর ২৮ এপ্রিল যাত্রাবাড়ীর মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে গ্রিন লাইন পরিবহনের একটি বাস তাকে চাপা দেয়।

তাকে বাঁচাতে একটি পা কেটে ফেলতে বাধ্য হয়েছে চিকিৎসকরা। ক্ষতিগ্রস্ত অন্য পায়ের চিকিৎসার জন্যও গ্রিন লাইন কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করার নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।   

ক্ষতিপূরণ চেয়ে সাবেক সাংসদ উম্মে কুলসুমের করা এক রিট আবেদনে রাসেলকে ৫০ লাখ টাকা দিতে নির্দেশ দিয়েছিল হাই কোর্ট। পরে আপিল বিভাগেও ওই আদেশ বহাল থাকে। 

কিন্তু ৪ এপ্রিল গ্রিন লাইনের মহাব্যবস্থাপক আবদুস সাত্তার আদালতে হাজির হয়ে বলেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের মালিক চিকিৎসার জন্য ভারতে গেছেন, ফিরবেন ৯ এপ্রিল।

এরপর হাই কোর্ট রাসেলকে ৫০ লাখ টাকা পরিশোধ করে ১০ এপ্রিলের মধ্যে আদালতে হলফনামা দাখিলের নির্দেশ দেয় গ্রিন লাইন কর্তৃপক্ষকে। তা না হলে গ্রিন লাইনের সব বাস জব্দ করা হবে বলেও হুঁশিয়ার করে আদালত।

কিন্তু রিটকারী আইনজীবী উম্মে কুলসুম বুধবার শুনানির শুরুতেই আদালতকে বলেন, গ্রিন লাইন কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের যোগাযোগই করেনি।

গ্রিন লাইনের আইনজীবী অজি উল্লাহ তখন বলেন, কোম্পানির মালিক হাজী আলাউদ্দিন অসুস্থ। তাছাড়া আরও কিছু জটিলতা আছে। টাকা দিতে তাদের এক মাস সময় প্রয়োজন।

বিচারক তখন বলেন, “উনি অসুস্থ, কিন্তু উনার ব্যবসা তো থেমে নেই, ব্যবসা তো চলছে।… আজকে যদি একটা কিছু নিয়ে আসতেন তাহলে আমরা বুঝতাম একটা মানবিকতা আপনারা দেখিয়েছেন। কিন্তু কিছুই দেন নাই এখন পর্যন্ত। কিছু কমপ্লাই করে ৩টায় আসেন।”

বিকালে আবার আদালত বসলে আইনজীবী অজি উল্লাহ পাঁচ লাখ টাকার একটি চেক দেখিয়ে বলেন, “৫ লাখ টাকার একটা চেক হাতে হাতেই দিতেছি। আগামী ১৫ তারিখে ক্যাশ হবে। নামটা বসিয়ে নিলেই হবে।”

বিচারক তখন বলেন, “মাত্র ৫ লাখ টাকা নিয়ে এসেছেন!... অ্যাক্সিডেন্টটা কবে হয়েছে…। হাসপাতালে ভর্তি থাকল, এর মধ্যে কোনো খোঁজ খবর নেননি আপনারা।”

এরপর রাসেল সরকারকে ডেকে বিচারক জানতে চান তার কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে কি না। রাসেল অ্যাকাউন্ট আছে জানালে বিচারক তাকে চেক নিতে বলেন এবং ওই চেক বুঝে নেওয়ার বিষয়ে বিবাদীপক্ষকে লিখিতভাবে জানাতে বলেন। 

এরপর গ্রিন লাইন পরিবহনের আইনজীবী আদালতের কাছে এক মাস সময় চাইলে বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের প্রশ্ন করেন, ওই সময় তারা পুরো টাকা দেওয়ার জন্য চাইছেন কি না।

অজি উল্লাহ বলেন, “সামনে ঈদ। অনেক হিসাব নিকাশ আছে।”

বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান তখন বলেন, “খোলাখোলি বলেন সময় কেন চাচ্ছেন? এক মাস সময় চাচ্ছেন সময় দিচ্ছি। এই এক মাসের মধ্যে ৫০ লাখ টাকা দিয়ে দেবেন। এরপরে আর কোনো কথা নাই।

“এই এক মাসের মধ্যে বাকি ৪৫ লাখ টাকা দিয়ে দেবেন, এক। দুই নম্বর হল, ওর ট্রিটমেন্টের জন্য ইমিডিয়েটলি যেখানে ভর্তি করা প্রয়োজন সেখানে ভর্তি করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করাবেন।”

এ পর্যায়ে অজি উল্লাহ বলেন, “একটি এনজিও চিকিৎসার ভার নিয়েছে। তারা চিকিৎসা করতেছে। তারপর থেকে সে তো অন্যের কাস্টডিতে আছে। এখন তাকে কো-অপারেট করতে হবে ট্যাকনিক্যালি। এই একটা কো-অপারেশন দরকার।”

বিচারক তখন বলেন, “কী করতে হবে আপনারা কো-অপারেশন করেন। এরকম না যে বিদেশে পাঠিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে। সাভারে সিআরপি আছে, সেখানে কম খরচে চিকিৎসা হয়।”

রাসেল সরকার এ সময় কিছু বলতে চাইলে আদালত তাকে অনুমতি দেয়।

তখন রাসেল বলেন, “উনি (বিবাদীপক্ষের আইনজীবী) বললেন যে, আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। আমি এখন পর্যন্ত বলতেছি গ্রিন লাইন পরিবহন আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি। আমার বাবা-ভাই গিয়েছিল। গ্রিন লাইনের যিনি মালিক তিনি বলেছিলেন যে, ‘আমি হজে যাচ্ছি। রাসেল আমার ছেলের মত। আমার ছোটো ছেলে অ্যাকসিডেন্ট করেছে তার জন্য ওমরাহ করতে যাচ্ছি, রাসেলের জন্য আমি দোয়া করব। রাসেলের জন্য আমি ভালো কিছু করে দেব। আমার অফিসের স্টাফরা যোগাযোগ করবে।”

গ্রিন লাইনের আইনজীবীকে দেখিয়ে রাসেল বলেন, “উনি যে বললেন চিকিৎসার অফার দিয়েছে, টাকার অফার দিয়েছে, এ ধরনের কোনো কিছু হয়নি।”

এরপর গ্রিন লাইন পরিবহনের মালিক মো. আলাউদ্দিনকে ডেকে বিচারক বলেন, “আপনি এত বড় একজন পরিবহন ব্যবসায়ী। একটি পরিবহন চালান। এর বেশ সুনামও আছে। আমরাও চড়েছি আপনার বাসে। সবারই একটা দায় আছে।

“এই যে অ্যাকসিডেন্ট হল, এর একটি নীতিগত দায়িত্ব আছে। নাগরিক দায়িত্ব আছে। এই যে এতদিন হল কোনো খোঁজ-খবর নিলেন না, এটা কি কোনো নীতি? আপনারা জাকাত দেন। মানুষকে সাহায্য করেন বিভিন্নভাবে। এই যে আপনার এত বড় কোম্পানি, আপনার কর্মচারীরা এমনটা না করলেও পারত।”

আলাউদ্দিন এ সময় বলেন, “আপনি অনুমতি দিলে আমি কিছু কথা বলব। বেয়াদবি হলে মাফ করে দিয়েন।… আপনি যেখানে বসে আছেন সেই জায়গাটাকে আমি শ্রদ্ধা করি। এই ছেলেটার যখন অ্যাকসিডেন্ট হইল তার পরপর আমার দুইটা অ্যাকসিডেন্ট হইল।

“পড়ে গিয়ে আমার ওয়াইফের পা ভেঙে গেছে। কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে একটা। আমার বড় ছেলে চিরতরে অন্ধ হয়ে গেছে। আমার লিভার নষ্ট হয়ে গেছিল। আমি হসপিটালে ছিলাম। আমাকে ছেলেরা সিঙ্গাপুরে নিয়ে এক মাস চিকিৎসা করিয়েছি। ব্যবসাতে লস হচ্ছে। পৈত্রিক সম্পদ বিক্রি করে ব্যবসা করছি। প্রায় একশ কোটি টাকা দেনা হয়ে গেছি।”

গ্রিন লাইনের মালিক বলেন, “রাস্তায় গাড়ি চললে দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। গত সপ্তাহে খুলনাতে একটি দুর্ঘটনা হয়েছে। আজকে আপনাদের সম্মান জানিয়ে কিছু টাকা দিলাম। এরপরে আল্লারওয়াস্তে আমার কিছু কথা যদি শোনেন, কীভাবে অ্যাকসিডেন্ট হইল...।”

বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান তখন বলেন, “আপনাদের কোনো কথা থাকলে বলবেন, অবশ্যই আমরা শুনব। মামলাটা তো পেন্ডিং।”

আদালতের আদেশের পর রাসেল সরকার সাংবাদিকদের বলেন, “টাকা বড় কথা না। সব থেকে বড় কথা হল মানুষের একটা অঙ্গ। যে অঙ্গ একমাত্র উপরওয়ালা ছাড়া আর কেউ দিতে পারে না। আমি যদি আজ পাঁচ কোটি টাকা দিয়েও পা লাগাই, তাহলেও আমি আগের জীবনে ফিরে যেতে পারব না।”

গ্রিন লাইনের ওই বাসের চালকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে রাসেল বলেন, “সেটা এখনও কিছু হয়নি। মামলার চার্জশিটের জন্য ১৫ দিন আগে যাত্রাবাড়ী থানার এসআইকে চিঠি পাঠিয়েছি। তিন দিন আগে তিনি জানিয়েছেন চার্জশিট তিনি প্রস্তুত করেছেন। তবে এখনো আদালতে জমা দেননি। আমি চাই চালকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।”

৫০ লাখ টাকার মধ্যে গ্রিনলাইনের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকার চেক পাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে পা হারানো রাসেল বলেন, “আদালতের আদেশের বাইরে আমরা যেতে পারি না। আদালতের রায়কে আমাদের মানতে হবে। আদালতের রায়টা যেন দ্রুত কার্যকর হয় এটাই প্রত্যাশা করছি।”

আদালতে রিটকারী পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী খন্দকার শাসসুল হক রেজা। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার।