এফআর টাওয়ার: মূল নকশায় ‘মিল নেই’, সতর্কবাণীও ‘উপেক্ষিত’

বনানীতে ভয়াবহ আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ফারুক-রূপায়ন টাওয়ারের মালিকপক্ষ যে নকশা দেখিয়ে ভবন নির্মাণের আবেদন করেছিল, ভবন নির্মাণের সময় দেওয়া নকশার সঙ্গে তার ‘মিল খুঁজে পায়নি’ রাউজক।

ওবায়দুর মাসুম জয়ন্ত সাহা ও ফয়সাল আতিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 March 2019, 06:52 PM
Updated : 21 April 2019, 05:42 AM

কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের ২৩ তলা ভবনটির অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থার দুর্বলতা কাটাতে ফায়ার সার্ভিসের নোটিসও আমলে না নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ভবন মালিকদের বিরুদ্ধে।

ওই ভবনের জমির মূল মালিক এস এম এইচ আই ফারুক নামের একজন প্রকৌশলী। আর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভবনের অর্ধেকের মালিকানা ছিল রূপায়ন হাউজিং এস্টেট লিমিটেডের হাতে। এ কারণে নাম সংক্ষেপে ভবনের এফআর টাওয়ার।

মূল মালিকরা বিভিন্ন ফ্লোর পরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। এখন এফআর টাওয়ার পরিচালনা কমিটির সভাপতির দায়িত্বে আছেন প্রযুক্তি খাতের কোম্পানি কাশেম ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডোর এমডি তাসভীর উল ইসলাম, যার কোম্পানি ওই ভবনের তিনটি ফ্লোরের মালিক।

রাজউক জানিয়েছে, ১৯৮৭ সালের রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সংশোধিত) আইন অনুযায়ী ১৯৯৬ সালে ভবন নির্মাণের আবেদন জানিয়ে নকশা জমা দিয়েছিল এফআর টাওয়ারের মালিকপক্ষ। পরে ২০০৫ সালে যখন ভবনটি নির্মাণ করা হয়, তখন আরও একটি নকশা জমা দিতে হয় রাজউকে।

গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম এবং ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম শুক্রবার বনানীতে আগুনে পোড়া এফআর টাওয়ার পরিদর্শনে আসেন। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

তবে মালিকপক্ষের দেওয়া সেই নকশার সঙ্গে মূল নকশার মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে জানান রাজউকের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান।

শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “১৮ তলা পর্যন্ত ড্রয়িং আছে, সেটা আমাদের ফাইলের সাথে মিল খুঁজে পেয়েছি। ২৩ তলাটি ওরা একটা নকশা দেখিয়েছে, অনুমোদন দেখিয়েছে, সেটা আমার ফাইলের সাথে কোনো মিল দেখি না।”

আবদুর রহমান বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত তদন্ত দল অনিয়মের ওই অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করবে। নকশা অনুমোদনের সময় রাজউকে যারা দায়িত্বে ছিলেন, তাদের বিষয়টিও তখন খতিয়ে দেখা হবে। তদন্ত কমিটি যে প্রতিবেদন দেবে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন তারা।

বনানীর ওই ভবনের ২৩ তলার পুরোটা জুড়েই রয়েছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অফিস, রোস্তারাঁ ও কনভেনশন সেন্টার। বৃহস্পতিবার দুপুরে ওই ভবনে আগুন লেগে ২৫ জনের মৃত্যু হয়, আহত হন ৭৬ জন।

অগ্নিকাণ্ডের কারণ খতিয়ে দেখতে যে চারটি তদন্ত কমিটি হয়েছে এর মধ্যে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটিকে ওই ভবনের নকশা অনুমোদন এবং নির্মাণ কাজে ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল কি না- তা খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে।

কীভাবে ওই ভবনে অগ্নিকাণ্ডের সূচনা হয়েছিল, সে বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য এখনও জানায়নি ফায়ার সার্ভিস। তবে ভবনটি নির্মাণের ক্ষেত্রে যে ইমারত বিধি মানা হয়নি এবং সেখানে অগ্নি নিরাপত্তার যথেষ্ট ব্যবস্থা যে ছিল না, সে বিষয়টি সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কথাতেও উঠে এসেছে।

এক দশক আগেও সেখানে একবার অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল জানিয়ে ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক দেবাশীষ বর্ধন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এফ আর টাওয়ারের অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থায় ঘাটতি ছিল। ফায়ার এস্কেপ হিসাবে একটি লোহার সিঁড়ি থাকলেও, বিভিন্ন ফ্লোরে সেটি তালাবন্ধ অবস্থায় দেখা গেছে। সমস্যার বিষয়গুলো আমরা আগেও ভবন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।”

ঢাকার বনানীতে আগুনে পোড়া এফআর টাওয়ারের দায়িত্ব পুলিশের কাছে হস্তান্তরের আগে শুক্রবার বিভিন্ন ফ্লোরে চূড়ান্ত তল্লাশি চালান ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

কিন্তু এফআর টাওয়ার কর্তৃপক্ষ তাতে সাড়া দেয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা বেশ ক’বার ওই টাওয়ারে গেছি, বেশ কিছু সুপারিশ দিয়েছি, কিন্তু তারা কিছুই মানেনি।”

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক অহিদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টফোর ডটকমকে বলেন ওই ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল পুরনো। অগ্নিনিরাপত্তা নকশা অনুমোদন করিয়ে নেওয়ার তাগিদ দেওয়া হলেও তারা শোনেনি।

“এসব ভবন অনেক আগে করা। সে কারণে অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে দুর্বলতা ছিল। ভবনটি ইন্সপেকশন করে আমরা তাদের বলেছিলাম আপনারা আপনাদের ফায়ার সেফটি প্ল্যান আমাদের কাছ থেকে অনুমোদন করিয়ে নেন। সেখানে আমরা বিস্তারিত সুপারিশ করব কী কী থাকবে।

“২০১৮ সালে আমরা তাদের নোটিস করি। কিন্তু তারা আমাদের ডাকে সাড়া দেয়নি। তারপরেও গত ডিসেম্বরে বারিধারায় অগ্নিনির্বাপন নিয়ে একটা ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে তাদের ডেকেছিলাম। কিন্তু সেখানেও তারা আসেননি।”

ফায়ার সার্ভিসের আহ্বান সাড়া না দেওয়ার কারণ জানতে জমির মূল মালিক ফারুক এবং টাওয়ার পরিচালনা কমিটির সভাপতি তাসভীরকে ফোন করা হলেও তারা ধরেননি। 

তবে ফারুকের ম্যানেজার কামাল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা জমির মালিক। ফায়ার সার্ভিসের এ ধরনের কোনো নোটিস আমরা পাইনি। ফায়ার সার্ভিস যে নোটিস দিয়েছে, তা দিয়েছে ফ্ল্যাট মালিকদের। আমরা ওই নোটিসের বিষয়ে কিছু জানি না।”

ঢাকার বনানীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত এফআর টাওয়ারের কয়েকটি ফ্লোর। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

এ বিষয়ে কথা বলতে যোগাযোগ করা হলে রূপায়ন হাউজিং এস্টেট লিমিটেডের উপদেষ্টা পাটোয়ারি জহির উল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওই ভবনের দেখাশোনা রূপায়ন করে না। ওই দায়িত্ব ব্যবহারীদের নিয়ে গঠিত কমিটির।

“২০০৮ সালে রূপায়ন ভবনটি ব্যবহারকারীদের কাছে হস্তান্তর করে দেয়। সেখানে তাদের একটি কমিটি আছে। হস্তান্তর করার সময় সব কাগজপত্র আমরা কমিটির কাছে দিয়ে দিয়েছি। সেই কমিটি সেখানকার সেইফটি, সিকিউরিটি, মেইনটেনেন্স- সমস্ত কিছুর দেখাশোনা করে।”

ভবনের নকশা নিয়ে রাজউকের অভিযোগও অস্বীকার করেন পাটোয়ারি জহির উল্লাহ।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে ১৮ তলার জন্য ভবন মালিক রাজউকের অনুমোদন নিয়েছিলেন। কাজ শুরুর পর দোতলা পর্যন্ত করে আর্থিক সঙ্কটে পড়ায় তিনি আর এগোতে পারছিলেন না। তখন তিনি রূপায়নের সঙ্গে অংশীদারি চুক্তি করেন।

“আমাদের জয়েন্ট ভেনচারে ভবনটি তৈরির প্রস্তাব দেন। আমরা রাজি হই। আমরা ২৩ তলা পর্যন্ত করার জন্য নতুন একটা ডিজাইন দিই এবং নতুনভাবে রাজউক থেকে অ্যাপ্রুভাল নিই। নেওয়ার পরে আমরা সেটা ২৩ তলা পর্যন্ত করেছি।”

রাজউকের অনুমোদন নিয়েই ভবনটি ২৩ তলা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে বলে দাবি করেন রূপায়নের উপদেষ্টা।

তিনি বলেন, “আমাদরে কাছে সব কাগজপত্র আছে। আমরা কাল অফিস খুললে সব দেখাতে পারব। এখানে কোনো রকম পার্থক্য নেই আসলে। তখনকার ডিজাইন কোড অনুযায়ী যা করা হয়েছে তা রাজউকের অনুমোদন নিয়েই হয়েছে।”